এমআরএফ ব্যাটের মান

ইনিংসের শুরুতেই রিকি পন্টিং বলছিলেন, ‘ওর ব্যাট আর পায়ের মাঝে অনেক জায়গা। ওখানেই বলটা ফেলতে হবে। ভিতরে ঢোকা বলে খেলতে অভ্যস্ত নয় পৃথ্বী।’স্টার্কও সেই কাজটাই করলেই। পা আর এমআরএফ ব্যাটে ইনসাইড এজ হয়ে বল স্প্যাম্প ভাঙলো। শচীনের ঐতিহ্য আর এমআরএফ ব্যাটের মান – দু’টোই অপমানিত হল।ফুটওয়ার্কের এই ঘাটতিটা ক্যারিয়ারের শুরুতে থাকতেই পারে। অনেক গ্রেটদেরও ছিল। পৃথ্বীকে সেটা কাটাতে হবে, সময় দিতে হবে নেটে। এর জন্য উপায় একটাই – পরিশ্রম, পরিশ্রম এবং পরিশ্রম। শচীন রমেশ টেন্ডুলকার কি অমানসিক পরিশ্রম করে এমআরএফ ব্যাট মান কিংবদন্তি পর্যায়ে নিয়ে গেছেন – সেটা বোধকরি তাঁর অজানা নয়!

সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা কথা খুব ভাইরাল হল – ‘Prithvi came, Prithvi Shaw, Prithvi Returned.’। সম্ভাব্য বাকি দুই ওপেনার লোকেশ রাহুল কিংবা শুভমান গিলের চেয়ে সাম্প্রতিক আলাপে একটু পিছিয়ে থাকার পরও অ্যাডিলেড টেস্টে সুযোগ হয়েছিল পৃথ্বী শ’র। কিন্তু, বিধি বাম। মাত্র দুই বল স্থায়ী হয় তাঁর ইনিংস। বিনা রানে বোল্ড হয়েছেন মিশেল স্টার্কের বলে।

অথচ, পৃথ্বী শ’র পরিণতি এমন হওয়ার কথা ছিল না। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন তাঁকে ‘নেক্সট বিগ থিঙ’ কিংবা ‘নেক্সট শচীন টেন্ডুলকার’ বল হচ্ছিল। ২০১৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি! যেমন সব স্কয়ার কাট আর কাভার ড্রাইভ করলেন তাঁতে মনে হয়েছিল যেন ইতিহাসের পাতা থেকে স্বয়ং শচীন টেন্ডুলকারে এসে আবারো ব্যাট করতে নেমেছেন।

১৫৪ বল খেলে ১৯ চারের সৌজন্যে পাওয়া ১৩৪ রানের ইনিংসের পুরোটা জুড়ে তিনি মোহাবিষ্ট করে ফেলেছিলেন গোটা দুনিয়ার ক্রিকেট ভক্তদের। তবে, অ্যাডিলেডের পারফরম্যান্সের পর সেই মোহাবিষ্টরাই আজ উল্টো পথে হাঁটা দিয়েছেন।

পৃথ্বী শ কিন্তু হুট করে ভারতের ক্রিকেট কাঠামোতে হাজির হওয়া কেউ না। বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই) সেই শৈশব থেকে তাঁর পেছনে বিনিয়োগ করে চলেছে। পৃথ্বীও ক্যারিয়ারের প্রতিটা ধাপে এখন পর্যন্ত সেরাটাই উপহার দিয়ে এসেছেন।

বয়স যখন মাত্র ১১, তখন স্কুল ক্রিকেটের এক মৌসুমে করেছিলেন দু’হাজারের বেশি রান। এর মধ্যে ছিল দু’টি ডাবল সেঞ্চুরি, ১৩ টা সেঞ্চুরি ও পাঁচটি হাফ সেঞ্চুরি। তখন থেকেই তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের ‘দ্য নেক্সট বিগ থিঙ’।

জাতীয় দলে অভিষেকের আগে একজন ক্রিকেটার নিজেকে যতভাবে প্রমাণ করতে পারেন, তার সবটাই করেছেন শ। মাত্র ১৪ বছর বয়সে স্কুল ক্রিকেটে এক ইনিংসে ৩৩০ বলে ৫৪৬ রান করেন। সেই ইনিংসে ছিল ৮৫ টি চার ও ছয়টি ছক্কা। তিন বছর পরই অভিষেক হয়ে যায় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। মুম্বাইয়ের হয়ে তামিল নাড়ুর বিপক্ষে সেই ম্যাচে অভিষেকেই করেন সেঞ্চুরি।

