বার্সাগেট কেলেঙ্কারি: কী, কেন ও কীভাবে?

কথায় আছে ‘ন্যাড়া বেল তলায় একবারই যায়’। কিন্তু বার্সা সভাপতিরা ইতোমধ্যে সেই কথাকে ভুল প্রমাণ করেছেন। সাবেক সভাপতি সান্দ্রো রাসেলের পর বার্তোমেউও হেঁটেছেন জেলের পথে। ‘বার্সাগেট’ কেলেঙ্কারিতে আটক করা হয়েছে বার্তেমেউসহ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে।

কখনও শুনেছেন নিজের দলের খেলোয়াড়ের বিপক্ষে নিজের দলের সভাপতি কুৎসা রটাচ্ছেন? ভাবতেও কেমন অদ্ভুত লাগে। হতে পারে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হয়েছে, কিংবা মতের মিল নেই; কিন্তু টাকা-পয়সা দিয়ে কুৎসা রটানো, এমনটা ভাবতেও অদ্ভুত লাগে। গত বছর যখন এমন অভিযোগ করেছিল স্প্যানিশ রেডিও ‘কাদেনা সার’ তখন সবাই অবাকই হয়েছিল। কিন্তু একবছর পরে এসে মিলল প্রমাণ। সত্যিই এমনটা করেছিলেন সাবেক সভাপতি।

এতোদিনের তদন্ত শেষে অবশেষে জোসেফ মারিয়া বার্তেমেউকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বার্তোমেউর পাশাপাশি গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেসময় বোর্ডে বার্সেলোনার মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করা অস্কার গ্রাউ, অ্যাডভাইসর জেইমি মুসফেরার ও আইনি সেবার দায়িত্বে থাকা রোমান গোমেজ পন্তিকে।

কিন্তু গালভরা নাম ‘বার্সাগেট’ কি শুধু এতোটুকুই? আর এজন্যই কি গ্রেফতার হয়েছেন বার্তেমেউ? বার্সাগেট নিয়ে যদি আপনার কোনো আইডিয়াই না থাকে, তবে লেখাটি আপনার জন্য!

  • ‘বার্সাগেট’ কী?

‘গেট’ কেলেঙ্কারি শুনলেই সবার আগে মনে পরে ইউএসএ প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের আমলে ফগটা ‘ওয়াটারগেট’ কেলেঙ্কারির কথা। পুরো বিশ্বকে এক কথায় কাঁপিয়ে দিয়েছিল ‘ওয়াটারগেট’ কেলেঙ্কারি। যার জের ধরে পদত্যাগ করতে হয়েছিল দুঁদে প্রেসিডেন্টকে। বার্সেলোনা কেলেঙ্কারির এই গালভরা নাম এসেছে বার্সেলোনার পত্রিকা থেকে। এর কাহিনী সূত্রপাত অনেক আগে।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, তখনও পৃথিবীজুড়ে করোনা ভাইরাসের প্রভাব শুরু হয়নি। এমন সময় হঠাৎ অভিযোগ উঠে যে প্রেসিডেন্ট জোসেফ মারিয়া বার্তেমেউ ‘আই থ্রি’ নামের একটি কোম্পানির সঙ্গে গোপনে চুক্তি করেছেন। উরুগুয়ে ভিত্তিক এই কোম্পানি মূলত বার্সেলোনার সোশ্যাল মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেটর হিসেবেই কাজ করে। কিন্তু নামে এই কাজ করলেও গোপনে তাদের সাথে চুক্তি করা হয়েছে আরেকটি। সেটি হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সভাপতি বার্তেমেউ ও বোর্ডের আস্থাভাজন সদস্যদের সুনাম বাড়ানো। সেটুকুতে আটকে থাকলেও হতো, কিন্তু বার্তোমেউ একধাপ এগিয়ে গিয়ে চুক্তি করা হয় সাবেক ও বর্তমান তারকাদের নিয়ে দুর্নাম ছড়ানো।

