হিক-হিগুয়েন বনাম আতাপাত্তু: মূদ্রার এপিঠ/ওপিঠ

তিনটা ফাইনালেই হিগুয়েনের কিছু শিশুসুলভ ভুল ছিল। একজন স্ট্রাইকার স্বভাবতই মিস করবেন, কিন্তু প্রায় প্রতিটি ফাইনালে এমন হাস্যকর মিস যখন একজন খেলোয়াড়ই করেন তখন সেটা মেনে নেওয়া সমর্থকদের জন্য কষ্টকর। এছাড়া চিলির বিপক্ষে ১৫ ফাইনালে টাইব্রেকারে তিনি পেনাল্টি মিস করেছেন।বিগ ম্যাচ জয়ের প্রথম ফ্যাক্টই হচ্ছে ১০% সুযোগ পেলেও সেটাকে কাজে লাগানো। আর হিগু প্রায় ৮০% সম্ভাবনাকেও নস্ট করেছেন। অবশ্য জার্মানির বিপক্ষে বিশ্বকাপ ফাইনালে একটা গোল করেছিলেন যেটা কিনা অফসাইডের জন্য বাতিল হয়ে যায়।

১.

গ্রায়েম হিকের নাম শুনেছেন? ভদ্রলোক একজন টেস্ট ক্রিকেটার ছিলেন।

ক্রিকেটের কোন বিষয় এখানে নেই, বিষয়টা একজন ক্রিকেটারের, সর্বোপরি একজন মানুষের। এত চিন্তা ভাবনা না করে লেখাটা পড়ে ফেললেই হয়তো বুঝতে পারবেন যে এর সাথে হিকের সম্পর্কটা কি।

মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে হিকের ক্রিকেটিয় কীর্তির কিছু বিষয় শুনে নেওয়া যাক। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এই পর্যন্ত মাত্র ২৫ জন ব্যাটসম্যান শতরানের সেঞ্চুরি করতে পেরেছেন। গ্রায়েম হিক তাঁদের মধ্যে একজন। তার চেয়ে বেশি সেঞ্চুরি করেছেন মাত্র ৭ জন, ১৩৬ টি সেঞ্চুরি নিয়ে তার অবস্থান ৮ নম্বরে। তার ইনিংস সংখ্যা ৮৭১ টি, অর্থ্যাৎ প্রতি ৬.৪০ ইনিংসে তিনি একটা সেঞ্চুরি পেয়েছেন।

কিন্তু হিকের টেস্ট পারফর্মেন্স কি জানেন? ছয় টি সেঞ্চুরি সহ মাত্র ৩১.৩২ গড়ে মাত্র ৩৩৮৩ রান। প্রতি ১৯ ইনিংসে ১ টি সেঞ্চুরি। প্রথম শ্রেণীর তুলনায় খুবই বাজে, গড়ের পার্থক্যও ২০.৯১।

এই ভদ্রলোক শুরুতে ছিলেন জিম্বাবুয়ের খেলোয়াড়। কিন্তু ১৯৮৫ সালের এক ইংল্যন্ড সফর তার ক্যারিয়ারের হিসেবটাকে পালটে দিল। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি আর গ্ল্যামারগণের বিপক্ষে ১৯ বছরের এই তরুন খেললেন ২৩২ আর ১৯২ রানের দুটো ঝকঝকে ইনিংস। তার এই পারফর্মেন্স তাকে সুযোগ পাইয়ে দিল কাউন্টি ক্রিকেটে খেলার। তখনো তিনি জিম্বাবুয়ে ছাড়ার কথা ভাবেননি।

এরই মাঝে জিম্বাবুয়ে দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া ইয়াং একাদশের বিপক্ষে দুটো ম্যাচে দুটো সেঞ্চুরি করেন। তারপর কাউন্টি ক্রিকেটে পরের মৌসুমে করেন ছয় টি সেঞ্চুরি। ইংল্যান্ড তো আগে থেকেই তৈরী ছিল তাকে দলে নেওয়ার জন্য। হিকও সেই ডাকে সাড়া দিলেন। কিন্তু আইনের মারপ্যাচের কারণে রানের প্লাবন থাকা সত্বেও সুযোগ পেলেন না ইংল্যন্ড দলে। তখন নিয়ম ছিল বাইরের কোন খেলোয়াড় নূন্যতম ৭ বছর কাউন্টি ক্রিকেট খেললে ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব পাবে। হিকের জন্য স্পেশাল ভাবে সেটা কমিয়ে ৫ বছরে নামিয়ে নিয়ে আনা হলো।

ইংল্যান্ড দল তখন একজন উদ্ধারকর্তা পাওয়ার খুশিতে আত্মহারা। কিন্তু অভিষেকটা হিকের জন্য দু:স্বপ্নেরই নামান্তর হলো। উইন্ডিজের বিপক্ষে ৪ টেস্ট খেলে ১০.৭১ গড়ে করলেন মাত্র ৭৫ রান।

