শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচের স্নায়ুজয়ী নায়ক

স্নায়ু-ক্ষয়ী সেসব ম্যাচেও কিছু কিছু ব্যাটসম্যান খেলে ফেলেন অমানবীয় সব ইনিংস। আজকে টেস্টের এমনই কিছু অমানবীয় ইনিংসের গল্প হবে, তবে শর্ত হল- সেসব ম্যাচে তাদের দল জিতেছে একেবারেই মার্জিনে- এক উইকেটের ব্যাবধানে!

‘নেইল বাইটিং ফিনিশ’- কথাটা নিশ্চয়ই সবার পরিচিত? ক্রিকেটপ্রেমী হলে চেনারই কথা। স্নায়ুর চূড়ান্ত পরীক্ষা নিয়ে মাঝে মাঝেই এমন সব ম্যাচ ক্রিকেটপ্রেমীদের দেখতে হয় যে সেসবে তারা আঙুলের নখ কামড়ানো শুরু করে। তবে স্নায়ুক্ষয়ী সেসব ম্যাচেও কিছু কিছু ব্যাটসম্যান খেলে ফেলেন অমানবীয় সব ইনিংস। আজকে টেস্টের এমনই কিছু অমানবীয় ইনিংসের গল্প হবে, তবে শর্ত হল- সেসব ম্যাচে তাদের দল জিতেছে একেবারেই মার্জিনে- এক উইকেটের ব্যাবধানে!

  • ইনজামাম উল হক (পাকিস্তান) ৫৮* বনাম অস্ট্রেলিয়া , করাচি- ১৯৯৪

টার্গেট ছিল ৩১৪ রানের, কিন্তু পাকিস্তান ১৮৪ তেই হারিয়ে ফেলল সাত টা উইকেট। করাচির পিচেও সেদিন বল ঘুরছিল বনবন করে। তবে অস্ট্রেলিয়া দলেও সমস্যা ছিল।  গ্লেন ম্যাকগ্রা আর টিম মে ইনজুরি বাধিয়ে বসলে শেন ওয়ার্নের কব্জির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার তেমন কিছু করার ছিল না।

আট নম্বরে নামা ইনজামাম দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, রশিদ লতিফও বেশ সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে শেন ওয়ার্ন পাঁচ উইকেট পূরণ করে লতিফকে ফেরানোর পর দেখা গেল পাকিস্তানের হাতে আছে মাত্র একটা উইকেট। আর সেখান থেকেই পাকিস্তানকে জয়ের বন্দরে ভেড়ানোর দায়িত্ব নেন ইনজামাম-উল-হক। নন স্ট্রাইক প্রান্তে থাকা মুশতাক আহমেদও নিজের উইকেট বাঁচিয়ে যাচ্ছিলেন, তবে বিপত্তি বাঁধিয়ে বসেন ইনজামাম নিজেই।

জয়ের প্রান্ত থেকে মাত্র তিন রান দূরে তিনি ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে বলের লাইন মিস করে ফেলেন, তবে ইয়ান হিলি সে স্ট্যাম্পিং করতে ব্যার্থ হন! আর শেষ অব্দি এক উইকেটের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে পাকিস্তান!

  • ব্রায়ান লারা (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) ১৫৩* বনাম অস্ট্রেলিয়া, বার্বাডোজ- ১৯৯৯

টার্গেট ছিল ৩০৮। অস্ট্রেলিয়ার বোলিং লাইন আপে ছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা- জেসন গিলেস্পি আর শেন ওয়ার্ন-স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলের মত দুই বোলিং জোড়া । ম্যাচটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য কতটা কঠিন হতে পারে তা এতেই বোঝা যাচ্ছে বেশ ভালভাবেই।

ব্রায়ান লারা যখন ক্রিজে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তখন ৭৮ রানেই ৩ উইকেট পড়ে গেছে। কিন্তু ১০৫ রানের মাথাতেই কার্ল হুপার প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলে দেখা যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের পাঁচ উইকেট নেই। সেখান থেকে কখনও জিমি অ্যাডামস লারাকে সঙ্গ দিয়েছেন, কখনও ক্রিজে থেকেছেন কার্টলি অ্যামব্রোস। একে একে সব উইকেট পড়ে গেলে উইকেটের অপর প্রান্তে থাকা চিরকালীন ব্যাটিংয়ে নড়বড়ে কোর্টনি ওয়ালশও সেদিন লারাকে সঙ্গ দিয়েছেন।

তবে শেষ অব্দি এক উইকেট হাতে রেখেই গিলেস্পির বলে দুর্দান্ত এক কাভার ড্রাইভ মেরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন লারা!

