রঙিন সব্যসাচীর মঞ্চ

হাউস অফ লর্ডসের সদস্য, ডারহাম কাউন্টির চেয়ারম্যান বোথাম এখন থাকেন আলমেরিয়া শহরে, সম্পূর্ণভাবে গলফে মজে। খেলার মাঠে নিজেকে টেনশনমুক্ত করে বিন্দাস ক্রিকেট খেলা তার মত করে খুব কম ক্রিকেটারই খেলেছেন। সেই সময়কার চার উজ্জ্বল অলরাউন্ডারের (ইমরান-কপিল-বোথাম ও হ্যাডলি) মধ্যে অবিসংবাদিভাবে রঙিনতম অলরাউন্ডারের নাম ছিল ইয়ান টেরেন্স বোথাম।

১৯৮২ সালের ছয় জানুয়ারি। ছয় টেস্টের ভারত-ইংল্যান্ড ১৯৮১-৮২ সিরিজের চতুর্থ টেস্টের শেষ দিন, ইডেন গার্ডেন্সে। মাঠে গেছি খেলা দেখতে। শেষ দিনে দ্বিতীয় ইনিংসে ১০ উইকেট হাতে পাক্কা ৩০০ রান করলেই জিতে যাবে ভারত আর ২-০ এগিয়ে যাবে সিরিজে। প্রথম টেস্টে মুম্বাইতে ১৩৮ রানে জিতেছে ভারত, পরের ব্যাঙ্গালুরুতে দ্বিতীয় টেস্ট আর দিল্লীতে তৃতীয় টেস্ট ছিল অমীমাংসিত। শেষ দিনের ইডেনে তাই বেশ জমজমাট একটা শেষ হবার আশা করছিল সবাই।

কিন্তু খেলা শুরুর মুখেই সকালের কুয়াশা আরো গাঢ় হয়ে উঠে খেলার শুরুকে বিলম্বিত করে দেয়, প্রায় ঘণ্টাখানেক। তার পরের এক ঘন্টাতেই ভারত এটা পরিষ্কার করে দেয় যে, তারা রান তাড়া সেভাবে করবে না, বরং সেফ খেলবে সারা দিন। কৃষমার শ্রীকান্তর মত মারমুখী ব্যাটসম্যানের সেটা ছিল প্রথম সিরিজ এবং তিনি ৫৭ বলে ২৫ করে ফিরে আসেন প্যাভিলিয়নে, ভারত তখন ৪৮/১। তারা ১১৭/২ হয়ে যায় দিলীপ বেঙ্গসরকারের ৯৩ বলে ৩২ রানে আউট হওয়ার ফলে।

১২ বল খেলেও খাতা খুলতে ব্যর্থ হয়ে গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ যখন আউট হয়ে ফিরে আসেন, ভারত তখন ১২০/৩, চায়ের বিশ্রাম তখনো অনেকটাই দূরে। অন্যদিকে দাঁড়িয়ে এই তিনজনকে আউট হতে দেখা অচঞ্চল সুনীল গাভাস্কার তখন সদ্য হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছেন।

দুই পেসার, দুই স্পিনার চতুষ্টয় উইলিস-বোথাম-অ্যামবুরি-আন্ডারউডই বরং তখন শেষ একটা আঘাত হানার জন্য তৈরী, সিরিজ ১-১ করার লক্ষ্যে। ক্রিজে এলেন সন্দীপ পাতিল। এক-দু ওভার কোনরকমে সামলালেন নড়বড়ে পাতিল, মাঝমাঠে বারবার এসে তাকে তখন বোঝাচ্ছেন সানি, সিনিয়র এবং দাঁড়িয়ে যাওয়া পার্টনার হিসেবে।

পরের ওভারের প্রথম বলটাই ফুল টস এবং সপাটে চালালেন পাতিল। ঠিকমত ব্যাটে বলে না হওয়ায় সোজা উঁচুতে উঠে গেল বল এবং একটু সামনের দিকে দৌড়ে ক্যাচটি তালুবন্দী করলেন বোলার নিজেই।হতবাক পাতিল সবে স্টার্ট নিচ্ছেন প্যাভিলিয়নের গন্তব্যে। মাঠে শ্মশানের নীরবতার মধ্যেই দেখা গেল বলটা নিয়ে আম্পায়ারের হাতে তুলে দিচ্ছেন বোলার আর প্রবল হাসছেন।

আম্পায়ারও তাঁর প্রতিবর্তী ক্রিয়াতে পাতিলকে ক্রিজে ফেরালেন। সানি হতচকিত রানারের জায়গায় দাঁড়িয়ে। হতভম্ব পাতিল ক্রিজে ফেরার পরে তাকে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিলেন আম্পায়ার আর বোলার। ওই বলটা করা হয়েছিল একটা ক্যাম্বিসের বল দিয়ে, কৌতুক করে। আসল বলটা পকেটে পুরে ঐ কাণ্ডটি ঘটিয়েছিলেন ওই বোলার।

তারপর আর খেলায় কেউ রিস্ক নেয়নি। ২৫০ বল খেলে ৮৩ তে অপরাজিত সানি আর ৯৯ বল খেলে ১৭ রানে অপরাজিত পাতিল যখন দিনের খেলা শেষ করেন, ভারত তখন ১৭০/৩। ম্যাচ ড্র হয়, মাঠে মারা যায় দর্শকদের প্রত্যাশা।

