নীলের সত্যিকারের বেদনাতুর সারমর্ম

সামান্য ধরিত্রীর বুকে গ্লাভস হাতে আঁকিবুঁকি আঁকা অসামান্য শিল্পী, কিংবদন্তি। বিশুদ্ধ নীলের বাহক। তাঁর ছোঁয়ায় নীলও হয়ে উঠেছে আনন্দের রঙ। ‘আজ্জুরি’ শব্দের সার্থক প্রয়োগে বুফনের জন্য ইতালির রাস্তায় রাস্তায় কিংবা ফুটবল মাঠে গোলরক্ষকরা একদিন মাতবেন নীলোৎসবে, কয়েকটি নীলপদ্ম হাতে। সেদিন পুষে যাবে তার বিদায়ে তৈরি হওয়া শূন্যতা, রঙের খেলায় আড়াল হবে নীলের সত্যিকারের বেদনাতুর সারমর্ম।

ইতালির একটি প্রজন্মের কাছে ফুটবলের পজিশনগুলির নাম এমন- স্ট্রাইকার, মিডফিল্ডার, ডিফেন্ডার, বুফন! বুফন মানে জিয়ানলুইজি বুফন, গোলকিপার। এমনটা কেউ ভেবে থাকলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। জন্মের পর থেকেই তেকাঠিতে দেখে আসছেন বুফনকে।

স্পেনের ইকার ক্যাসিয়াস তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। দুজনই সর্বকালের সেরাদের কাতারে। অথচ, ক্যাসিয়াস তার সেরা সময় হারিয়েছেন যেখানে বুফন রঙিন। জুভেন্তাস দলের জার্সিটা সাদা কিন্তু বুফনেরটা সবুজ, কখনো নীল, কখনো কালো। ইতালির ডিফেন্স বিশ্বখ্যাত, বুফন সে খ্যাতির এক চরিত্র। হয়ত সবচেয়ে উজ্জ্বল চরিত্র। তার জার্সির রঙের মতো চিরসবুজ। আবার নীল রঙের শার্টে বিপক্ষের গোল স্বপ্ন ভেঙ্গে দেন! বুফন বিচিত্র, বুফন অনন্য।

যন্ত্রেরও অন্ত আছে। নিঃশেষের কষ্ট না হলেও ভাগাড়ে পতিত হবার লজ্জা আছে। আমরা যন্ত্রের ভাষা বুঝি না, বুঝি না তার যন্ত্রণা। আমাদের মতো একজন মানুষ, নাম ‘শ্রী জগদীশ চন্দ্র বসু’ তিনি বৃক্ষের ভাষা বুঝতেন, পড়তে পারতেন তাদের ভেতরটাকে। ‘জিয়ানলুইজি বুফন’ নামক বৃক্ষের ভেতরটা পড়তে আমাদের বসুজিকে দরকার নেই। সে প্রশস্থ বটবৃক্ষ, তারও আগে মানুষ। আমরা তাই পড়তে পারি তাঁকে।

মানুষেরই মনের ভাষা পড়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্যতম দুষ্কর কার্য। আতশি কাচ আবার পরিষ্কার, ধবধবে, সুস্পষ্ট। বুফনের ভেতরটাও তেমনই। তাকে পড়তে তাই অসুবিধা হয় না। যা হয় তা ‘কষ্ট’। যা বেরোয় তা ‘দীর্ঘশ্বাস’। জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েছেন। তার মানে থেমে গেলেন? থেমেই গেলেন? না।

থামেননি। তিনি থামতে পারেন না। না। থেমেছেন। মহাজাগতিক নিয়ম মেনে। থামার বাধ্যবাধকতা আছে বলে। দোটানায় পড়লেন? বুফনের দোটানা আরো বেশি যা স্রেফ প্রতীকী অর্থেই দোটানা। কান্নারা তাঁকে অবিরাম ডাকছে নিজেদের দলে, কান্নার কারণের অভাব নেই। বুফনের এই দোটানার টানাটানি তাই চলছে একটানা!