  • জিমি অ্যাডামস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) – ৪৮* বনাম পাকিস্তান, অ্যান্টিগা- ২০০০ 

ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে জয় নিয়ে ফেরা যেকোন সফরকারী দেশের জন্যই ছিল কঠিন ব্যাপার। সেই কঠিনেরে আপন করে নিতে পাকিস্তানের করতে হত একটাই কাজ- ২১৬ ডিফেন্ড করা। তা লারাবিহীন ব্যাটিং লাইনআপ যখন ১৪৪-৩ থেকে ১৯৭-৯ হয়ে যায় তখন জয়ের সুগন্ধই পাচ্ছিল পাকিস্তান।

কিন্তু লারা না থাকলে কি হবে, আগের বছর মাঠে থেকে লারার এক উইকেটের জয় নিয়ে ফেরা দেখেছিলেন জিমি অ্যাডামস। এবার তাই দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন তিনি। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের যখন মাত্র ১৬ লাগবে, তখন আম্পায়ার ডগ কাউয়ি অ্যাডামসের ইনসাইড এজের আবেদন নামঞ্জুর করে দেন। পাকিস্তানের দাবি অনুযায়ী অবশ্য এটা আউট ছিল, কিন্তু সে যুগে তো আর রিভিউ ছিল না।

তবে এতে করে জিমির সাহসের ভাগ কোনভাবেই বাটোয়ারা হবে না। পাক্কা সাড়ে পাঁচ ঘন্টার বেশি ক্রিজে থেকে তিনিন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে এক উইকেটের জয় উপহার দিয়েছিলেন!

  • ইনজামাম উল হক (পাকিস্তান) – ১৩৮* বনাম বাংলাদেশ, মুলতান-২০০৩

এ ম্যাচ অবশ্য রশিদ লতিফের চাক্ষুষ চোট্টামির কারণে বিতর্কিত হয়েই আছে। তবে আরেকটু হলেই সে ম্যাচ জিতে যেত টেস্টে নবাগত বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসের কথাই ধরা যাক, খালেদ মাহমুদ আর মোহাম্মদ রফিক দুজনে মিলে ৯ উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইন আপকে তো একটা বড় পরীক্ষার মধ্যেই ফেলেছিলেন।

দ্বিতীয় ইনিংসেও ভাল শুরু পেয়ে ১৩২ রানের মাথায় ছয় উইকেট পড়ে যায় পাকিস্তানের। চতুর্থ দিন সকালে সাকলাইন মুস্তাক ফিরে গেলে পাকিস্তানের জন্য আরো কঠিন হয়ে যায় কাজটা। তবে এরপরই নাটকীয় ভাবে ম্যাচের রঙ পাল্টাতে থাকে। তবে সে রঙ পাকিস্তানের দিকে যেতে মোহাম্মদ রফিককে তারা চাইলে একটা ধন্যবাদ দিতেই পারে। ১০ নম্বরে নামা উমর গুলকে যে বাগে পেয়েও মানকাড আউট করেননি রফিক।

আর শেষ অব্দি ইনজামাম এক উইকেটের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে!

  • ভিভিএস লক্ষণ৭৩* বনাম অস্ট্রেলিয়া, মোহালি- ২০১০

মিচেল জনসন থাকলেও ব্রেট লি আর গিলেস্পিবিহীন পেস অ্যাটাক নিয়ে মাঠে নামা অস্ট্রেলিয়ার বোলিং অ্যাটাক মোটেই ধ্বংসাত্মক ছিল না। ভারতের সামনে টার্গেটও ছিল মাত্র ২১৬ রানের। মোটামুটি সহজ জয় বলতে যা বোঝায় তাই দেখছিল ভারত।

তবে ভারতের কাজ কঠিন হয়ে যায় যখন মাত্র ১২৪ রানের মাথায় ৮ উইকেট পড়ে যায়। ভিভিএস লক্ষণ সে ম্যাচে নেমেছিলেন সাত নম্বরে। তবে ইনজুরিতে লক্ষণের তখন তথৈবচ অবস্থা, এমনই হাল যে দৌড়ানোর জন্যে অব্দি রানার লাগছিল। এখানে একটু ঈশান্ত শর্মাকে মনে না করলে বড্ড খারাপ হয়ে যাবে। এই অংশটুকুতে হয়তো লক্ষণের হিরোইকস লেখা হচ্ছে, তবে ১০ এ নামা ঈশান্তের ৯২ বলে ৩১ রানের গুরুত্বও কিন্তু অসীম!

যা হোক, জয় থেকে মাত্র ১১ রান দূরে ঈশান্ত শর্মা আউট হয়ে যান। প্রজ্ঞান ওঝাকে সাথে নিয়ে তখন আর একটুখানি পথই পাড়ি দিতে হত লক্ষণকে। কিন্তু লক্ষণের তখন মেজাজ বিগড়ে গেল। চিরকালীন শান্ত লক্ষণ হঠাৎ অহেতুক আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন। তা এতে অবশ্য ভারতের ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এক উইকেটের ভারতের জয়টা আক্ষরিক অর্থই নখ কামড়ানোর মতই ছিল!

 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...