রুটের মুখে রুটের গল্প!

দেড় মৌসুমের মত আমি, জো আর বাবা একই দলে খেলেছিলাম। সেটা ছিল অসাধারণ মুহূর্ত। কিন্তু এর জন্যে মা-কেই ক্রেডিট দিতে হবে। বাবা ছিল ভীষণ ব্যাস্ত, তো মা-ই আমাদেরকে হেডিংলিতে প্রতি মঙ্গল আর বুধবার অনুশীলন করতে নিয়ে যেত। এরপর অনুশীলন শেষে শেফিল্ডে ফিরিয়ে নিয়ে আসত।

জো রুট এশিয়াতে এসে নিজের ক্যারিয়ারের রেকর্ডের পাতাগুলো নতুন করেই লিখছেন। ইংলিশ ক্রিকেটের রাজপুত্র কন্ডিশনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একের পর এক ক্লাসিক ইনিংস খেলে যাচ্ছেন।

এতে অবশ্য জো রুটকে নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। আজকে  আমরা রুটের পথচলাটা আমরা ওর পরিবার থেকে দেখার চেষ্টা করব। এখন, পরিবার থেকে এই পথচলা দেখতে হলে গল্পটা পরিবারের কেউ বললেই তো ভাল হয় তাইনা? আজ তাই জো রুটকে নিয়ে এই গল্পটা বলাব ওর ছোট ভাই বিলি রুটের মুখ দিয়ে। 

আমার দাদা এবং বাবা দুজনই ক্রিকেট খেলত; বাবা তো অনেক ভাল খেলত। আমি আর জো অনেক ছোট বয়স থেকেই তাই ব্যাট হাতে নেমে পড়েছি। ক্রিকেট নিয়ে আমার প্রথম স্মৃতি মা আর জো-এর সাথে বাবার ম্যাচ দেখতে যাওয়া । তবে আমি আর জো-ও খেলতে চাইতাম। যেকোন সুযোগকেই আমরা সাদরে গ্রহণ করতাম। ছুটির মৌসুমে আমরা মাঝে মাঝে গ্রীসে বেড়াতে যেতাম, সেখানকার বাসিন্দারা তো আমাদের ব্যাট আর বল দেখে অবাক হয়ে বলত, ‘তোমরা কি করছ?’

এটা এখন সবাই জেনে গেছে আমরা শেফিল্ড কলেজ ইউনাইটেডের হয়ে খেলেছি । এটাও শুরু হয়েছিল বাবার ম্যাচ দেখতে গিয়ে আমি আর জো যখন বাউন্ডারিতে ক্রিকেট খেলছিলাম তখন।

আমি আর জো যখনই ক্রিকেট খেলেছি, ফ্রেন্ডলি ভাবে খেলেছি। বুঝতেই পারছেন, ও আমার বড় ছিল। ও ব্যাট করতে চাইলে ও-ই ব্যাট করত। একবার আমি আর ও স্কারবরো তে খেলছিলাম, ও সারাদিন ব্যাট করল। আমি ওকে আউট করতে পারছিলাম না। অনেক্ষণ পর যখন ওকে আউট করতে পারলাম, ও আমাকে ব্যাট করতে দিল। ও বলল, প্রথম বলেই নাকি আমি এববিডব্লু হয়ে গেছি! আমার ভীষণ রাগ হল, আমি ওর দিকে ব্যাট আর প্যাড ছুঁড়ে মেরেছিলাম। পরে বাবা এসে আমাদের থামিয়েছিল।

