নিউজিল্যান্ড কী আসলেই এক নম্বর?

ঘরের বাইরে শেষ ১০ ম্যাচের ৩টাতে, শেষ ২০ ম্যাচের ৭টাতে, আর শেষ ৩০ ম্যাচের মাত্র ১০টাতে জিতেছে নিউজিল্যান্ড! শেষ ৩০ ম্যাচে ২০ হার! জয় দেখা ম্যাচগুলোতে ইংল্যান্ডের সাথে একটা ম্যাচ বাদে বাকি সব ম্যাচের প্রতিপক্ষই আবার শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর জিম্বাবুয়ে।

ক্রাইস্টচার্চে পাকিস্তানের সাথে টেস্ট ম্যাচ জিতেছে নিউজিল্যান্ড। তাও ইনিংস ও ১৭৬ রানের ব্যাবধানে। এই ম্যাচের পর টেস্টে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মত এক নম্বরে উঠে এসেছে নিউজিল্যান্ড।

নিউজিল্যান্ড অবশ্যই এতে অভিনন্দন পাবার যোগ্য। সাদা পোশাকের ঐতিহ্যের ক্রিকেটে একটা দল এক নম্বরে উঠে এলে তাকে তো অভিনন্দন জানাতেই হয়। তবে এর আশেপাশের কিছু গল্পও জানা জরুরী। অভিনন্দন জানাতে তাতে বেশ সুবিধাই হয়।

সেই সাথে আমরা একটা প্রশ্নও মৃদুভাবে তুলতে পারি-নিউজিল্যান্ড কী আসলেই এক নম্বর?

নিউজিল্যান্ড নিজেদের মাটিতে অপ্রতিরোধ্য। নিজেদের কন্ডিশনের পুরো ব্যাবহার কিউইরা করতে পারে সর্বোচ্চভাবে। এই দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ড সবশেষ কবে টেস্ট ম্যাচ হেরেছে এমন ইতিহাস খুঁজতে চাইলে ফিরে যেতে হবে ১৬ মার্চ, ২০১৭ তে। দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ওয়েলিংটনের সেই ম্যাচটাতে নিউজিল্যান্ড হারে ৮ উইকেটের বিশাল ব্যাবধানে।

এরপর থেকে তারা দেশের মাটিতে আরো ১৩ টা টেস্ট খেলেছে; ১৩ টাতেই জয় দেখেছে তাঁরা। এই জয়গুলির মধ্যে ৮টি ম্যাচ আবার তাঁরা জিতেছে ইনিংস ব্যাবধানে! এই ইনিংস ব্যাবধানের জয়ের প্রতিপক্ষের মধ্যে আছে ইংল্যান্ড, বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ইংল্যান্ড!

নিউজিল্যান্ডের ঘরের মাঠের প্রতিরোধের আরো কিছুটা বলে নিই। ২০১৭ সালের সেই পরাজয়ের আগে নিউজিল্যান্ড আবার হোম ম্যাচ হেরেছে ২০১৬তে; প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। ২০১৬ এর আগে নিউজিল্যান্ড আবার ঘরের মাঠে টেস্ট ম্যাচ হারে ২০১২ তে; প্রতিপক্ষ আবারও দক্ষিণ আফ্রিকা।

তাঁর মানে যেটা দাঁড়াল, ঘরের মাঠে শেষ ১০ ম্যাচের ১০টাই, শেষ ২০ ম্যাচের ১৭টা, ৩০ ম্যাচের ২৫টাই জিতেছে নিউজিল্যান্ড।

তা ভালো। ঘরের মাঠে জেতা নো অন্যায় নয়। তাহলে নিউজিল্যান্ড যখন এক নম্বর দল, তারা নিশ্চয়ই বাইরেও এরকম জিতেছে?

তাহলে ঘর ছেড়ে এবার একটু অ্যাওয়ে ম্যাচগুলোতে নজর দেওয়া যাক। টেস্টের এক নম্বর দলটার অ্যাওয়ে ম্যাচের পরিসংখ্যান কেমন সেটা জানার একটা সূক্ষ্ম কৌতুহল তো সবারই থাকে।

ঘরের বাইরে নিউজিল্যান্ড সবশেষ টেস্ট সিরিজ খেলে অস্ট্রেলিয়ার সাথে, ২০১৯-২০২০ এ। তিন ম্যাচের সেই টেস্ট সিরিজের ৩টাতেই হেরে হোয়াইটওয়াশ হয় নিউজিল্যান্ড। হার তিনটেও ছিল যথাক্রমে ২৯৬, ২৪৭ ও ২৭৯ রানের বিশাল ব্যাবধানে।

এর আগে নিউজিল্যান্ড টেস্ট সিরিজ খেলে শ্রীলঙ্কার সাথে। ২ ম্যাচের সে সিরিজে একটাতে নিউজিল্যান্ড জেতে, আর আরেকটাতে হেরে যায়। এর আগের অ্যাওয়ে টেস্ট সিরিজটা ছিল পাকিস্তানের সাথে, ৩ ম্যাচের সে টেস্ট সিরিজটাতে অবশ্য ২ ম্যাচে জয় আর ১ ম্যাচে হার দেখে নিউজিল্যান্ড।

এর আগের অ্যাওয়ে টেস্ট সিরিজটা ভারতের সাথে, যাতে ৩ ম্যাচের ৩ টাতেই হারে নিউজিল্যান্ড। ভারতের জয়ের ব্যাবধানও ছিল যথাক্রমে ১৯৭, ১৭৮ ও ৩২১ রানের ব্যাবধানে।