ইংল্যান্ড দলে আসা যাওয়ার মাঝে প্রথম সেঞ্চুরি করলেন ভারতের বিপক্ষে। ইংল্যান্ড আবারও আশাবাদী হয়ে উঠলো। টেস্ট সেঞ্চুরি পেয়েছে ২২ তম ইনিংসে, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি পেতে হিকের লেগেছিল ২৬ ইনিংস। কিন্তু কিসের কি? বার বার আসা যাওয়ার মাঝে শেষ হয়ে গেল হিকের ক্যারিয়ারই।

কেন হিক ব্যর্থ হলেন টেস্ট ক্রিকেটে? অথচ একই বোলারদের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে পিটিয়ে সেঞ্চুরী করছেন। এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে সুন্দর উত্তর দিয়েছেন হিকেরই স্বদেশি হটন, ‘হিক অসম্ভব প্রতিভাবান, তার ক্রিকেটিও সামর্থ্য নিয়েও কোন প্রশ্ন নেই। সমস্যাটা তার মনে। ৫৭ টি ফাস্ট ক্লাস সেঞ্চুরি নিয়ে যখন তিনি টেস্ট খেলতে নেমেছনে তখন তার উপর সীমাহীন চাপ।এই চাপেই ভেঙে পড়েছেন হিক। হিকের যদি ভিভের মতো মনের জোড় থাকতো তাহলে কি হতো সেটা ভাবাই যায় না।’

আমরা আর যদি কিন্তুর হিসেবে না যাই, হিসেবটা সহজ করে ফেলি। চাপেই হিক তার স্বভাব সুলভ খেলাটা খেলতে পারেনি।

অনেকক্ষণ ধরে ক্রিকেটের কথা শুনলেন। এবার একটু ফুটবলে আসি।

২.

হিগুয়েন – অনেক আর্জেন্টিনার সমর্থকদের চোখের বালি।

ক্লাব পারফর্মেন্সে হিগুয়েন তার প্রজন্মের সেরা স্ট্রাইকারদের সংক্ষিপ্ত তালিকাতেই থাকবে। কিন্তু আন্তর্জাতিকে তার পারফর্মেন্স প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও আর্জেন্টিনার হয়ে বড় টুর্নামেন্ট গুলোতে হিগুয়েনের পারফর্মেন্স খুব খারাপ বলা যাবে না।

২০১০ বিশ্বকাপে হিগুয়েনের গোল চার টি, টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। (অবশ্য ৫ টি করে গোল করেছেন ৪ জন।) এর মাঝে দ্বিতীয় পর্বে করেছিলেন মেক্সিকোর বিপক্ষে ১ টি।

২০১১ কোপাতে হিগুয়েনের গোল ১ টি। সেটাও কোয়ার্টারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে।

২০১৪ বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে দলের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা, ৯ টি গোল করে মেসির (১০ টি) ঠিক পেছনেই ছিলেন।

২০১৪ বিশ্বকাপটা হিগুয়েনের বাজে গিয়েছে মাত্র ১ টা গোল করতে পেরেছিলেন। তবে সেই গোলটা বেলজিয়ামের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের মতো ম্যাচে। সেই ম্যাচে ১-০ গোলে জিতেই পরের পর্বে যায় আর্জেন্টিনা।

কোপা আমেরিকা ২০১৫ তে হিগুয়েনের গোল ২ টি। টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ। আর্জেন্টিনাতে তার চেয়ে বেশি গোল করেছিলেন শুধুমাত্র আগুয়েরা, ৩ টি। নক আউটে হিগুয়েনের গোল ১ টি।

কোপা আমেরিকা ২০১৬ তে হিগুয়েনের গোল ৪ টি, টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ, আর্জেন্টিনার পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। নক আউটে হিগুয়েনের গোল ৪ টি, মেসির ২ টি।

বড় টুর্নামেন্ট গুলোতে হিগুয়েনের গোল ১২ টি। বড় টুর্নামেন্টে তার অভিষেকের পর তার চেয়ে বেশি গোল সম্ভবত আর কোন আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় করতে পারে নি। এছাড়া এই সময়ে নক আউট পর্বেও তার গোল ৮ টি, যা কিনা আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের মাঝে সর্বোচ্চ।

এত কিছুর পরেও আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা হিগুয়েনকে সহ্য করতে পারে না কেন?

