‘আমি পিচের ওপর রক্ত দেখতে পছন্দ করি’

তাঁর ওই অদ্ভুত অ্যাকশনের কারণেই কিনা, তিনি একটা সিরিজ শেষেই আনফিট হয়ে যেতেন। ক্যারিয়ার দীর্ঘ করবার জন্য তিনি গতিতে ছাড় দিতে শুরু করেন। শেষের দিকে আর তেমন গতির ঝড় তোলেননি! তখন গতি কেবল ১৪৫/৫০ এর আশেপাশে থাকতো। আশির দশকে অবসরে যান, ১৯৯৭ সালের অ্যাশেজে তিনি রেডিও ধারাভাষ্য দিয়েছেন।

শিরোনামের কথাগুলি যদি একজন ফাস্ট বোলারের হয় এবং আপনি যদি ১৯ শতকের ৭০ অথবা ৮০’র দশকের ব্যাটসম্যান হন তাহলে আপনার জন্য সেটা চিন্তার ব্যাপার বৈকি! একবার শুধু কল্পনা করুন, দীর্ঘকায় একজন বোলার খুব ছোট একটা রানআপে কিম্ভুত কিমাকার ভঙ্গিতে ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটারের একেকটা গোলা ছুঁড়ছে আপনার দিকে!

গোলা সামলানোর জন্য আপনার সম্বল শুধু ব্যাট, প্যাড আর হ্যান্ড গ্লাভস! মাথায় নেই কোন হেলমেট! কি, শিউরে উঠলেন? আপনি যদি কল্পনাতেই শিউরে ওঠেন, তাহলে যারা সত্যি সত্যি এই বিভীষিকার সামনে দাঁড়িয়েছেন তাদের কথা একবার ভাবুন! হ্যাঁ, এভাবেই বল করতেন জেফ থমসন ওরফে থম্য!

পুরো নাম জেফরি রবার্ট থম্পসন। ১৯৫০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় থমসন পরিবারের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন। বোলার হিসেবে তাকে বর্ণনা দিতে একটা শব্দই যথেষ্ট ‘ফাস্ট’! হালের বোলারদের মতো ফাস্ট নন, সত্যিকারের ফাস্ট বোলার ছিলেন জেফ। তৎকালীন সময়ের আরেক গ্রেট ফাস্ট বোলার ডেনিস লিলির সাথে গড়ে তুলেছিলেন সত্যিকারের ভীতি জাগানো ফাস্ট বোলিং জুটি।

তারাই কি সর্বকালের সেরা জুটি কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু থম্পসন যে সর্বকালের সেরা ভীতি জাগানো বোলার সেটা নিয়ে কোন সংশয় বা বিতর্ক নেই। ভিভ, গাভাস্কার, চ্যাপেল অথবা ক্রো এদের সার্টিফিকেট যদি আপনার কাছে যথেষ্ট মনে না হয় সেক্ষেত্রে অবশ্য আলাদা কথা! ভিভ তার বর্ণনায় বলেছেন, ‘আমার দেখা সব থেকে ফাস্ট ছিলেন থম্পসন।’ একই কথা গাভাস্কার, ক্রো, চ্যাপেলরাও বলেছেন।

গতি পরিমাপক যন্ত্র এখনকার মতো এতটা উন্নত না হলেও, তখনকার সময়ে তার করা বলগুলো সহজেই ছাড়িয়েছে ৯০ মাইলের ব্যারিয়ার! ১৯৭৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে একটি প্রদর্শনী ম্যাচে তার হাত থেকে ঘণ্টায় ১৬০.৪৫ কিলোমিটারের একটি গোলা প্রসব হয়! আপনার কপালে ওঠা চোখ মাথায় তুলে দিতেই তিনি ১৯৭৬ সালে ১৬০.৫৮ কিলোমিটার/ঘণ্টা স্পিডে আরেকটি গোলা ছোড়েন! এবার মাথায় উঠে যাওয়া চোখ জায়গামত নামিয়ে বাকিটুকু পড়ুন।

থম্পসনের ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়েই উইকেট কিপিং করেছেন রড মার্শ এবং তার কথা অনুযায়ী থমসন অনেক সময় ১৮০ কিলোমিটার/ঘণ্টা গতিতেও বল করেছেন! শুনতে অসম্ভব শোনা গেলেও থম্পসন নিজেও সেকথা স্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, ‘ব্যাটসম্যান প্রান্তের ক্রিজ পার হবার পর বলের গতি না মাপলে আমার গতি ১৮০ কিলো/ঘণ্টা হতো!’ উল্লেখ্য, তখনকার সময়ের স্পীডমিটারের হিসাব বল ব্যাটসম্যান প্রান্তের ক্রিজ অতিক্রম করার পর করা হতো! একবার শুধু ভাবুন, থমসন যদি এখনকার সময়ে জন্মাত!