মোটকথা, ঘরের বাইরে শেষ ১০ ম্যাচের ৩টাতে, শেষ ২০ ম্যাচের ৭টাতে, আর শেষ ৩০ ম্যাচের মাত্র ১০টাতে জিতেছে নিউজিল্যান্ড! শেষ ৩০ ম্যাচে ২০ হার! জয় দেখা ম্যাচগুলোতে ইংল্যান্ডের সাথে একটা ম্যাচ বাদে বাকি সব ম্যাচের প্রতিপক্ষই আবার শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর জিম্বাবুয়ে।

শুধু দলের ক্ষেত্রেই এটা সত্যি, তা নয়।

হোম-অ্যাওয়ে পার্থক্য বিবেচনায় নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানেরাও তাদের পারফর্ম্যান্সে যথেষ্ট ফারাক রেখেছেন। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারী থেকে ঘরের মাঠে খেলা ম্যাচগুলিতে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের গড় ৩৯.৮৪; স্ট্রাইক রেট ৫৬.৪০! খুবই ভালো কিন্তু ঘরের বাইরে খেলা ম্যাচগুলিতে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের গড় ২৫.৭৩; স্ট্রাইক রেট ৪৯.৪১!

নিউজিল্যান্ড তাদের ঘরের মাটিতে ম্যাচ বেশি বেশি জেতার কারণ হল তাদের পেসাররা। নিউজিল্যান্ডের মাঠগুলিতে ভীষণ বাতাস প্রবাহিত হয়। সেই বাতাসকে কাজে লাগানোর জন্যে নিউজিল্যান্ডের পেসাররা বোলিং-এ বাড়তি সুবিধা পায়। আর তাইতো ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের পেসারদের ১ জানুয়ারী,২০১০ থেকে বোলিং গড় ২৪.০৭, ইকোনমি রেট ২.৪৭। প্রতি উইকেট পেতে বল করতে হয়েছে প্রায় ৪৯টি (৪৮.৫) ।

নিউজিল্যান্ডের এই পেসাররা ঘরের মাঠে নিজেদের ম্যাচ জিতিয়ে দিলেও। ঘরের বাইরে যে খুব বেশি ম্যাচ জেতাতে পারছেন না তা তো দেখাই যাচ্ছে। ঘরের বাইরে নিউজিল্যান্ডের পেসারদের বোলিং গড় ৩৩.০৩,  ইকোনমি রেট ২.৯৭। প্রতি উইকেট পেতে বল করতে হয়েছে প্রায় ৬৭ টি (৬৬.৭) ।

পেসারদের কেচ্ছা যেহেতু বললামই, স্পিনারদের গল্পটাও না বললে চলবে না। ১ জানুয়ারী,২০১০ থেকে  ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের স্পিনারদের  বোলিং গড় ৪৫.২৫, ইকোনমি রেট ৩.০৩, স্ট্রাইক রেট ৮৯.৫!

তা নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশন আর পিচ কোনটাই তো স্পিন সহায়ক না, তাই স্পিনারদের পারফর্ম্যান্স কিছুটা নিচে নামতেই পারে। তবে ঘরের বাইরেও যে কিউই স্পিনারদের খুব বেশি উন্নতি হয় তা বলা যাবেনা। ১ জানুয়ারী, ২০১০ থেকে ঘরের বাইরে খেলা ম্যাচগুলির মধ্যে কিউই স্পিনারদের বোলিং গড় ৪২.৭৯, ইকোনমি রেট ৩.২৩, স্ট্রাইক রেট ৭৯.৩!

এই পরিসংখ্যানে কিন্তু আবার ড্যানিয়েল ভিট্টোরীর পারফর্ম্যান্স যুক্ত আছে, ভিট্টোরীর পারফর্ম্যান্স বাদ দিলে কিউই স্পিনারদের চিত্র কি দাঁড়াবে এটা কি কেউ ভাবতে পারছেন?

একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার, নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়দের মধ্যে শুধুমাত্র ওদের স্পিনাররাই ঘর বদলালে পাল্টে যান না। তাঁরা সবক্ষেত্রে একইর রকম থাকেন। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানেরা , হোম ম্যাচ জয়ের নায়ক পেসাররা ঘর পাল্টালে বদলে যান, আর সেই বদলে যাওয়া অল্পস্বল্প নয়, বরং অনেক অনেক বেশি পরিসরে।

এবার দুটো প্রশ্ন তুলে ধরা যাক।

প্রথমত, নিউজিল্যান্ড হয়েছে টেস্টের এক নম্বর দল। “এক নম্বর দল” শুনলেই আমাদের মনে যেরকম শ্রেষ্ঠত্বের ছবি ভেসে ওঠে, শুধু হোম ম্যাচে ছড়ি ঘুরিয়েই নিউজিল্যান্ডকে কি আমরা সেই ছবির সাথে মেলাতে পারি? এই শ্রেষ্ঠত্ব কি পুরোপুরিভাবে টেস্ট ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্ব?

দ্বিতীয়ত, ক্রিকেটে ‘হোম ট্রাক বুলী’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। সেই তকমা লেগে আছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা আর ভারতের গায়ে। কেননা এই তিন দেশ স্পিন পিচ বানিয়ে টেস্ট ম্যাচ জয়ের পরিকল্পনা আঁটে। কিন্তু আসল দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে “হোম ট্রাক বুলী” কথাটা আসলে অন্য একটি দেশের প্রাপ্য!

সেই দেশটি কারা তা কি আর বলে দিতে হবে?

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...