জাতীয় দলের অন্দরমহলে
এমন কয়েক জন মানুষ আছেন, যারা জাতীয় দলে না খেলেও জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমের অংশ। না, আমরা কোচদের বা কোচিং স্ট্যাফের কথা বলছি না। এর বাইরেও ক’জন লোক আছেন, যারা বাংলাদেশ দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাগজে কলমে তাদের আঁমরা বলি সাপোর্ট স্ট্যাফ। আসলে তারা জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সার্বক্ষনিক সঙ্গী।
ড্রেসিংরুমের কাচের ভেতর থেকে কখনো তামিমের ছক্কা দেখেছেন?
সাকিব আল হাসানকে কখনো মালিশ করে দিয়েছেন? মাশরাফির সাথে কখনো নেচেছেন? জাতীয় দলের কোচ কখনো আপনার কাঁধে হাত রেখেছেন?
আমি-আপনি যেহেতু বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে কখনো খেলিনি, তাই আমাদের এই সৌভাগ্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই। জাতীয় দলের সাথে ড্রেসিংরুমে আমরা থাকবো কী করে!
তবে কি জানেন, এমন কয়েক জন মানুষ আছেন, যারা জাতীয় দলে না খেলেও জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমের অংশ। না, আমরা কোচদের বা কোচিং স্ট্যাফের কথা বলছি না। এর বাইরেও ক’জন লোক আছেন, যারা বাংলাদেশ দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাগজে কলমে তাদের আঁমরা বলি সাপোর্ট স্ট্যাফ। আসলে তারা জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সার্বক্ষনিক সঙ্গী।
আমরা কথায় কথায় বলি, মাঠে কেবল ১১ জন খেলে না। এর বাইরে বেঞ্চে যারা বসে থাকেন, খেলার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিটা তাদেরও সমান। একইভাবে বলা যায়, জাতীয় দলের যাবতীয় অর্জনের পেছনে লুকানো থাকে এই সাপোর্ট স্ট্যাফদের পরিশ্রম। কেউ খেলোয়াড়দের শরীর ম্যাসেজ করে দেন, কেউ তাদের হাতের কাছে খাবার-পানিটা পৌছে দেন; আবার কেউ খেলোয়াড়কে শেষ মুহুর্তের প্রস্তুত করতে তাকে বল ছুড়ে ব্যাট করতে সহায়তা করেন।
সেই অন্তরালের নায়কদের গল্প হয়ে যাক আজ।
- আনিসুর রহমান খোকন
বাংলাদেশ জাতীয় দলের সবচেয়ে পুরোনো সৈনিক খোকন ভাই। আনিসুর রহমান খোকন যখন প্রথম জাতীয় দলের সাথে কাজ শুরু করেন, তখন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু অধিনায়ক। এরপর থেকে আকরাম খান, নাঈমুর রহমান দূর্জয়, হাবিবুল বাশার থেকে শুরু করে মাশরাফি বিন মুর্তজার দলও নিজের হাতে সামলেছেন এই খোকন ভাই।
খোকন যখন একেবারে বালক, সেই সময় থাকতেন গ্যান্ডারিয়া। সুযোগ পেলেই চলে আসতেন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। অত্যন্ত দূরন্ত ছিলেন বলে তার একটা গতি করা দরকার ছিলো। তাই এক চাচা ঢুকিয়ে দিলেন ক্রিকেট বোর্ডের চাকরিতে।
সেই খোকনের শুরু। আসলে সেটা জাতীয় দলেরও নতুন এক অধ্যায়ের শুরু। খোকনের আগে জাতীয় দলে এরকম কোনো স্থায়ী সহকারী ছিলেন না। খোকনকে দিয়েই যুগটা শুরু হলো। এরপর জাতীয় দলে অনেক যুগান্তরের স্বাক্ষী এই খোকন।
