রবীন্দ্রনাথ ক্রিকেটেও আছেন!

ক্রিকেটের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দূরসম্পর্কের যোগাযোগ ঘটেছিল ব্রজরঞ্জন রায়ের সৌজন্যে। বাংলায় ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখিটা শুরু করেছিলেন এই ব্রজরঞ্জন রায়ই। আর লিখতে গিয়েই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, ক্রিকেট নিয়ে লিখতে গেলে বেশ কিছু শব্দ একদম অত্যাবশকীয় হয়ে পড়ে, ইংরেজিতে লিখলে তা বোঝাও যায় ভালো, অথচ তা ঠিক-ঠিক বোঝায় এমন কোনো শব্দ বাংলায় নেই। প্রয়োজন পড়েছিল তাই ক্রিকেটীয় পারিভাষিক শব্দ সৃষ্টির, আর নতুন শব্দ সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের চাইতে ভালো বিকল্প বাংলায় কে-ইবা হতে পারতেন!

প্রশ্নটি যে কেবল বোরিয়া মজুমদারের বিলেতি বন্ধুর মনেই উঁকি দিয়েছিল, এমনটি ভাববার কোনো কারণ নেই। জিজ্ঞাস্যটি আপনারও। সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ প্রেম থেকে জরা-শীর্ণ বৃদ্ধের আকুতি, বাঙালির জীবন আবর্তিত তো বিশ্বকবির বৃত্তেই। জীবনের বিচিত্রতম সব অনুভূতিতেই রবীন্দ্রনাথকে পাশে পেয়ে আপনার জানতে চাওয়াটা স্বাভাবিক, ‘আচ্ছা, রবি ঠাকুরের হাত পড়েনি, এমন কি কোনো জায়গা আছে?’ যেমনটি মজুমদারের বন্ধু চেয়েছিলেন।

এমন প্রশ্নে মজুমদার মৌনই ছিলেন। পাশ থেকে বরং মজুমদারের অন্য এক বাঙালি বন্ধু উত্তর করেছিলেন, ক্রিকেট নিয়ে সম্ভবত রবি ঠাকুর কিছু করেননি। বই-পত্তর ঘাঁটাঘাঁটি করে সেই সম্ভাব্যতা যাচাই করতে গিয়ে বোরিয়া মজুমদার আবিষ্কার করেছিলেন, কবিগুরুর ছোঁয়া ক্রিকেটেও লেগেছিল।

প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে, আমাদের রবীন্দ্রনাথ ক্রিকেটেও আছেন।

_______________

প্রথমে পরোক্ষ যোগাযোগের গল্পটিই সারা যাক। ক্রিকেটের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দূরসম্পর্কের যোগাযোগ ঘটেছিল ব্রজরঞ্জন রায়ের সৌজন্যে। বাংলায় ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখিটা শুরু করেছিলেন এই ব্রজরঞ্জন রায়ই। আর লিখতে গিয়েই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, ক্রিকেট নিয়ে লিখতে গেলে বেশ কিছু শব্দ একদম অত্যাবশকীয় হয়ে পড়ে, ইংরেজিতে লিখলে তা বোঝাও যায় ভালো, অথচ তা ঠিক-ঠিক বোঝায় এমন কোনো শব্দ বাংলায় নেই। প্রয়োজন পড়েছিল তাই ক্রিকেটীয় পারিভাষিক শব্দ সৃষ্টির, আর নতুন শব্দ সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের চাইতে ভালো বিকল্প বাংলায় কে-ইবা হতে পারতেন!

ব্রজরঞ্জন রায় সমস্যার সমাধানে ছুটে গিয়েছিলেন রবিবাবুর কাছে। সব শুনে-টুনে কবিগুরু বলেছিলেন, ভয়শূন্য চিত্তে নতুন শব্দ উদ্ভাবন করে ফেলতে। রবীন্দ্রনাথের বিচক্ষণতার এক পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল ব্রজরঞ্জন রায়ের সঙ্গে এই আলাপেই। কেননা, নতুন পারিভাষিক শব্দ সৃষ্টি নিয়ে ব্রজরঞ্জন ভয় পাচ্ছিলেন, তার ব্যবহৃত শব্দগুলো কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে এ নিয়ে ছিলেন দ্বিধান্বিত, বিশ্বকবি তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন এই বলে, ‘আজ যা নতুনত্বের কারণে অদ্ভুত, সময়ের পরিক্রমায় তা-ই হয়ে যাবে অবিচ্ছেদ্য।’

সমর্থন পেয়ে ব্রজরঞ্জন রায় উদ্ভাবন করেছিলেন বেশ কিছু ক্রিকেটীয় পরিভাষার। আজ প্রায় শতবর্ষ পরেও সেসব শব্দের ব্যবহার হচ্ছে দেখে বলা যায়, আরও অনেক বিষয়ের মতো ভবিষ্যদ্বাণীতেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নির্ভুল ছিলেন।

