বৃত্তের ভেতর ‍শুধু তুমি আছো

১৭-১৮ বছর বয়সে যখন ‘অস্ট্রেলিয়ান ক‍্যাপিট‍্যাল টেরিটোরি’ ক্লাবে খেলবার সুযোগ পেলেন তখন সামনে অধিনায়ক ও পরে কোচ হওয়া মার্ক হিগসকে। স্পিনের খুঁটিনাটি শিক্ষা সেখান হতেই। সঙ্গে উপরি হিসেবে মানুকা ওভালের মাঠের শিক্ষানবীশ হিসেবে পরিচর্যার ভার নিলেন।গল্পটা বদলে গেলো যখন মাঠকর্মী হিসেবে অ্যাডিলেড ওভালে কাজ করতে শুরু করলেন।

‘আমি বিশ্বাস করি, আমার স্টক বল দিয়ে বিশ্বের যেকোনো জায়গায় যেকোনো ব্যাটসম্যানের উইকেট নিতে পারবো। আমার কাজ বিভিন্ন কোন, স্পটস এবং ভেরিয়েশন থেকে প্রতিনিয়ত ব্যাটসম্যানের ডিফেন্সকে চ্যালেঞ্জ জানানো। উপমহাদেশে সেটাই মূল অস্ত্র।’

৩০ নভেম্বর, ২০১২। পার্থের ওয়াকা মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তৃতীয় টেস্টে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেষ বারের মতো মাঠে নামতে চলেছেন অস্ট্রেলিয়া ও ক্রিকেট বিশ্বের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান তথা অধিনায়ক রিকি পন্টিং। প্রথম দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস হওয়ার শেষ কিছু সময় ব‍্যাট করবার সুযোগ পেলো অস্ট্রেলিয়া।

ওই সময়ের মধ্যেই এড কাওয়ান ও শেন ওয়াটসন উইকেট হারানোর পর মাঠের সমস্ত দর্শক উঠে দাড়ালো কিংবদন্তিকে স্বাগত জানানোর জন্য, সাথে পন্টিংয়ের স্ত্রী ও পরিচিতরাও। কিন্তু এ কি! প‍্যাভিলিয়ন থেকে হেলমেট পরিহিত অবস্থায় বেরোলেন এক কিছুটা লম্বা এক নাইটওয়াচম্যান, যার ঝুলিতে অভিজ্ঞতা মাত্র কয়েকটি টেস্ট। যাইহোক দর্শকরা তাকেই হাততালি দিয়ে স্বাগত জানালেন, চোখে মুখে বিস্ময়ের শেষ নেই।

কিন্তু. বর্তমান সময়ের কথা ভাবলে তাকে অন‍্য কাউকে ভেবে নয় তাকে দেখেই দর্শকরা দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়, কুর্নিশ জানায়। ‘অখ্যাত’ এক মাঠকর্মী থেকে একদিন নিজেকে অস্ট্রেলিয়া তথা বিশ্বের অন‍্যতম সেরা অফ স্পিনারে পরিনত করা এক অসাধারণ গল্পের নজীর গড়েছেন তিনি। তিনি হলেন নাথান লিঁও।

ক্রিকেটকে ধ‍্যানজ্ঞান করে নিজের শহর ছেড়ে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী শহর ক‍্যানবেরাতে এসেছিলেন তরুণ, চোখে স্বপ্ন ঐতিহ‍্যবাহী ব্যাগি গ্রিন মাথায় উঠানোর। ১৭-১৮ বছর বয়সে যখন ‘অস্ট্রেলিয়ান ক‍্যাপিট‍্যাল টেরিটোরি’ ক্লাবে খেলবার সুযোগ পেলেন তখন সামনে অধিনায়ক ও পরে কোচ হওয়া মার্ক হিগসকে। স্পিনের খুঁটিনাটি শিক্ষা সেখান হতেই। সঙ্গে উপরি হিসেবে মানুকা ওভালের মাঠের শিক্ষানবীশ হিসেবে পরিচর্যার ভার নিলেন।গল্পটা বদলে গেলো যখন মাঠকর্মী হিসেবে অ্যাডিলেড ওভালে কাজ করতে শুরু করলেন।