থম্পসনের অভিষেক হয় পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৯৭২/৭৩ সালে। সেই ম্যাচে তিনি পায়ের পাতায় একটি ভাঙা হাড় নিয়েই খেলেছিলেন, কিন্তু নির্বাচকদের সেটা জানাননি বাদ পড়ার ভয়ে। বাজে পারফরমান্সের জন্য সেবার বাদ পড়েন এবং ফিরে আসেন ১৯৭৪/৭৫ সালে। শুরু হয় তার গতির ঝড়! সেবার অ্যাশেজে একাই ৩৩ উইকেট নিয়ে ধসিয়ে দেন ইংলিশদের!

ওই অ্যাশেজে ইংলিশদের মনে এতোই ভীতি জাগিয়েছিলেন যে, অন্য বোলারের করা শেষ বলে অনেক ইংলিশ ব্যাটসম্যানই রান নিতে চায়নি শুধু পরের ওভারে থম্পসনকে মোকাবেলা করতে হবে বলে। সেই অ্যাশেজ শুরুর আগে এক সাক্ষাৎকারে থমসন বলেছিলেন ‘আউট করার চেয়ে ব্যাটসম্যানদের শরীরে আঘাত করতেই বেশি ভাল লাগে আমার। আমি পিচের ওপর রক্ত দেখতে পছন্দ করি।’

দোষ ইংলিশদেরও দেয়া যায় না, যে বোলার উইকেট নেবার থেকে ব্যাটসম্যানদের আঘাত করতে বেশি ভালবাসেন, তার মোকাবেলা করাটাও অনেক ক্ষেত্রে দু:সাহস। থম্পসনের রানআপ ছিল অনেক ছোট এবং সাদামাটা কিন্তু বল করার অ্যাকশনটা ছিল বড় অদ্ভুত। বর্তমান সময়ে মালিঙ্গার বল দেখলে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন, তবে থমসনেরটা ছিল আরও ইউনিক!

তিনিই স্লিঙ্গিং অ্যাকশনের জনক! কিন্তু এতো ছোট রানআপে প্রায় ১০০ মাইল বেগে কিভাবে বল করতেন? আসলে থমসন ছিলেন একজন জ্যাভলিন থ্রোয়ার, সেই অভ্যাসটাই তাঁকে সাহায্য করেছে এবং সাথে ছিল তার স্লিঙ্গিং একশন। গুড লেন্থ থেকেও বল ব্যাটসম্যানের মাথা অবধি উঠেছে, কখনো নাক, কখনো চোয়াল আবার কখনো থুঁতনি থেকে ঝড়িয়েছেন রক্ত!

এমনও মনে হয়েছে, তিনি উইকেট নেবার জন্য বল করছেন না কিন্তু ব্যাটসম্যান উইকেট দেবার জন্য ব্যাট করছে! কথিত আছে, থমসনের করা একটি বল পিচে এক ড্রপ পড়ার পর কিপারের মাথার উপর দিয়ে সোজা বাউন্ডারির বাইরে সাইটস্ক্রিনে আঘাত করেছে! এই দৃশ্য দেখার পর পিচে থাকা দুই ব্যাটসম্যানের কথা একবার ভাবুন!

যাই হোক, তাঁর ওই অদ্ভুত অ্যাকশনের কারণেই কিনা, তিনি একটা সিরিজ শেষেই আনফিট হয়ে যেতেন। ক্যারিয়ার দীর্ঘ করবার জন্য তিনি গতিতে ছাড় দিতে শুরু করেন। শেষের দিকে আর তেমন গতির ঝড় তোলেননি! তখন গতি কেবল ১৪৫/৫০ এর আশেপাশে থাকতো। আশির দশকে অবসরে যান, ১৯৯৭ সালের অ্যাশেজে তিনি রেডিও ধারাভাষ্য দিয়েছেন।

৫১ টি টেস্ট ম্যাচে ২৮ গড়ে ২০০ উইকেট। এই পরিসংখ্যান দিয়ে জেফরি থমসনকে মাপলে ভুল করবেন। পরিসংখ্যানে ওই চোয়াল, থুঁতনি অথবা পাঁজরের হাড়ের হিসেব লেখা থাকে না, লেখা থাকেনা ব্যাটসম্যানের চোখের সেই ভয়, অথবা পিচে রেখে যাওয়া রক্তের পরিমান! একজন জেফরি থমসনকে মাপতে হলে আপনাকে হতে হবে তার মুখোমুখি হওয়া কোন ব্যাটসম্যান।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...