মৃত্যুদণ্ড পাওয়া একমাত্র ক্রিকেটার!

নিউইয়র্কে রয় ফ্রান্সিস নামের এক অভিজাত ঘরের ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন রোজ, যা পরবর্তীতে নিউইয়র্কেই থাকা কিছু বন্ধুর কাছ থেকে পাঠানো একটি টেলিগ্রামের মাধ্যমে জানতে পারেন জামাইকায় থাকা লেসলি।১৯৫৪ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সেই চিঠির পাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন লেসলি। লার্লিনকে সাথে সাথেই নিউইয়র্ক থেকে জামাইকা ফিরে আসতে বলেন লেসলি। লেসলির কথামতো মে মাসে জামাইকায় ফিরে আসেন রোজ।

কি চোখ কপালে উঠে গেলো শুনে? ওঠারই কথা! ক্রিকেট ইতিহাসে কত রকম বিচিত্র ইতিহাসেরই না জন্ম দিয়েছেন ক্রিকেটাররা! এদের বেশিরভাগই ক্রিকেট মাঠে কিন্তু কিছু কিছু ক্রিকেটার মাঠের বাইরের ঘটনার জন্যও স্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন! এদেরই একজন লেসলি হিলটন।

ছয় টেস্টের ক্যারিয়ারে মাত্র ১৬ উইকেট তাঁর। এ আর এমন কী! বরং কিছুই না। তবুও লেসলি হিলটনকে অনেকেই মনে রাখবেন। এবং এই লেখাটি পড়ার পর হয়তো-বা আপনিও তাকে মনে রাখবেন।

জামাইকার খুবই গরিব এক পরিবারে জন্ম লেসলি হিলটনের৷ বাবা মারা গেছেন তার জন্মেরও আগে আর ৩ বছর বয়সে হারান মাকে৷ এরপর যে বড় বোনের কাছে বড় হয়ে ওঠা সেই বোনকেও হারান ১৩ বছর বয়সে। একটা পর্যায়ে মারা যান বোনের পরে তাঁর দায়িত্ব নেওয়া খালাও। ছেড়ে দেন পড়ালেখা, কাজ শুরু করেন দরজীর দোকানে৷ এরপর তার ক্রিকেটে কিভাবে আসা সেটা জানা যায়নি।

১৯২৭ সাল থেকে জামাইকা ক্রিকেট দলের নিয়মিত ফাস্ট বোলার হয়ে যান লেসলি। সেখানে ভালো পারফর্ম করে ১৯৩৫ সালে উইন্ডিজের ইংল্যান্ড সফরে প্রথমবারের মতো ডাক পান জাতীয় দলে৷ তবে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৩৯ সালে ছয় টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলেন ঘরোয়া লিগে ৪০ ম্যাচে ১২০ উইকেট স্বীকার করা ডানহাতি এই ফাস্ট বোলার।

তার অভিষেক টেস্ট ম্যাচটি ছিল ইতিহাসের অদ্ভুততম ম্যাচগুলোর একটি! সেই ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ১০২ রানে অল আউট হয় ক্যারিবিয়রা। এরপর সবাইকে চমকে দিয়ে মাত্র ৮১ রানে ৭ উইকেট হারানোর পর নিজেদের প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে দেয় ইংলিশরা!

দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ৬ উইকেট হারিয়ে মাত্র ৫১ রান করতেই নিজেদের ২য় ইনিংস ঘোষণা করে উইন্ডিজ যার কারনে ইংল্যান্ডের ম্যাচ জেতার জন্য দরকার ছিল মাত্র ৭৫ রান। পরবর্তীতে ৪ উইকেটে সে ম্যাচ জিতে যায় ইংলিশরাই। ঐ সিরিজের শেষ দুই ম্যাচ জিতে সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতে উইন্ডিজই। এবং পুরো সিরিজে মোট ১৬ উইকেট নেন লেসলি হিলটন।

খেলা ছাড়ার পর পড়ালেখা না জানার পরও সাবেক ক্রিকেটার হওয়ার সুবাদে চাকরি পেয়ে যান জামাইকার সিভিল সার্ভিসের পুনর্বাসন বিভাগে৷ ১৯৪০ সালে সেখানেই পরিচয় হয় এক পুলিশ ইন্সপেক্টরের মেয়ে যার নাম লার্লিন রোজ। এবং এই পরিচয় রূপ নেয় প্রেমে। প্রেম থেকে বিয়েতে রূপ নেয় ১৯৪২ সালে। যদিও পুলিশ ইন্সপেক্টর বাবা প্রথমে মানতেই পারেননি তার মেয়ের বিয়ে একজন গরীব ঘরের ছেলের সাথে হোক। কেননা অর্থ, সামাজিক কিংবা বংশমর্যাদা, সবদিক থেকেই যে রোজের চেয়ে অনেক পিছিয়ে লেসলি। কিন্তু রোজও তখন জানিয়ে দিয়েছিলেন যে বিয়ে করলে লেসলিকেই করবেন তিনি। ১৯৪৭ সালে এই দম্পতির ঘরে আসে এক ছেলে সন্তান।