মাঠের দায়িত্ব সামলানোর সাথে অনুশীলন চালিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়লেন তখনকার অস্ট্রেলিয়ার টি-টোয়েন্টি দল রেডব‍্যাকসের কোচ ড‍্যারেন বেরির। শার্প টার্ন, ফ্লাইট, লুপ, ড্রিফ্ট সবতেই মন কেড়ে নিতে পারলেন তার। রেডব‍্যাকসে নিয়ে এলেন সেই স্বপ্নচারী মাঠক‍র্মীকে। রেডব‍্যাকস চাম্পিয়ন আর সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী কে হলেন? কে আবার, লিঁও। কিন্তু নিজের পা কে মাটিতেই আবদ্ধ রাখলেন বর্তমান সময়ের মতোই। সবসময় মাথায় রেখেছেন বেরীর শিক্ষা – স্পিন, স্পিন এবং স্পিন আর তাতেই লুকিয়ে রেখেছেন ব‍্যাগি গ্রিন মাথায় চাপানোর আজন্ম লালিত স্বপ্ন!

না সেই রঙিন স্বপ্ন সামনে আসতে খুব দেরী হয়নি।।আচ্ছা একজন ক্রিকেটার কেমনভাবে আন্তর্জাতিক অভিষেকে তার ছাপ ছেড়ে যাবেন! ইনিংসে পাঁচ উইকেট, নিজের প্রথম বলেই উইকেট নাকি নিজের প্রথম উইকেট কুমার সাঙ্গাকারা হয়।

আচ্ছা যদি সব গুলোই একসাথে হয়!

এমন অভিষেক তো কল্পনার গল্পকে ভ্রম বানিয়ে বাস্তবতায় নামিয়ে আনার মতো। এমন কাজটিই সেদিন করে দেখিয়েছিলেন সাধারণ একজন মাঠকর্মী থেকে জগৎ-বিখ্যাত অজি ড্রেসিংরুমের একজন বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

না তার ঝুলিতে নেই অন‍্য অফ স্পিনারদের মতো দুসরা-তিসরা কিংবা অন‍্যান‍্য ভেরিয়েশন। তার প্রধান অস্ত্র হলো শার্প অফ স্পিন, যা বর্তমান সীমিত ওভারের অফস্পিনারদের মধ্যে অস্তমিত হতে দেখা যাচ্ছে। ক্রমাগত একজায়গায় বল ফেলে যাওয়ার ক্ষমতা, ফ্লাইট, ড্রিফ্টিং এই সব অস্ত্রকে পাথেয় করেই অস্ট্রেলিয়ার মাঠের সাথে সাথেই অন‍্যান‍্য দেশেও ব‍্যাটসম‍্যানের বিভীষিকা হয়ে উঠেছেন।

যতদিন গেছে নিজেকে একজন প্রকৃত ম‍্যাচ উইনার হিসেবে তুলে ধরেছেন সেটা দেশে কিংবা বিদেশে। ভেরিয়েশন কম বলে হয়তো সীমিত ক্রিকেটে সুযোগ পান না, কিন্তু ক্রিকেটের সবচেয়ে সেরা মঞ্চে তার উপযোগিতা এবং কার্যকরীতা  বারবার প্রমাণ করেছেন।

লিঁও নিজেকে আজ যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন নিজের দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে তা যে কোনো অবিশ্বাস্য গল্পের কাহিনী কেউ হার মানাবে। তবে এই অবিশ্বাস্য গল্পতে নয় কাব‍্যতে পরিনত হবে একদিন তা বিশ্বাস করাই যায়। নি:সন্দেহে সামনে আরো বহুবার বিশ্বসেরা সব ব্যাটসম্যানদের বাইশ গজে বিব্রত করবেন লিঁও। বিন্দু থেকে বৃত্ত বনেছেন তিনি। সেই বৃত্তের ভেতরে তিনি একাই আছেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...