ঐ চাপের সময়ে এই হালকা চাল, শুধু ঐ একজন বোলারই পারতেন তখন ক্রিকেট দুনিয়ায়। তার নাম ইয়ান টেরেন্স বোথাম। এই ‘বিন্দাস’ অ্যাটিটিউড লালন করতে করতেই তিনি ১৫ বছরে (১৯৭৭-১৯৯২) খেলে ফেলেন ১০২টি টেস্টম্যাচ আর ১৬ বছরে (১৯৭৬-১৯৯২) ১১৬টি ওয়ানডে ম্যাচ। টেস্টে তার রান ছিল ৫২০০, একটি ডাবল সেঞ্চুরি, ১৪ টি সেঞ্চুরি আর ২২ টি হাফ সেঞ্চুরি। গড় ছিল ৩৫-এর কাছাকাছি।

ওয়ানডেতে তার রান ছিল ২১১৩। টেস্ট উইকেট ছিল ৩৮৩, সেরা ম্যাচ বোলিং ১৩/১০৬, সেরা ইনিংস বোলিং ৮/৩৪, ইনিংসে ৫ উইকেট ২২ বার, ম্যাচে ১০ উইকেট ৪ বার। ওয়ানডে উইকেট ছিল ১৪৫, সেরা ম্যাচ বোলিং ৪/৩১।

১৯৭৯, ১৯৮৩ আর ১৯৯২, তিনটি বিশ্বকাপ খেলা (১৯৭৯ আর ১৯৯২-এর ফাইনালিস্ট ইংল্যান্ড ১৯৮৩ সালে সেমিফাইনালে হেরেছিল ভারতের কাছে) বর্ণান্ধ অলরাউন্ডার বোথাম ১৯৭৪ সালে, তার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের প্রথম বছরে, মাত্র ১৯ বছর বয়সে সামারসেটের হয়ে ব্যাট করার সময় হ্যাম্পশায়ারের দ্রুততম বোলার অ্যান্ডি রবার্টসের বলে মুখে আঘাত পান আর তার দাঁত ভেঙে যায়।

রক্তাপ্লুত বোথাম জাস্ট তার ভাঙা দাঁতটি মুখ থেকে ফেলে দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে, পরের বল থেকে আবার ব্যাটিং শুরু করে দেন। পরের অনেক বোথাম-রবার্টস যুদ্ধের ভিত গাঁথা হয়েছিল ঐ দিনই। ১৯৮০ সালে অধিনায়ক হয়ে তার চাপে ১২ টির মধ্যে একটিও টেস্ট না জেতা, সঙ্গে চূড়ান্ত অফ ফর্ম, তার অধিনায়কত্ব কেড়ে নেয়।

যদিও ১৯৮০ সালেই ভারতের বিরুদ্ধে এক ম্যাচে সেঞ্চুরি আর ১৩ উইকেট ছিল তার। ১৯৮১ ছিল তার স্বপ্নের বছর। প্রথম দু’টি টেস্টে শোচনীয় ব্যর্থ বোথাম ১৯৮১-এর অ্যাশেজ সিরিজে তৃতীয়, চতুর্থ আর পঞ্চম টেস্টে হেডিংলি, বার্মিংহাম আর ম্যানচেস্টারে ছিলেন স্বপ্নের ফর্মে, যা তাকে সিরিজে ৩৯৯ রান আর ৩৪টি উইকেট এনে দেয়। তিনটি টেস্টই জেতে ইংল্যান্ড।

তারা ছয় টেস্টের সিরিজ জেতে ৩-১ ফলে। নিষিদ্ধ ক্যানাবিস সেবনের জন্য দু’মাস নির্বাসিত হন ১৯৮৬ সালে। ১৯৯২ সালে অবসরের আগে ভাল ও খারাপ ফর্ম একই ভাবে নিতেন তিনি, সেই নির্ভার-নির্ভীক মনোভাব নিয়ে।

তিনি ছিলেন তাঁরই মত। ১১টি ম্যাচে স্কানথর্প ফুটবল টিমের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি লিগ টু-তে, ১৯৮০ সালে। দূর পাল্লার চ্যারিটি হাঁটার মাধ্যমে ১২ মিলিয়ন জিবিপি তুলে দেন তিনি লিউকোমিয়া রিসার্চের জন্য। ২০১০-১১ মৌসুমে অ্যাশেজ সিরিজে কার পার্কিং নিয়ে তার গ্রেগ চ্যাপেলের সঙ্গে তীব্র ঝামেলার ঘটনা তো বহুশ্রুত।

হাউস অফ লর্ডসের সদস্য, ডারহাম কাউন্টির চেয়ারম্যান বোথাম এখন থাকেন আলমেরিয়া শহরে, সম্পূর্ণভাবে গলফে মজে। খেলার মাঠে নিজেকে টেনশনমুক্ত করে বিন্দাস ক্রিকেট খেলা তার মত করে খুব কম ক্রিকেটারই খেলেছেন। সেই সময়কার চার উজ্জ্বল অলরাউন্ডারের (ইমরান-কপিল-বোথাম ও হ্যাডলি) মধ্যে অবিসংবাদিভাবে রঙিনতম অলরাউন্ডারের নাম ছিল ইয়ান টেরেন্স বোথাম।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...