জাতীয় দলের পরিবেম কতটা বদলে গেছে, সেটা বলতে গিয়ে খোকন বলছিলেন, ‘সেই সময় তো স্টেডিয়ামের পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এনে দিলেই সেটা বড় কিছু মনে হতো। বোতলের পানি খাওয়ার মত অবস্থা পর্যন্ত ছিলো না। বালতিতে করে চাপকল থেকে পানি আনতাম। প্লাস্টিকের গ্লাসে ভরে সেই পানি প্লেয়ার, অফিশিয়াল সবাই খাইতো। আর এখন তো ফাইভ স্টার হোটেল থেকে খাবার, পানি আসে।’
তবে একটা জিনিস বদলায়নি বলে মনে করেন খোকন। সেটা হলো জাতীয় দলের পরিবেশ। সেই ১৯৮৮ সাল থেকে দলের সাথে থাকা খোকন বলছিলেন, ‘সেই লিপু ভাইরা যেমন ভালোবাসতেন, এখনও মাশরাফি ভাই, তামিম ভাই, সাকিব ভাইরা একইরকম ভালোবাসে। আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো খেলোয়াড়রা সম্মান করে।’
- সোহেল ইসলাম
বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে মজার চরিত্র সোহেল ইসলাম। ড্রেসিংরুমে কোনো আনন্দ তাকে ছাড়া পূর্ণ হয় না। মজার সব কৌতুক, মশকরা থেকে শুরু করে সবাই মিলে নাচ-গান; সব কিছুতেই সোহেল ইসলাম খেলোয়াড়দের সবচেয়ে বড় ‘ভরসা’!
সোহেল ইসলাম মূলত ম্যাসেজের কাজ করেন। তিনি এসেছেন ফিজিওথেরাপি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। খুলনার মানুষ সোহেল ইসলাম ঢাকায় গিয়ে একটা স্পোর্টস ফিজিও থেরাপি সেন্টারে কাজ করতেন। সেখান থেকে চাকরি বদলে নাভানা টাওয়ারের একটা ফিজিওথেরাপি সেন্টারে কাজ নিলেন।
আর এখানেই তার কাজ দেখলেন বিসিবির এক কর্মকর্তা; তখন নাভানা টাওয়ারে বিসিবির একটা অফিস ছিলো। সেটা ২০০৭ সালের ঘটনা। সোহেলকে এনেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ফিজিও থেরাপি টিমের অংশ করে দেওয়া হলো। তিনি যেহেতু ক্রীড়াবিদদের খেলার আগে পরে ঠিক কী ধরণের ম্যাসেজ দরকার, সেটা খুব ভালো জানতেন; খুব অল্প সময়েই খেলোয়াড়দের পছন্দের মানুষের পরিণত হলেন।
সোহেলের এই খেলোয়াড়দের পছন্দ হয়ে ওঠার আরেকটা বড় কারণ তার মজা করতে পারা। সোহেল অবশ্য এই মজার কথা উঠলে একটু লজ্জাই পেলেন। তিনি বললেন, ‘মজা তো ক্রিকেটাররা করেন। ওনারা তো আমাদের খুব মজায় রাখেন। মাশরাফি ভাই থাকলে তো আর মজার শেষ নাই। এ ছাড়া তাসকিন ভাই, রিয়াদ ভাই; সবাই খুব মজা করে। আর আমরা তো গান চাই। বিশেষ করে ম্যাচ জিতলে-আমরা করবো জয় গানটাই আমাদের সেরা গান।’
- মোহাম্মদ নাসির
যারা জাতীয় দলের অনুশীলন দেখতে মিরপুরে কখনো গেছেন, তাদের কাছে নাসির সবচেয়ে পরিচিত মুখ। সবসময় অত্যন্ত ব্যস্ত এক চরিত্র। এই খেলোয়াড়ের সরঞ্জাম গোছাচ্ছে, আবার ওই খেলোয়াড়কে বল থ্রো করে দিচ্ছে ব্যাটিং করার জন্য। দলের একেবারে সত্যিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুশফিক, তামিমদের সবচেয়ে বড় ভরসার ডান হাত।
নাসির চেয়েছিলো, সে নিজে ক্রিকেটার হবে। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই ঘুরতো। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলো এক পরিচিত জনের বাসায়। ক্রিকেটের টানেই সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে রোজ দেখা যেতো নাসিরকে। খেলোয়াড়দের অনুশীলনের পাশে ঘুরঘুর করতো।