অভিনয়ের ক্ষেত্রে থিয়েটার আর্টিস্টদের আলাদা একটা চাহিদা থাকে। থাকে কেননা তারা থিয়েটার থেকেই অভিনয়ের অ অা ক খ শিখে আসেন, মুখস্ত করেন ধারাপাতের সবকটা পাতা। তাদের মুখস্ত পন্ডিত ভাবলে ভুল হবে, মস্ত ভুল। অভিনয়ের যাবতীয় কলাকৌশল প্রদর্শনে হয়ে ওঠেন অনন্য, চরিত্রেই পান পরিচিতি।

জিয়ানলুইজি বুফনও তেমন একজন। ফুটবলে থিয়েটারটা তার বয়সভিত্তিক দল। অনুর্ধ্ব-১৬ থেকে অনুর্ধ্ব-২৩; ইতালির সকল বয়সভিত্তিক দলের প্লেয়ার লিস্টে উঠিয়েছেন নিজের নাম। দেশের হাল ধরার আগে পোক্ত করেছেন নিজের হাত, চওড়া করেছেন কাঁধকে।

লেভ ইয়াসিন। ফুটবল সম্পর্কে যৎসামান্য জ্ঞান আছে কিন্তু নামটা শুনেনি এমন কেউ নেই। বিশেষত বর্তমান প্রজন্ম। ইন্টারনেট, ইউটিউবের কল্যাণে মাকড়সা ডাকনামের রাশান গোলরক্ষক ইয়াসিনের ভিডিও’ও দেখা হয়ে গেছে চলতি পৃথিবীর উঠতি বাসিন্দাদের। কোথাও তবু শূন্যতা থেকে যায়, ঠিকই পুড়তে হয় অপূর্ণতায়।

ভিডিওতে দেখা দু’চার মিনিটের সাদাকালো শো চোখের তৃষ্ণা মেটায়, মনের তৃপ্তি নয়। অথচ এই প্রজন্ম নিজেদের মনকে তৃপ্ত করার খুব ভালো সুযোগ পেয়েছে, পেয়ে আসছে। একজন গোলরক্ষক আছেন যিনি গোলরক্ষকের সংজ্ঞা পাল্টে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। যিনি ফুটবল ছাড়েন চোখের জলে ভিজতে যেয়েও না ভিজে ! তাতে টিভিসেটে আবদ্ধ শিশুচোখসমগ্রের আগ্রহ হারাবার আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে!

তাঁর বিদায়ে তৈরি হয় প্রবল বিষাদ-গার, তৈরি হয় শোকগাঁথা, তৈরি হয় কারো কারো স্তব্ধতার বিষে বিষাক্ত হবার কাহিনী। তিনি ‘জিজি’। চাপাকান্নাকে সঙ্গী করে অবসরে যাওয়া এক নিভৃতচারী মহানায়ক। সতীর্থ পিরলো একবার বলেছিল ফুটবলে তাঁর কোন দুর্বলতা নেই। জাতীয় দল ছাড়ার বেলায় মিথ্যেই প্রমাণিত হলেন পিরলো! ফুটবলই বুফনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। জানি, এমন মিথ্যাচারে পিরলোও বেজার নন। সার্থকতার বীজ হৃদয়ে নিহিত।

বুফনের পেশাদারিত্ব কিংবা অর্জন নিয়ে চর্চা করতে যাওয়া নিছক সময়ক্ষেপণ। কিংবদন্তিকে নিয়ে সময়ক্ষেপণেও সুখ। তারা কতটা সুউচ্চে পৌঁছলে তা সম্ভব ভাবা যায় না। নিজেকে নিয়ে কাউকে ভাবার সুযোগটাই কখনো দেননি বুফন। যা দিয়েছেন তা অবাক হবার সুযোগ। ইতালির সাবেক গোলরক্ষক ও কোচ দিনো জফ বলেই দিয়েছেন, ‘এমন ব্যক্তিত্ত্ব এবং প্রতিভাসম্পন্ন অভিষেক আমি কারো দেখিনি।’

সতীর্থরা এমনি এমনি ‘গোলরক্ষকদের ম্যারাডোনা’ আখ্যা দেননি। টাকার কাছে নাকি আবেগ বিকোয় ? সেসব সস্তা আবেগ। বুফন ছেড়ে যাননি জুভেন্তাসকে। উত্থান পতন জীবনের অংশ, যেমনটা ফুটবল। তাই কেলেঙ্কারির বোঝায় সিরি বি’তে অবনমিত হয়েও আঁকড়ে ছিলেন প্রাণের ক্লাব। বায়ার্ণের সাবেক ম্যানেজার ইয়াপ হেইঙ্কেস বলেছন একদম যথার্থ! ‘জুভেন্তাসের সিরি বি’তে অবনমনের পর বুফন দেখিয়েছে টিমের প্রতি তার দায়িত্বশীলতা এবং নমনীয়তা। এটা সত্যিই বিশাল কিছু। বুফন আসলেই ইতিহাসের দুর্দান্ত একটা অংশ’।

