পল ‘উদ্ভট অ্যাকশনের’ আডামস

সাধারণ কোনো বোলিং অ্যাকশন তাঁর ছিলোনা, ছোট রানআপেই বলটা করতেন, কিন্তু বলটা করার সময় প্রথাগত ভাবে তাঁর মাথা সোজা থাকতো না,৩৬০° মাথাটা ঘুরে যেত অদ্ভুতুড়ে ঐ অ্যাকশনে বলটা ব্যাটসম্যানের দিকে ছাড়ার সময়ে। সবাই ভাবতেন বলটা ছাড়ার সময়ে তিনি কোনোভাবেই ব্যাটসম্যানকে দেখতে পেতেন না, কিন্তু আডামসের কথায় - বল ছাড়ার সময় তিনি অবশ্যই ব্যাটসম্যানকে দেখতে পেতেন, দেখতেন তাঁর মনের চক্ষু দিয়ে এবং তাঁর কাছে এটি ছিল দীর্ঘ দিনের প্র্যাক্টিসের ফল। মাথা ঘোরানো ব্যাপার স্যাপারই বটে!

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার খেলা নিয়মিত দেখেছেন আর পল আডামসের বোলিং অ্যাকশন দেখে বিস্মিত হননি এমন মানুষজন বোধহয় খুব কমই আছেন। ছোটবেলায় অনেকে কষ্ট করে তার বোলিং অ্যাকশন নকল করার চেষ্টা করেননি এমন নয়, কিন্তু ৯৯%ই বোধকরি ব্যর্থ হয়েছেন। কিছু কিছু ক্রিকেটার থাকেন যাঁরা বিখ্যাত হয়ে যান তাঁদের  দুধর্ষ স্কিলের জন্য, সে কেউ বা ব্যাট হাতে কেউ বা বল হাতে।

এমন কিছু ক্রিকেটার থাকেন যাঁরা বিখ্যাত হয়ে যান বিতর্কিত কোনো ব্যাপার স্যাপারের জন্য। আর এক শ্রেণীতে পড়েন এমন কেউ কেউ, যাঁরা অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানার জন্যও লোকের মনে থেকে যান, সেই রকমই একজন হলেন পল আডামস। যিনি দক্ষিণ আফ্রিকার এককালের বাঁহাতি চায়নাম্যান বোলার বললে হয়ত কিছুই বলা হয়না, তাঁর আসল রহস্যই লুকিয়ে আছে ঐ বহু চৰ্চিত আর বিচিত্র বোলিং অ্যাকশনে।

সাধারণ কোনো বোলিং অ্যাকশন তাঁর ছিলোনা, ছোট রানআপেই বলটা করতেন, কিন্তু বলটা করার সময় প্রথাগত ভাবে তাঁর মাথা সোজা থাকতো না,৩৬০° মাথাটা ঘুরে যেত অদ্ভুতুড়ে ঐ অ্যাকশনে বলটা ব্যাটসম্যানের দিকে ছাড়ার সময়ে। সবাই ভাবতেন বলটা ছাড়ার সময়ে তিনি কোনোভাবেই ব্যাটসম্যানকে দেখতে পেতেন না, কিন্তু আডামসের কথায় – বল ছাড়ার সময় তিনি অবশ্যই ব্যাটসম্যানকে দেখতে পেতেন, দেখতেন তাঁর মনের চক্ষু দিয়ে এবং তাঁর কাছে এটি ছিল দীর্ঘ দিনের প্র্যাক্টিসের ফল। মাথা ঘোরানো ব্যাপার স্যাপারই বটে!

ছোটবেলায় কেপটাউনের পামষ্টেড স্কুলে তাঁর গেমস টিচার যখন তাঁকে আবিষ্কার করেন, এই অদ্ভুত অ্যাকশন কিন্তু তখন থেকেই, পরে বিখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার, এডি বারলো – যিনি খেলোয়াড় তুলে আনার জন্য সেদেশে সমাদৃত তাঁর চোখেও পড়ে যান এই আডামস। বার্লোর কাছেই তৈরী হন তিনি এবং সাধের ঐ অদ্ভুতুড়ে বোলিং অ্যাকশনকে বিসর্জন তো দেননি, উল্টে আরো ধারালো করার জন্য জোরদার অনুশীলন চালাতে থাকেন, যদিও তখন গুগলি বা চায়নাম্যান এসব সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিলোনা তাঁর।

বাংলাদেশের কোচ হিসেবে কাজ করা বারলোর সংস্পর্শে আরো পরিণত হলেন আর ঘরোয়া ক্রিকেটেও ঝুড়ি ঝুড়ি উইকেট আসতে থাকল আডামসের ঝুলিতে। এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সামনে তখন ইংল্যান্ড সফর আসছে, সে দলে সুযোগও মিলে যায় আডামসের, সালটা তখন ১৯৯৫। সে সফরে ইংরেজরাও তাঁর বোলিং অ্যাকশন দেখে তাঁকে সামলাতে বেশ ল্যাজেগোবরে অবস্থা।