না পারাটা একেবারে অযৌক্তিক নয়। কারণ তিনটা ফাইনালেই হিগুয়েনের কিছু শিশুসুলভ ভুল ছিল। একজন স্ট্রাইকার স্বভাবতই মিস করবেন, কিন্তু প্রায় প্রতিটি ফাইনালে এমন হাস্যকর মিস যখন একজন খেলোয়াড়ই করেন তখন সেটা মেনে নেওয়া সমর্থকদের জন্য কষ্টকর। এছাড়া চিলির বিপক্ষে ১৫ ফাইনালে টাইব্রেকারে তিনি পেনাল্টি মিস করেছেন।

বিগ ম্যাচ জয়ের প্রথম ফ্যাক্টই হচ্ছে ১০% সুযোগ পেলেও সেটাকে কাজে লাগানো। আর হিগু প্রায় ৮০% সম্ভাবনাকেও নস্ট করেছেন। অবশ্য জার্মানির বিপক্ষে বিশ্বকাপ ফাইনালে একটা গোল করেছিলেন যেটা কিনা অফসাইডের জন্য বাতিল হয়ে যায়।

প্রশ্ন হচ্ছে এত দূর্দান্ত পারফর্মেন্সের পরেও বিগ ম্যাচে কেন ফ্লপ থাকেন? সম্ভবত সমস্যাটা তার মানসিক। তার মিস গুলো ভালো ভাবে লক্ষ্য করে দেখুন। কোপা আমেরিকার টাইব্রেকারের মিসটা আবার দেখলাম, হাস্যকর।

এর চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে আগের ব্যর্থতাগুলো সিনবাদের ভুতের মতো তার ঘাড়ে চেপে বসে আছে। বিগ ম্যাচে হিগুয়েন যখনই আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেছে, তখনই অতীতের ব্যর্থতাগুলো তাঁকে ঝামেলায় ফেলেছে।

এই চাপটা হিগুয়েন আদৌ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে নয় ম্যাচে মাত্র এক গোল করার পরও তাঁকে মূল দলে রাখা হয়েছিল স্রেফ সামর্থ্যের কথা মাথায় রেখে। কিন্তু, গ্রুপ পর্বে যে তিনটা ম্যাচ তিনি খেলেন – কোনোটাতেই গোল করতে পারেননি। আর শেষ ষোলোর যে ম্যাচটা খেলে আর্জেন্টিনা বাদ পড়ে – সেখানে তিনি মাঠেই নামেননি।

৩.

প্রথম পরিচ্ছেদে তো প্রেশারের কাছে পরাজিত একজন মানুষের গল্প শুনলেন। এখন প্রেশারকে জয় করা একজন মানুষের গল্পও শোনা যাক।

ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের জন্য সর্বোচ্চ সফলতার একটা যদি সেঞ্চুরি হয়, তাহলে ব্যার্থতার মাঝে একটা হচ্ছে শূন্য রানে আউট হওয়া। কোন ব্যটসম্যান যদি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম ইনিংসেই শূন্য রানে আউট হয় তাহলে তার আত্মবিশ্বাসে একটু বাধা লাগারই কথা। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে যেহেতু ইনিংস দুটো কাজেই কোন ব্যাটসম্যান এক ইনিংসে শূন্য রানে আউট হলেও পরের ইনিংসে ভালো করার জন্য আরেকটা সুযোগ পেতে পারে।

কিন্তু কোন ব্যাটসম্যান যদি দুই ইনিংসেই শূন্য রানে আউট হয় তাহলে তার আত্মবিশ্বাস তলানীতে নেমে যাওয়ার কথা। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এই পর্যন্ত ৪২ জন ব্যাটসম্যান এই দূর্ভাগ্যের সম্মুখীন হয়েছে।

এই লেখায় যে ব্যাটসম্যানের কথা বলা হচ্ছে তার আত্মবিশ্বাস কোথায় পৌছেছিল সেটা জানা যায় নি তবে নির্বাচকদের তার প্রতি বিশ্বাস একেবারেই কমে গিয়েছিল। একারণেই প্রথম টেস্টের পর দ্বিতীয় সুযোগ পান ২০ মাস পর।

এবার আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি করলেন, দুই ইনিংসে আউট হলেন যথাক্রমে ০ আর ১ রান করে। ফলশ্রুতিতে আবার দল থেকে বাদ। তৃতীয় সুযোগ পেলেন আবার ১৮ মাস পর। সুযোগটা কোথায় কাজে লাগাবেন তা না করে আবার দুই ইনিংসেই শূন্য।

চতুর্থ টেস্টে সুযোগ পেলেন ৩ বছর পর। তখন তার রান ৬ ইনিংসে ০.১৭ গড়ে ১ রান। না এবার আর আগের বারের মতো ব্যর্থ হননি।

কালক্রমে দলে নিজের জায়গা পাকা করেছেন। ওয়ানডে আর টেস্টে শতরান করেছেন যথাক্রমে ১১ টি আর ১৬ টি করে। টেস্টে ৬ টি ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংসও আছে তার। অবসর নেওয়ার আগে টেস্টে ৩৯.০২ গড়ে ৫৫০৪ রান আর ওয়ানডেতে ৩৭.৫৭ গড়ে ৮৫২৯ রানও করে ফেলেছেন।

অসম্ভব মনোবলের অধিকারী এই ক্রিকেটারের নাম মারভান আতাপাত্তু। ২০১৮ বিশ্বকাপে অন্তত কিছু একটা করতে পারলেই চাইলেই হিগুয়েনকে মারভান আতাপাত্তুর পর্যায়ে রাখা যেত। কিন্তু, তিনি হেঁটেছেন গ্রায়েম হিকের পথে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...