১৯৫১ সালে নিজের ছোটবেলার ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্য নিয়ে লার্লিন রোজ ছেলে ও মাসহ পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে৷ সেখানে রয় ফ্রান্সিস নামের এক অভিজাত ঘরের ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন রোজ, যা পরবর্তীতে নিউইয়র্কেই থাকা কিছু বন্ধুর কাছ থেকে পাঠানো একটি টেলিগ্রামের মাধ্যমে জানতে পারেন জামাইকায় থাকা লেসলি।

১৯৫৪ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সেই চিঠির পাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন লেসলি। লার্লিনকে সাথে সাথেই নিউইয়র্ক থেকে জামাইকা ফিরে আসতে বলেন লেসলি। লেসলির কথামতো মে মাসে জামাইকায় ফিরে আসেন রোজ। এরপর লেসলি তাঁর কাছে তার নিউইয়র্কে এক অভিজাত ঘরের ছেলে ফ্রান্সিসের সাথে প্রেমের সত্যতার কথা জানতে চাইলে প্রথমে অস্বীকার করেন এবং রয়ের সাথে ‘শুধুই পরিচয়’ থাকার কথা বলেন রোজ। তবে বেশিক্ষণ সেই মিথ্যা কথা টিকতে পারেনি। একটা পর্যায়ে প্রেম তো বটেই নিজের গর্ভে যে রয় ফ্রান্সিসের সন্তান আছে সেটাও বলে ফেলেন!

‘আমার বাবার উপদেশ শোনা উচিৎ ছিলো আমার। তুমি (লেসলি) আমার শ্রেণির না। তুমি একটা নরপশু! আমি গত ৩টি বছর তোমার সাথে থেকে আমার জীবনের সময় নষ্ট করেছি এবং এখন আমি সেই পুরুষটিকে পেয়ে গেছি যাকে আমি ভালোবাসি, তুমি আমার পথে দাড়াতে পারবে না। সে আমাকে সেই আনন্দ দিয়েছে যা আমি কখনোই তোমার সাথে থেকে পাইনি। আমি তার সন্তানের মা হতে চলেছি। আমি শুধু রয়ের, রয়ের, রয়ের!’

যে স্ত্রীকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ছিলেন সে স্ত্রীর মুখ থেকে এই কথা শোনার পর নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারেননি লেসলি হিলটন। নিজের কাছে থাকা রিভলবার দিয়ে একটি-দুটি নয়, সাত সাতটি গুলি করেন প্রিয়তমা স্ত্রীর বুকে! সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান রোজ। এরপর নিজ থেকেই ফোন করে ডেকে আনেন পুলিশকে। পুলিশকে প্রথমে বলেন তিনি নাকি নিজে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ভুলবশত স্ত্রীর গায়ে গুলি লেগে যায়।

‘হঠাৎই আমি দেখতে পাই রক্ত। সব জায়গায় শুধুই রক্ত এরপর বুঝতে পারি যে আমি আমার স্ত্রীকেই গুলি করেছি৷’

কিন্তু তদন্ত শেষে জানা যায় তা মিথ্যা ছিল। প্রমাণ হয় যে, ঠাণ্ডা মাথায় তিনি স্ত্রীর হত্যা করেন। আদালত লেসলি হিলটনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ঠিক পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৫৫ সালের ১৭ মে কার্যকরও হয়ে যায় লেসলি হিলটনের ফাঁসির আদেশ।

এভাবেই মৃত্যুদণ্ড পাওয়া একমাত্র ক্রিকেটারের খেতাব পেয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান লেসলি হিলটন। এতো কিছুর পরও অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন লেসলি। তাঁর প্রেম, বিয়ে ও মৃত্যুদণ্ড নিয়ে লেখা হয়েছিল অনেক বই। এক খুনীর জন্য এমন ভালাবাস নজীরবিহীন।

লেসলি হিলটনের এই করুণ জীবনকাহিনী থেকে আমরা একটা শিক্ষা নিতে পারি। সেটা হল, জাত্যভিমান এমন একটি জিনিস যেটা যে কোনো সময় মানুষের মাঝে ফুটে উঠতে পারে৷ তাই বিয়ের আগে এসব ব্যাপার নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করা উচিৎ। বিয়ের আগে প্রেম করলে হয়তো-বা এসব কিছু মাথায় আসে না কিন্তু একটা সময় সেটা ফুটে উঠবেই! আর তখন সম্পর্কের জন্য খুবই ভয়ংকর হয়ে যায় সেটা। লেসলি হিলটন ও লার্লিন রোজের ঘটনা অন্তত এটাই শেখায় আমাদের।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...