  • ‘বার্সাগেট’-এর নৈপথ্যে

প্রশ্ন করতে পারেন, হঠাৎ করে সাবেক ও বর্তমান তারকাদের নিয়ে দুর্নাম ছড়ানোর কী প্রয়োজন ছিল? বার্সেলোনার ইতিহাস চিন্তা করলে বেশ সফল প্রেসিডেন্টই ছিলেন তিনি। টানা ট্রেবল, ডাবল; চিরপ্রতিন্দন্দ্বী দল যখন ট্রফিশূণ্যতায় ভুগছিল। কিন্তু বার্তোমেউর উপর খড়গ আসতে থাকে ২০১৭ সাল থেকে। যেবার জিদানের অধীনা রিয়াল মাদ্রিদ গড়ে বিশ্বরেকর্ড। টানা দ্বিতীয়বারের মতন চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে তাক লাগিয়ে দেয় বিশ্বকে। অন্য কেউ যে রেকর্ড স্পর্শও করতে পারেনি।

সেই সাথে মৌসুম শেষ শুরু হয় নেইমার সাগা। পিএসজিতে যাবেন কী যাবেন না, এই নিয়ে কথাবার্তা। ট্রান্সফার রিউমারের এক পর্যায়ে এসে জেরার্ড পিকে তো ফেসবুকে পোস্টও করে দিয়েছিলেন, ‘সে কুয়েদা’ অর্থাৎ ‘তিনি থাকছেন’ বলে। কিন্তু এতোকিছুর পরেও লাভ হয়নি। ২২২ মিলিয়ন ইউরোর বদলে নেইমারকে হারিয়ে ফেলে বার্সা। নিজেদের প্রিন্সকে হারিয়ে ফেলায় মন:ক্ষুণ্ণ হন খেলোয়াড়েরা, এমনকি সাবেক খেলোয়াড়েরাও।

তখনই বার্তেমেউর বার্সেলোনা নিয়ে পরিকল্পনা ও বিভিন্ন কাজ নিয়ে সমালোচনা করেন সাবেক খেলোয়াড়েরা। এমনকি বর্তমানে থাকা পিকে এবং মেসিও মতন ইতিমধ্যে ক্লাব লিজেন্ড হয়ে যাওয়া তারকারাও নেইমারের জন্য পাবলিকলি হা-হুতাশ করতে থাকেন, যার প্রভাব পরছিল বোর্ডের উপর। ঠিক সে সময়েই ‘আই থ্রি’ কোম্পানির সাথে চুক্তি করে বার্সা বোর্ড। কারণটা স্পষ্ট, নিজের ও বোর্ডের বিপক্ষে রটা কথাগুলোকে সরিয়ে দেওয়া এবং ব্লেইমের অনেকটা অংশ খেলোয়াড়দের উপরে ফেলা।

সোশ্যাল মিডিয়াতে হঠাৎ করে নিজেদের ও সাবেক খেলোয়াড়দের নামে চলা প্রপোগাণ্ডা এবং বাজে কথা দেখে সেসময়ের অনেক খেলোয়াড়ই স্তম্ভিত হয়ে যান। এমনকি চুক্তি নবায়নের আগে আগে মেসিকে নিয়েও বেশ কথাবার্তা রটে, যেখান থেকে তার স্ত্রী-পরিবারকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে জেরার্ড পিকে স্বীকার হন তার ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য। সাবেককদের মধ্যে লাইমলাইটে ছিলেন জাভি, ইনিয়েস্তা, গার্দিওলা এমনকি পুয়োলও। বলতে গেলে সে সময় প্রকাশ্যে যারা বার্সেলোনা বোর্ডের সমালোচনা করেছে সবার বিপক্ষেই চলেছে এই ক্যাম্পেইন।

  • ‘বার্সাগেট’ ফাঁস

কিন্তু গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বার্সেলোনার গোপন সূত্র থেকে ছড়িয়ে পরে এই কথাক। সকল প্রমাণাদি নিয়ে এক করে সকল তথ্য প্রকাশ করে স্প্যানিশ রেডিও কাদেনা সার। পাবলিকলি একবার এই কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরপর এগিয়ে আসেন ক্লাবের কিছু সদস্য। তারা সরাসরি অভিযোগ আনেন বার্তেমেউ ও গংয়ের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ছিল অনৈতিকভাবে তারা ক্লাবের অর্থ নয়ছয় করেছে। সঙ্গে দূর্নীতি। কিন্তু অভিযোগ আনার পরপরই বার্সেলোনা ও ‘আই থ্রি’ গ্রুপ পুরোটাই অস্বীকার করে। পুরো বিষয়টাকে বার্সা মিডিয়া নাম দেয়, ‘বার্সাগেট’। এর জের ধরেই তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করেন বার্সেলোনা বোর্ডের ছয়জন পরিচালক।