নাসির নিজে বলছিলেন, ‘তখন তো এতো বাধা নিষেধ ছিলো না। আপনারা সাংবাদিকরাও তো ড্রেসিংরুমে ঢুকতে পারতেন। আমরা অনুশীলনের নেটের পাশে দাড়ায়ে ব্যাটিং দেখতাম। একদিন আমাকে এক কর্মকর্তা বললেন, বল থ্রো করবি? সেই থেকে শুরু। তারপর আর কোনোদিন অন্যকিছু ভাবি নাই।’
সেটা ১৯৯৬ সালের ঘটনা। সেই থেকে নাসির আছেন দলের সাথে। দলের উত্থানপতন অনেক কিছুই দেখেছেন। দেখেছেন বদলে যাওয়াও। তবে একটা ব্যাপার নাসির খুব ভালো বুঝেছেন, ‘ড্রেসিংরুম সবসময়ই মজার জায়গা। কিন্তু টিম হারলে ড্রেসিংরুমটা অন্ধকার হয়ে যায়। খেলোয়াড়রা কেউ চায় না, টিম হারুক। টিম হারলে সবার মনটা খুব খারাপ হয়। সবসময় দোয়া করি, টিম যেনো জেতে এবং সবার মনটা যেনো ভালো থাকে।’
- মোহাম্মদ বুলবুল
বুলবুল উঠে এসেছে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে।
এটা সত্যি। বুলবুলের মা বিকেএসপিতে চাকরি করতেন। তার এক ভাই এখনও বিকেএসপিতে চাকরি করেন। বুলবুলের বাসা বিকেএসপির তিন নম্বর মাঠের ঠিক বাইরের দিকটায়। ফলে ছোট বেলা থেকেই বিকেএসপিতে যাতায়াত ছিলো। আর সেভাবেই বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৩ দলের সাথে তাকে কাজ করতে দেওয়া হলো।
সে সময় সেই দলে খেলছেন সাকিব, তামিমরা। এরপর এই দলটা অনুর্ধ্ব-১৭, অনুর্ধ্ব-১৯ দল হিসেবে যখন খেলেছে, সেখানেও কাজ করেছে বুলবুল। আর এই কাজে ভালো করার পুরষ্কার হিসেবেই ২০১৭ সালে তাকে জাতীয় দলে নিয়ে আসা হয়।
বুলবুলের বড় গুন হলো একাধারে ভালো থ্রোয়ার এবং ভালো সহকারী। ফলে সেও হয়ে উঠেছে জাতীয় দলের প্রয়োজনীয় একজন। বাকীদের মতো অতো সময় জাতীয় দলের সাথে না কাটালেও এরই মধ্যে দল সম্পর্কে ভালো ধারণা হয়েছে তার। এই শ্রীলঙ্কা সফরে দলের সাথে গেলো বুলবুল।
তার আশা এই সফরে দল ভালো করবে এবং ড্রেসিংরুমও আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
বুলবুল বলছিলেন, ‘এই দলের খেলোয়াড়দের তো অনেকদিন ধরে দেখছি আমি। সেই ছোটবেলা থেকে। এরা তো সবসময় জিততে চায়। আমাদের সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো, এরা ভালো করলে। ওনারা ভালো করলে, দল জিতলে মনে হয়, যা করি সব কষ্ট সার্থক।’
নোট
এই চার জন ছাড়াও কম বেশী আরও কয়েক জন কাজ করেন জাতীয় দলের সাথে। বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স বিভাগের মোহাম্মদ রুস্তম কাজ করেন। এ ছাড়া রমজান সদ্যই ঢুকেছেন সাপোর্ট স্ট্যাফ হিসেবে। আর এই সকলকে নিয়েই আমাদের জাতীয় দলের পরিবার।
তামিমের একটা সেঞ্চুরি কেবল তার একার অবদান না। ওই সেঞ্চুরির পেছনে লুকানো আছে কোচদের পরিশ্রম, লুকানো আছে তাকে স্বচ্ছন্দে রাখা এই স্ট্যাফদের পরিশ্রম। তাই ক্রিকেটের এই অন্দরমহলের তারকাদের এই স্যালুট তো প্রাপ্যই।