কলেজিয়েটের তো কোন অনূর্ধ্ব-১১ দল ছিল না। আমরা সর্বপ্রথম প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেছিলাম তাই রাদারহ্যাম টাউনের হয়ে, যেটা ছিল আসলে আমার দাদাবাড়ির পাশেই। ঐ ম্যাচ আমি আর জো একসাথে ব্যাট করতে নেমেছিলাম। তো হয়েছে কি, ওভারের প্রথম ৫ বল খেলে ও বল ঠেলে দিয়ে দৌড় দিল। আমিও দৌড়াতে গিয়ে ক্রিজের অর্ধেকে থাকার সময় রান-আউট হয়ে গেলাম। এরপর অনূর্ধ্ব-১১ তে আমি আর ওর সাথে খেলতে নামিনি। কিন্তু কলেজিয়েট আর ইয়োর্কশায়ারে আমরা অনেক পার্টনারশিপের অংশীদার হয়েছি।

একবার কি হয়েছিল শুনুন তাহলে। আমরা তখন টিনএজার, ম্যাচটা ছিল ডনকাস্টারের বিপক্ষে। জো সেই ম্যাচে ওপেন করেছিল আর আমি ছিলাম চার নম্বরের ব্যাটসম্যান। আমি যখন ক্রিজে যাই, ওর রান তখন ৪৯। ছয় ওভার পর আমার রান হয়ে গেল ৩২ আর ও তখন ৫০ পেরিয়েছে। আমি ওকে তখন বললাম, ‘আমি তোমাকে ১০০ পর্যন্ত তাড়া করব’। এরপর আমার রান যখন ৯৮ হয়ে গেল, ওর রান তখন মাত্র ৬০! এরপর আমি আউট হয়ে গেলাম আর ইনিংস শেষে ওর রান দাঁড়াল ১৪০ এ অপরাজিত! ও এরপর আমার কাছে এসে বলে, ‘কচ্ছপ সবসময়ই খরগোশকে হারিয়ে দেয়’

দেড় মৌসুমের মত আমি, জো আর বাবা একই দলে খেলেছিলাম। সেটা ছিল অসাধারণ মুহূর্ত। কিন্তু এর জন্যে মা-কেই ক্রেডিট দিতে হবে। বাবা ছিল ভীষণ ব্যাস্ত, তো মা-ই আমাদেরকে হেডিংলিতে প্রতি মঙ্গল আর বুধবার অনুশীলন করতে নিয়ে যেত। এরপর অনুশীলন শেষে শেফিল্ডে ফিরিয়ে নিয়ে আসত। এছাড়াও, একই বাসাতে তিনজন ক্রিকেট খেলায় প্রচুর ময়লা সাদা জামা জমে যেত। এর এগুলো ধোয়ার মত অবস্থাতে আমি,জো আর বাবা- কেউই থাকতাম না। এগুলো মা-ই করে দিত আমাদের।

ঝটপট পড়ে ফেলুন

ক্রিকেট ছাড়াও আমাদের বাসায় কিন্তু মিউজিকের চর্চাও হত ভীষণ। বাবা তো দারুণ গিটার বাজাত। আমিও কিছু কর্ড বাজাতে পারতাম। কিন্তু জো ছিল অনন্য, সে দারুণ উকুলেলে বাজাত। আমি ওর ধারেকাছেও ছিলাম না।

জো কিন্তু ওর ক্যারিয়ারে অনেক বাঁধা দেখেছে। ও একটা সময়ে ক্রিজে এলবিডব্লু হয়ে যেত, ব্যালেন্স রাখতে পারত না। এটা হতে পারে ওর উচ্চতার কারণে। এতে ও রান পাচ্ছিল না। একবার টানা ছয় ইনিংসে ও ১০ অতিক্রম করতে পারল না। কিন্তু এরপর ওয়ারউইকশায়ারের সাথে ও ১৭০ করে ফেলল। ও ওর সমস্যা নিয়ে যেভাবে কাজ করত, এটাই আমাকে মানতে বাধ্য করত ওর কাছে কিছুই প্রতিবন্ধকতা নয়।

আর শুধু তাই না। ও তো এক সময় সবার কাছে পরিচিত হতে শুরু করল, সমর্থক জমে গেল ওর। তখনও আমার কাছে ওকে আমার বড় ভাই-ই মনে হয়েছে। জো রুট আমার কাছে সবসময়ই ‘জো’ হয়ে থেকেছে।