যদিও এতকিছুর পরেও টিকে ছিলেন বার্তেমেউ। তবে ক্লাবের সদস্যরা তার বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের আয়োজন করলে গত ২৭ অক্টোবর সভাপতির পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বার্তেমেউ। অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান কার্লেস তুসকেতস। তার অধীনেই ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে বার্সেলোনার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন।

  • ‘বার্সাগেট’-এর অভিযোগসমূহ

কাগজপত্র অনুযায়ী ‘আই থ্রি’ কোম্পানি এখনও বার্সেলোনার সাথে যুক্ত। বার্সার দেওয়া শেষ অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট অনুযায়ী ‘আই থ্রি ভেনচার্স’ বার্সেলোনার একটি ‘সার্ভিস প্রোভাইডার’ কোম্পানি। যাদের কাজ বার্সেলোনার সোশ্যাল মিডিয়া অপারেট ও মনিটর করা। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর প্রায় ১ মিলিয়ন ইউরো দেয় বার্সা বোর্ড। যা তাদের সাথে হওয়া ইনিশিয়াল বা অফিসিয়াল চুক্তির বাইরে। স্প্যানিশ রেডিওর মতে এই কাজের জন্য প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার পাউন্ডের গোপন চুক্তি করেন বার্তেমেউ।

চুক্তির টাকাও এসেছে বেশ বড়সর ফন্দি-ফিকির করে। বার্সেলোনার মূলত ২ লাখ ইউরোর নিচে কোনো ডিল করতে গেলে বোর্ডের মিটিংয়ে কিংবা বোর্ডের কয়েকজনের সম্মতি লাগে না। বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নিজেরা মতামত দিলেই সেই ডিল কার্যকর হয়ে যায়। যে কারণে পুরো ‘আই থ্রি’র সাথে চুক্তির টাকা এভাবেই সরিয়েছে তারা।

  • ‘বার্সাগেট’ হোতাদের ধরা পরা

বার্সেলোনার এই বিষয়াদি নিয়ে ইনভেস্টিগেশন হচ্ছে প্রায় এক বছর ধরেই। কিন্তু প্রমাণাদি পাওয়া যাচ্ছিল না। এর আগে দুই দফায় ক্যাম্প ন্যু অফিসে সার্চ করেও কিছু পায়নি পুলিশ। কিন্তু আজ সকালে বার্সেলোনা অফিসে হানা দেয় পুলিশ। এবং সেখানেই প্রয়োজনীয় নথি-পথ খুঁজে পায় তারা। এবং তার জের ধরেই দাবেক প্রেসিডেন্ট জোসেফ মারিয়া বার্তেমেউ, সাবেক অ্যাডভাইসর জেইমি ম্যাসফেরার, সাবেক সিইও অস্কার গ্রাউ ও সাবেক লিগ্যাল কাউন্সিল রোমা গোমেজকে আটক করেছে পুলিশ।

সভাপতিত্ব ছাড়ার পরপরই দূনীর্তির দায়ে আটকা পরার গল্প অবশ্য এটাই প্রথম না। বার্তোমেউর আগে প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকা সান্দ্রো রাসেলকেও যেতে হয়েছে জেলে, মানি লণ্ডারিংয়ের দায়ে। এবার সেই পথে হাঁটলেন বার্তেমেউ। কথায় আছে ‘ন্যাড়া একবারই বেল তলায় যায়’। কিন্তু বার্সা প্রেসিডেন্টরা ইতিমধ্যে দুইবার চলে গিয়েছেন। দেখা যাক নতুন আসা প্রেসিডেন্ট বার্সাকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে পারেন কী না?

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...