দ্য মিরাকল ম্যান

না, দীনেশরা কথা বলেন না, যেবার স্ত্রী সতীর্থের সাথে চলে গেল, সেবার ও চুপ ছিলেন, বহুবার নোংরা ব্যক্তিগত ট্রল এর মুখোমুখি হতে হলেও তিনি চুপ থেকেছেন, বলেননি একটাও কথা, করেননি কোনো শেমিং, ঠিক যেমন টা চুপ থেকেছেন রোহিত, বিরাটরা, ওনাদের কাছে দীনেশরা হল পলিটিক্যাল ওয়ারের কল্যাটারাল ড্যামেজ, যেগুলো দিনের শেষে চাপা পড়ে যায় শত ফাইলের তলায়।

‘কমেথ দ্য ম্যান, কমেথ দ্য আওয়ার, দিস ম্যান হ্যাজ পুল্ড অফ সামথিং আনবিলিভেবল’। মিরাকল, অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য।

সময়কে উল্টে দেওয়া, মানব মস্তিষ্কের প্রব্যাবিলিটি এনালিসিস কে বুড়ো আঙুল দেখানোর আরেক নাম মিরাকল, এমন এক জিনিস, যেটা আমরা দেখতে খুব ভালোবাসি, ক্রিকেটে হলে তো বলাই বাহুল্য। কোনোদিন মিরাকল যারা করে তাদের কথা ভেবে দেখেছেন? বেশ কয়েকজন কে তুলে দেখা যাক।

মহেন্দ্র সিং ধোনি, ওয়াকিং মিরাকল, বহু হারা ম্যাচ একদম ঠাণ্ডা, ভাবলেশহীন মুখ করে বার করে দিয়েছেন, এতটাই অবলীলায় এবং এতটাই নিয়মিত ভাবে যে নেটফ্লিক্স তাকে নিয়ে নিশ্চিন্তে সিরিজ বানাতে পারে, ‘দ্য ফিনিশার!’

এরপর আসি সাম্প্রতিক কাল এর সবচেয়ে বড় মিরাকল ম্যান এর প্রসঙ্গে, স্যার বেন স্টোকস, লর্ডস বলুন বা হেডিংলে, এনার নাম দু বার ইতিহাস এর পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেছে, ধোনির মত নিয়মিত না হলেও স্টোকস কে বলায় যায়, ‘দ্য নাইট অফ বিগ স্টেজ!’

এবার আসি আরেকটু অনিয়মিত মিরাকল ম্যানদের দিকে, যেমন আন্দ্রে রাসেল, সব সময় করেন না কিন্তু যেদিন করেন, সেদিন জায়ান্ট স্ক্রিন থেকে ওনার ‘মাসেল, রাসেল’ নাম টা সরানো মুশকিল ব্যাপার হয়, কিন্তু ওনার মিরাকল গুলো একটি ফরম্যাট এ সীমাবদ্ধ।

এবার আসি তাদের কথায়, যাদের গোটা ক্যারিয়ারে একটাই মিরাকল, সেই মিরাকল টা র ভিত্তি তেই তাদের পারফরম্যান্স বিচার করা, যাকে পরিভাষায় বলে ক্যারিয়ার ডিফাইনিং, আর এখানেই আসে এক কালের কেকেআর অধিনায়ক এর নাম।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের চারমূর্তি’র অভিযানে একটা অংশ আছে যেখানে টেনিদা দের প্লেনরা গড়গড়িয়ে চলেছে তো চলছেই, ওড়ে আর না, শেষ পর্যন্ত অনেক পড়ে সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত লাফটা প্লেনটা মারলো।

ক্রিকেটারদের কেরিয়ার ঠিক এরকম জানেন তো, কারো শুরুতেই লাফটা মারে, কারো পরে, কারো চাকা গড়াতেই থাকে।

কিন্তু দীনেশ কার্তিকের কেরিয়ার এর চাকাটা একদম অন্যরকম, উনি বারবার লাফ মেরেছেন, কিন্তু প্রতিবারই সন্তর্পনে চাকা এসে মাটি ছুঁয়েছে, আশ্চর্যের ব্যাপার কোনোদিন রান ওয়ের বাইরে কিন্তু বেরিয়ে যাননি।

সেই সুদীর্ঘ ষোলো বছর আগে ভারতীয় দল এ যাত্রা শুরু, শুরু চাকা গড়ানোর, শুরু লাফ এর প্রতীক্ষার, সে ইংল্যান্ডে শেষ টেস্ট সিরিজ বিজয়ে দ্রাবিড়ের টিমের গুরুত্বপূর্ণ ওপেনার হিসেবে হোক, ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বিজেতা দলের সদস্য হিসেবে হোক বা জীবনের সবচেয়ে বড় বছর, ২০১৮ হোক।