ডিস্কাস থ্রোয়ার মা আর ভারোত্তোলক বাবার ঘরে ১৯৭৮ এর ২৮ জানুয়ারি জন্ম নেয়া সন্তানের ক্রীড়াপ্রেম রক্তকণিকাজুড়ে। দুইবোন ইতালির ভলিবল দলের খেলোয়াড়। রেকর্ডের রাজপুত্র বললেও ভুল হবে না। ইতালি আর তুরিনের বুড়ি জুভেন্তাসের ফুটবল ইতিহাসের অসংখ্য পাতায় তাঁর নাম। সবচেয়ে বেশি ম্যাচে (৭৯) অধিনায়কত্ব, গ্লাভসজোড়াকে সঙ্গী করে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ (১৭৫) মাঠে নামা।

জুভদের হয়ে পাঁচ শতাধিক ম্যাচে প্রতিনিধিত্ব, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেও সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ তাঁরই। ইতালিরই আরেক ক্লাব পারমা’র যুবদলে শুরু, জুভেন্তাস হয়ে প্যারিস সেইন্ট জার্মেই শেষের নাম নেই ২০০৬ সালে বিশ্বকাপে চুমু খেয়ে সোনার গোলকের মাথায় নিজের ঠোঁট যুগলের রেখা এঁকে দেয়া বুফনের।

বুফন, জিয়ানলুইজি বুফন। মুগ্ধতার ফেরিওয়ালা, তেকাঠির ভিঞ্চি। প্রতিদ্বন্দ্বী ইকার ক্যাসিয়াস বলেছেন যথার্থই, ‘বড় হবার সময়টায় চাইতাম তার মতো হতে, এরপর তো দুজনে একই সময়ে অনেকদিন খেলেছি। দুজনেই একে অন্যের বিপক্ষে খেলেছি। জিতেছি, হেরেছি। আমার মনে হয় না ইতালিয়ান ফুটবলে আরেকজন বুফন কখনোই আসবে।’

সামান্য ধরিত্রীর বুকে গ্লাভস হাতে আঁকিবুঁকি আঁকা অসামান্য শিল্পী, কিংবদন্তি। বিশুদ্ধ নীলের বাহক। তাঁর ছোঁয়ায় নীলও হয়ে উঠেছে আনন্দের রঙ। ‘আজ্জুরি’ শব্দের সার্থক প্রয়োগে বুফনের জন্য ইতালির রাস্তায় রাস্তায় কিংবা ফুটবল মাঠে গোলরক্ষকরা একদিন মাতবেন নীলোৎসবে, কয়েকটি নীলপদ্ম হাতে। সেদিন পুষে যাবে তার বিদায়ে তৈরি হওয়া শূন্যতা, রঙের খেলায় আড়াল হবে নীলের সত্যিকারের বেদনাতুর সারমর্ম।

২০১২-‘১৫ পর্যন্ত টানা চার বছর মাদ্রিদের সেরা ডিফেন্ডার হওয়া তারকার ডেডিকেশন কতখানি তা কে না জানে। রামোসকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কি আপনার দলের সেরা খেলোয়াড়? তখনো রিয়ালে আসেনি সে। তার জবাবটাই প্রমাণ দেয় তাকে, জানান দেয় তার স্পৃহাকে, ‘আমি কখনোই সেরা ছিলাম না। তবে আলাদা ছিলাম। আমার দৃঢ়তা, আমার স্বপ্নই আমাকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করেছে।’

২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার রামোস এবং সাংবাদিক-উপস্থাপিকা প্রেমিকা পিলার রুবিও নিজেদের সম্পর্কের কথা জনসমুক্ষে প্রকাশ করেন। ২০১৪ এর মে মাসে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান সার্জিও, ২০১৮ এর মার্চের শেষ সপ্তাহে পৃথিবীর আলো দেখে তৃতীয়জন, আলেজান্দ্রো। মাঝে ২০১৫ সালের নভেম্বরে রামোস পরিবারে যুক্ত হন মার্কো, দ্বিতীয় সন্তান। বুলফাইটের দারুণ ভক্ত রামোস নিজের এলাকার জনপ্রিয় খেলাটির একজন নিয়মিত দর্শকও।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...