_______________

ক্রিকেটের সঙ্গে রবি ঠাকুরের সম্পর্কের আরেকপ্রস্থ প্রমাণ মেলে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের এক বাংলা দৈনিকের কল্যাণে। ‘রবীন্দ্রনাথ এবং ক্রিকেট’ শিরোনামে প্রকাশিত হওয়া ওই লেখা থেকেই জানা যায়, কেবল সুভাষ চন্দ্র বোসের ইউরোপ যাত্রা শুরু হয়েছিল দেখেই নয়, বিহারের গোমহ শহরটি বিখ্যাত হয়ে রইবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানটায় ক্রিকেট খেলেছেন বলেও।

অবশ্য সেখানটায় রবীন্দ্রনাথের ক্রিকেট খেলাটা নেহায়েতই ঝোঁকের বশে। গোমহ শহরে রবি ঠাকুর গিয়েছিলেন ঝটিকা সফরে, যাবার পরে এক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন করবেন বলে ভূত চেপেছিল মাথায়। ডাক দিয়েছিলেন ভারতবর্ষের নানা প্রান্তের রাজা-মহারাজাদের। তার নিমন্ত্রণ পেয়ে হাজির হয়েছিলেন ভিজিয়নগ্রামের মহারাজকুমার, পাতিয়ালা আর কুচবিহারের মহারাজা। খেলার মান যে বেশ ভালোই ছিল, খেলোয়াড় তালিকায় ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলা দুই ক্রিকেটার, ইফতিখার আলী খান পতৌদি আর দুলীপ সিংজির নাম দেখেই অনুমান করে নিতে কষ্ট হবে না নিশ্চয়ই।

_______________

ওই ম্যাচের অন্দরে কি হয়েছিল তার চাইতে বরং ম্যাচের আনুষাঙ্গিক বৃত্তান্তই পাওয়া যায় বেশি। ম্যাচ উপলক্ষে বানানো অস্থায়ী স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল দর্শকে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এদের মাঝে শাড়ি পড়ে উপস্থিত ছিলেন বেশকিছু সংখ্যক নারী দর্শকও। ম্যাচের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাজানো হয়েছিল সানাই, পাতিয়ালার মহারাজা আয়োজনের চাকচিক্য বাড়াতে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন ব্যান্ড। প্রফেসর ক্ষিতিমোহন সেন (অমর্ত্য সেনের পিতা) আর আচার্য্য বিধুশেখর শাস্ত্রী বেদমন্ত্র পড়ে শুরু করেছিলেন ম্যাচের আনুষ্ঠানিকতার।

পুরো ভারতবর্ষ তখন দুলছিল স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ারে। আন্দোলনের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যাট করতে নেমেছিলেন ধুতি আর টোকা পড়ে৷ এমনকি যে ব্যাট নিয়ে তিনি খেলতে নেমেছিলেন, তা-ও বানানো হয়েছিল দেশি কাঠে। ওই ধুতি-টোকা পরে রবীন্দ্রনাথ কত রান করেছিলেন, ম্যাচের ফলাফল কি হয়েছিল, তা অবশ্য জানা যায় না কোনো লেখা থেকে।

এর চাইতে বরং ঐতিহাসিকগণ সংরক্ষণে রাখতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আয়োজিত এই ম্যাচটির বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হওয়াকে। ক্রিকেটের চূড়ান্ত বাণিজ্যিকীকরণ করেছে বলে আজকাল ভারতের বাপান্ত করে ছাড়ে অনেকে, সে হিসেবে কিছুটা দায় তো বর্তায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপরেও। রবীন্দ্রনাথের ম্যাচ উপলক্ষে সেবার বিহারে হাজির হয়েছিলেন কলকাতার তৎকালীন স্বনামধন্য সব ক্রীড়াসামগ্রী বিক্রির প্রতিষ্ঠান, মাঠের আশপাশে তারা সাজিয়ে বসেছিলেন পণ্যের পসরা। ক্রিকেট ম্যাচও যে হতে পারে বাণিজ্যের মাধ্যম, ভারতবর্ষ তো তা জেনেছিল রবীন্দ্রনাথের কল্যাণেই।

ব্রজরঞ্জন রায়ের সুবাদে জড়িয়ে পড়েছেন বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের সঙ্গে, বিহারের ম্যাচে ক্রিকেটের বাণিজ্যিকীকরণ করে সেই সম্পর্ক করেছেন আরও গভীর। ক্রিকেট নিয়ে তাই কখনো কিছু না লিখলেও, রবীন্দ্রনাথের জীবন থেকে ক্রিকেটকে আলাদা করা যাচ্ছে কি করে!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...