২০১৮ সালের জন্য কয়েক শব্দ খরচা করতে হবে, স্যুট পড়া ভেঙ্কি মাইসোরের পেছন পেছনে যখন একগাল হাসি নিয়ে দক্ষিণী যুবক যখন ষ্টার স্পোর্টস এর ষ্টুডিও তে ঢুকলেন, কে বলবে ইনি এখন কিং খান এর কলকাতা সাম্রাজ্যর একছত্ৰ অধীশ্বর? তখনই বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নেভার ফেল্ট দিস গুড এবাউট মাইসেলফ’, কথা টা মিথ্যা ছিলো না যখন একদম নিশ্চিত হার এর মুখ থেকে নিদাহাস ট্রফিটা নিয়ে গেলেন রোহিত শর্মার হাতে, মুম্বাইকর একগাল হেসে পোজ দেওয়ার সময় কি ভেবেছিলেন, এর কাছে আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত?

কাট টু ইডেন গার্ডেন্স, নতুন পাওয়া ক্যামিও কিং ডাকনাম পাওয়া লাজুক ছেলেটা কে শুনতে হলো বিরাট কোহলির পাশে নাকি উনি ঠাণ্ডা আলুর চপ।

আলুর চপ গরম হল কিনা জানি না, কিন্তু দীনেশ কার্তিকের টিম শেষ করলো তিনে, গম্ভীর পরবর্তী যুগের তুমুল সমালোচনার মধ্যেও। এবার সবাই ভেবেছিল, বহু প্রত্যাশিত ওই লাফটা বোধহয় এসে গেছে, হর্ষ ভোগলে বলেছিলেন, ‘দীনেশ, আই হ্যাভ নেভার সিন ইউ প্লে দিস গুড ইন ইওর ক্যারিয়ার, এন্ড আই এম সিয়িং ইউ ফর আ লং টাইম নাও’ – প্ৰত্যুত্তরে সে খালি লাজুক হেসেছিল।

তারপর এলো সেই সময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, ‘আমাদের মিরাকল চাই’, চাপটা বাড়ার সাথে সাথে নজরের আড়ালে যেতে থাকলো ছোট ছোট ক্যামিও গুলো, শুরু হলো সমালোচনা। ভালো গেল না আইপিএল, বিশ্বকাপ এর দল এ থাকা নিয়ে হলো আবার একদফা সমালোচনা।

ঠিক কতটা ওপরে গেছিল এই চাপটা? বোঝার জন্য এটকু যথেষ্ট, সম্প্রতি এক ইন্সটা লাইভ এ এক দর্শকের ‘আপনার খেলা সেরা ম্যাচ কোনটা?’র উত্তরে যখন সতীর্থ ক্রুনাল বলেন, ‘নিদাহাস ট্রফি’, এক অব্যক্ত যন্ত্রনা ছাপ ওনার মুখে ফুটে ওঠে মিলিয়ে গেল, বললেন ‘উও ছোর!’

এ তো গেল সোশ্যাল মিডিয়া, আর বাস্তবে? বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল এ সেই একই মিরাকল এর আশায় পাঠিয়ে দেওয়ার হলো চার নম্বরে, একজন ক্যামিও স্পেশালিস্টকে বলা হলো টিকে থাকো হে, নইলে বুঝতেই পারছো।

টিকে ছিলেন তিনি, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর মতো ‘আপুন ভগবান হ্যায়’ না বলেও নতুন বল এ স্যাঁতস্যাতে পরিবেশে টিকে ছিলেন চার ওভার, কিছুটা হলেও উঠেছিল নতুন বলের পালিশ, সেই শেষ।

না, দীনেশরা কথা বলেন না, যেবার স্ত্রী সতীর্থের সাথে চলে গেল, সেবার ও চুপ ছিলেন, বহুবার নোংরা ব্যক্তিগত ট্রল এর মুখোমুখি হতে হলেও তিনি চুপ থেকেছেন, বলেননি একটাও কথা, করেননি কোনো শেমিং, ঠিক যেমনটা চুপ থেকেছেন রোহিত, বিরাটরা, ওনাদের কাছে দীনেশরা হলো পলিটিক্যাল ওয়ারের কল্যাটারাল ড্যামেজ, যেগুলো দিনের শেষে চাপা পড়ে যায় শত ফাইলের তলায়।

দীনেশ কার্তিক এর ক্যারিয়ারের একটা ট্র্যাজেডি, কিন্তু আমি নিশ্চিত যদি ওনাকে কোনোদিন জিজ্ঞেস করা হয় আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি কি, উত্তরটা বড় হৃদয়বিদারক হবে – ‘আমার জীবনের একমাত্র মিরাকল।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...