এসব দেখে দক্ষিণ আফ্রিকার সিনিয়র দলের নির্বাচকরা ভাবলেন বছরের শেষেই সেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে সিরিজ, সে সিরিজে এই বাচ্চা ছেলেটাকে সুযোগ দিলে বেশ হয়, যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই সুযোগ এসে গেল আডামসের দক্ষিণ আফ্রিকা সিনিয়র দলের জার্সি গায়ে ছাপিয়ে টেস্ট ম্যাচ খেলার। ইংরেজদের বিরুদ্ধে পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টে অভিষেকও হয়ে গেল আডামসের, তাও আবার সর্বকনিষ্ঠ দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে। এরপরেই ভারত সফরে গিয়ে কানপুরের গ্রিন পার্কে নিজের পঞ্চম টেস্টেই দখল করে নিলেন ৫ উইকেট। জাতীয় দলে ঢোকার পর ডাকনাম হয়ে গেল তাঁর ‘গগা’।

একদিনের ক্রিকেটের অভিষেকও সেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেই হলো আডামসের, আর অভিষেকের মাসকয়েক বাদেই উপমহাদেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর, সেখানকার স্পিন সহায়ক উইকেটে অভিজ্ঞ প্যাট সিমকক্সের সাথে দ্বিতীয় স্পিনার হিসাবে জায়গাও পেয়ে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিস্ময় বালক পল আডামস, ক্রিকেটবিশ্ব আরো বেশি করে প্রত্যক্ষ করলো তাঁকে, যত না পারফরমেন্স দিয়ে তার চেয়েও বেশি ঐ অদ্ভুতুড়ে বোলিং অ্যাকশন দিয়েই সবার নজর কেড়ে ফেললেন তিনি।

বলা হতে লাগলো ‘Frog in a blender.’ বোলিং অ্যাকশন দিয়ে নজর কাড়তে কাড়তে কোথায় গিয়ে যেন আডামসের বোলিংয়ের সেই বিস্ময়গুলো ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলো, ব্যাটসম্যানরা সহজেই পড়ে ফেলতে লাগলেন তাঁর বলের কারিকুরি। ফলত দক্ষিণ আফ্রিকা দলে নিজের জায়গা থিতু করতে কিন্তু পারলেননা আডামস, তবে নিয়মিত আসা যাওয়ার পালা চলতে লাগলো।

এর মধ্যে দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ স্পিনার সিমকক্স অবসর নেওয়ার পর একদিনের দলে সে জায়গা ভরাট করতে চলে এলেন নিকি বোয়ে, আরেক বাঁহাতি স্পিনার, ব্যাটের হাতও যাঁর বেশ ভালোই, ফলে একদিনের ক্রিকেটে আডামসের জায়গাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হতে লাগলো। টেস্ট ক্রিকেটে আডামস যদিও মোটামুটি নিয়মিত খেলতেন, আবার কখনো ধারাবাহিকতার অভাবের  জন্য বাদ ও পড়লেন।

চোটপ্রবণতা ও বহু ক্ষেত্রে তাঁকে নিকি বোয়ে বা রবিন পিটারসনদের পেছনে ফেলে দিয়েছে, তাও ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার ফিরে এসেছেন, এরমধ্যে ২০০২ সালে দ্বিতীয় দক্ষিণ আফ্রিকান স্পিনার হিসেবে টেস্টে ১০০ উইকেট ও দখল করে ফেললেন।

২০০৩ এ বাংলাদেশ সফরে আর তারপরে পাকিস্তান সফরে গিয়ে মূলতঃ লাহোর টেস্টে অনবদ্য বোলিং করলেন, তুলে নিলেন সেবার ৭উইকেট, কিন্তু তাও দলে জায়গা নিয়মিত হলো না, বছর খানেকের মধ্যে নিউজিল্যান্ড সফরের হ্যামিলটন টেস্টই হয়ে যায় তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষ স্টেশন।

মাত্র ২৭ বছরেই শেষ হয়ে যায় আডামসের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার, পরে ভারতের বিরুদ্ধে একটি সিরিজে দলে ডাক পেলেও খেলার সুযোগ আর পাননি। মাত্র ২৪টি একদিনের ম্যাচে ২৯ উইকেট আর ৪৫ টি টেস্টে ১৩৪ উইকেট নেওয়া আডামস শেষ পর্যন্ত হয়ে গেলেন বিস্ময় বালক থেকে অকালে ঝরে যাওয়া এক প্রতিভা। কিন্তু মানুষের মনে তাঁর ঠাঁই থেকে গেল বাইশগজের পারফরমেন্স নয়, ঐ বিচিত্র অ্যাকশন দিয়েই।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...