১৭ বছর বয়সেই রঞ্জি ট্রফি ও দিলিপ ট্রফিতে সেঞ্চুরি করেন। এর পরের বছর, মানে ১৮ বছর বয়সে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয় করেন অধিনায়ক হিসেবে। এর দু’বছর আগে যুব এশিয়া কাপও জিতেছিলেন। ১৮ বছর বয়সেই পাঁচটি প্রথম শ্রেণির সেঞ্চুরির মালিক বনে যান।

স্বয়ং শচীন টেন্ডুলকার বলেছিলেন, ‘১০ বছর আগের কথা। আমার এক বন্ধু আমাকে কিশোর পৃথ্বীর খেলা পরখ করতে বলে। আমাকে বলে পারলে ওকে কিছু টিপস দিতে। আমি ওর সাথে একটা সেশন কাটাই। কয়েকটা বিষয় দেখিয়ে দেই, কিছু জায়গা নিয়ে কাজ করতে বলি। সেশন শেষে বন্ধুকে বলেছিলাম, ও একদিন ভারতের হয়ে খেলবে।’

শচীনের ভবিষ্যদ্বানী সত্যি হয়। মাত্র ১৮ বছর ও ৩২৯ দিন বয়সে টেস্ট অভিষেক। আর অভিষেকেই সেঞ্চুরি। সর্বকণিষ্ঠ ভারতীয় হিসেবে তিনি টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি পেলেন। এর আগে এই কীর্তির মালিক ছিলেন আব্বাস আলী বেগ। তিনি ১৯৫৯ সালে ইংল্যান্ডের ওল্ড ট্রাফোর্ডে যখন অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেন তখন বয়স ছিল ২০ বছর ১৩১ দিন। সেই হিসেবে ৫৮ বছর পুরনো রেকর্ড ভাঙেন পৃথ্বী।

তবে, পতনের শুরুটা হয় সেখান থেকেই। ডোপ টেস্টে পজিটিভ আসায় তাঁর ক্যারিয়ারে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে। মুম্বাইয়ের হয়ে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি খেলার সময় তিনি অসাবধানতাবশত একটা কফ সিরাপ নিয়েছিলেন যাতে নিষিদ্ধ পদার্থের অবস্থান ছিল বলে নিশ্চিত করে বিসিসিআই।

২০১৯ সালের মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত মাঠের বাইরে থাকেন পৃথ্বী। সর্বশেষ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) শুরুটা ভাল হলেও শেষের দিকে অফ ফর্মে ভুগেছেন। ১৩ ম্যাচ ২২৮ রান করেন ওই আসরে। অ্যাডিলেডে মাঠে নামার আগে প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতেও তাঁর পারফরম্যান্স ছিল যাচ্ছেতাই৷ করেন যথাক্রমে ০,১৯, ৪০ এবং ৩ রান।

তারপরও তাঁর ওপর ভরসা রেখেছিল টিম ম্যানেজমেন্ট, কারণ পৃথ্বীর প্রতিভা নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। ইনিংসের শুরুতেই রিকি পন্টিং বলছিলেন, ‘ওর ব্যাট আর পায়ের মাঝে অনেক জায়গা। ওখানেই বলটা ফেলতে হবে। ভিতরে ঢোকা বলে খেলতে অভ্যস্ত নয় পৃথ্বী।’

স্টার্কও সেই কাজটাই করলেই। পা আর এমআরএফ ব্যাটে ইনসাইড এজ হয়ে বল স্প্যাম্প ভাঙলো। শচীনের ঐতিহ্য আর এমআরএফ ব্যাটের মান – দু’টোই অপমানিত হল।

ফুটওয়ার্কের এই ঘাটতিটা ক্যারিয়ারের শুরুতে থাকতেই পারে। অনেক গ্রেটদেরও ছিল। পৃথ্বীকে সেটা কাটাতে হবে, সময় দিতে হবে নেটে। এর জন্য উপায় একটাই – পরিশ্রম, পরিশ্রম এবং পরিশ্রম। শচীন রমেশ টেন্ডুলকার কি অমানসিক পরিশ্রম করে এমআরএফ ব্যাট মান কিংবদন্তি পর্যায়ে নিয়ে গেছেন – সেটা বোধকরি তাঁর অজানা নয়!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...