২০১৩ এর অ্যাশেজে আমি ইংল্যান্ড দলের দ্বাদশ খেলোয়াড় ছিলাম। সেবার একদিন ড্রেসিং রুমে যাওয়ার পর জো আমাকে বলল, ‘আমার সামনে বোস।‘ এরপর ও আমাকে বেশ কিছু কথা বলে, যেটা আমার আসলেই জানা দরকার ছিল।

এরপর জো ঐ ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিল। বাউন্ডারির বাইরে বসে থেকে সেটা দেখা, আমার কাছে বিশেষ মুহুর্তই।

আমি আর জো একবারই পরস্পরের বিপক্ষে খেলেছি। বাবা তো সেই ছবিটা টুইটও করেছিল। সে ম্যাচের জন্যে জো-ই আমাকে ড্রাইভ করে নিয়ে গেছিল। আমি তখন খেলতাম নটিংহ্যামশায়ারের পক্ষে, জো খেলত ইয়োর্কশায়ারে।  ম্যাচটা হয়েছিল ২০১৭ সালের দিকে।এর আগেও যে আমরা একে অপরের বিপক্ষে খেলিনি তা নয়, কিন্তু সেগুলো পেশাদার ক্রিকেটে ছিল না। এটাই প্রথম কোন ম্যাচ ছিল পেশাদার ক্রিকেটে। সত্যি বলতে, সে ম্যাচটাতে আমার জিততেও ইচ্ছে করছিল, আবার আমি এটাও চাইছিলাম না যে জো হেরে যাক।

সে ম্যাচের একটা গল্প বলি তাহলে। আমি ওর বিপক্ষে বল করছিলাম। আমি ওর সাথে একটু মাইন্ড-গেম খেলতে চাচ্ছিলাম। স্টুয়ার্ট ব্রড কে বললাম একটু কাছে থেকে ফিল্ডিং করতে আর জো’র উদ্দেশ্যে কথা ছুঁড়ে দিতে। এরপর আমি চাইছিলাম জো এমন কিছু করতে বাধ্য হোক যেটা ও করেনা। কিন্তু জো কি করল, ব্রডের মাথার ওপর দিয়ে ছক্কা মেরে দিল। ওর এসব মাইন্ড গেম দেখার সময়ই ছিল না। ও নিজের কাজটাই করতে চাইত শুধু।

সত্যি কথা বলছি, আমরা যখন বাবার ম্যাচের সময় বাউন্ডারির বাইরে ক্রিকেট খেলতাম, বা রাদারহ্যাম টাউনের হয়ে অনূর্ধ্ব-১১ পর্যায়ের ম্যাচ খেলতাম- তখনও যদি কেউ আমাকে বলত জো ১০০ টেস্ট ম্যাচ খেলবে আমি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিতাম। জো’র টেকনিক ছিল তখন থেকেই অনবদ্য।

জো খাটো ছিল, তাই প্রত্যেক বলে হিট করতে পারত না। কিন্তু ওকে কেউ আউটও করতে পারত না। মাইকেল ভন মাঝেমধ্যে শেফিল্ড কলেজ ইউনাইটেডে আসত , জো কে ব্যাট করতে দেখত আর বলত, ‘এই ছেলেটা একদিন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে যাচ্ছে।’

জো’র এই পথচলাটা আমাদের পুরো পরিবারের পথচলা। ও যখন খেলে, আমি, মা, বাবা, ক্যারি (জো রুটের স্ত্রী ক্যারি কটরেল) টিভির সামনে বসে যাই। আমাদের নার্ভাস লাগে ভীষণ , আমরা মনেপ্রাণে চাই ও ভাল খেলুক। এটা শুনতে হয়তো আপনাদের হাস্যকর লাগছে, কেননা ও দীর্ঘদিন ধরেই দারুণ খেলছে কিন্তু এটাই সত্যি।

আমরা ওকে নিয়ে সত্যিই গর্বিত!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...