গল্প হলেও সত্যি…

আপাতদৃষ্টিতে সেই যুবকের মারা শটটি প্রাথমিকভাবে ওয়ালের পাশ ঘেঁষে গোলপোস্ট থেকে দূরে সরে গিয়েও হঠাৎ করে অভিমুখ বদলে ঢুকে পড়ল জালে। হতবাক দর্শক। হতবাক গোলরক্ষক। সত্যি, এমনও কি হয়। আসলে তার মাপ করে দেওয়া ঘূর্ণন আর দ্রুতিতে বলের দুইপাশে যে বায়ুচাপের পার্থক্য হয়, সেই তারতম্যই ফোর্স হিসাবে কাজ করে আর সেই ফোর্সের অভিমুখটা থাকে উচ্চচাপ থেকে নিম্নচাপের দিকে।এককথায় ম্যাগনাস এফেক্ট। ঠিক যেন আইজ্যাক নিউটনের কোনো যোগ্য উত্তরসূরী সবুজ মাঠে শিল্প বুনছেন।

১.

সেই গল্পের প্রেক্ষাপট এক। চিত্রনাট্য এক। সেই গল্প বারবার সাও পাওলোর কোনো অখ্যাত গলি থেকে ছুটে যায় সুদূর ইউরোপে। সেই গল্পে মারাকানা স্টেডিয়ামের চূড়া থেকে পড়া লাশগুলোকে দেখে বাবার কাছে বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় তরুণ বালক এডসন। আবার সেই গল্পে বাবার লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করে ফুটবলের সাথে শ্রমিক বিপ্লবকে একাত্ম করে ফেলে এক ডাক্তার।

আবার কখনও অসমান দুই পা নিয়েও কর্ণার থেকে সরাসরি গোল করার শ্রেষ্ঠ শিল্পী হয়ে ওঠে তরুণ ফ্রান্সিসকো। এভাবেই এগোয় গল্পগুলো। আমাজনের স্রোতে এগিয়ে চলে অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল এক দেশের ফুটবলের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব ছোঁয়ার গল্প। আজকেও তো গল্প বলার দিন। আজকেও কারোর নায়ক হবার দিন।

সেই গল্পে এক গরীব কৃষক তার ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে ক্ষেতে অকথ্য পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরেছিল। সবাই ক্লান্ত কিন্তু ক্লান্তিহীন রাত্রির দিনলিপির মতো সতেজ ছিল তার একরত্তি ছেলেটা। সে বলে ওঠে, ‘বাবা, খেলে আসি?’ তারপর সে ছুটে যায় নীল আকাশের নীচে সাও পাওলোর সবুজ মাঠে। ক্ষিপ্র গতি আর জোড়ালো শট সম্বলিত নকশা গুলো তখন দূর থেকে দেখছিল এক ব্যক্তি।

কিছুক্ষণ পরে সে ওই ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমার সাথে শহরে যাবে?’ হতবাক ছেলেটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কিন্তু পরে জানতে পারে সেই লোকটা আসলে উনিয়াও সাও জোয়াও ক্লাবের স্কাউট। কিন্তু যাবে কিভাবে? পয়সা কই? ইচ্ছে যেখানে সূর্যোদয়, বাধা সেখানে সূর্যাস্ত। হীরে-মানিকের মতোই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হেঁটে হেঁটে সে পৌছে গেল সাও জোয়াও ক্লাবে।

আর সেখান থেকেই শুরু হলো সেই হীরে-মানিকের মতোই চাঁদের পাহাড়ে পৌঁছে যাবার পথ। সে পাহাড় এ বিশ্বেই আছে। সে পাহাড় শ্রেষ্ঠত্বের পাহাড়। গরীব কৃষকের ছেলে হয়ে ইতিহাস শ্রেষ্ঠ ফুলব্যাক হয়ে ওঠার গর্বের পাহাড়।

২.

সালটা ১৬৭১। উঠোনে টেনিস বল নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে করতে এক ইংরেজ আবিষ্কার করল টেনিস বলের হঠাৎ বেঁকে যাওয়া। থিওরিও প্রেজেন্ট করলো সেটা নিয়ে। তার প্রায় দেড়শো বছর পর এক জার্মান বিজ্ঞানী সেটা আরো সঠিকভাবে আবিষ্কার করলেন। আর নিজের নাম অনুযায়ী নাম দিলেন ‘ম্যাগনাস এফেক্ট’।

আসলে বলের দুই প্রান্তে বায়ুচাপের তারতম্যের জন্যেই এটা হয়। আর প্রথম সেই ইংরেজ যিনি বিষয়টি উদ্ভাবন করেন,তার নাম হলো – স্যার আইজ্যাক নিউটন। নিউটন নিজেও হয়তো জানতেননা,তার সাড়ে তিনশো বছর পর কেউ সাও পাওলো কিংবা ইউরোপের সবুজ মাঠগুলিতে তার এই আবিস্কারকে ফুটিয়ে তুলবে চামড়ার গোলকে। আর বিশ্ব ফুটবল তাঁকে চিনবে ‘দ্য বুলেটম্যান’ হিসেবে।

কাট টু ১৯৯৭। এক ফ্রেন্ডলি ট্যুর্নামেন্টে মুখোমুখি ব্রাজিল-ফ্রান্স। বক্সের প্রায় ৩৫ গজ থেকে একটা ফ্রি-কিক মিললো। সামনে দাঁড়িয়ে হিউম্যান ওয়াল। টাক মাথার সেই সাও পাওলোর কৃষকসন্তান এগিয়ে এলো ফ্রি-কিক নিতে। অনেকটা দূর থেকে দৌড়ে জোরে মেরে দিলেন শটটা। আসলে মেরেছিলেন বলটার ডানদিকের নিচ কোণা করে।

এমনভাবে মারলেন যাতে বলটা নিজের অক্ষের চারপাশে ডান থেকে বামে ঘোরে। আসলে বলটাতে মিশিয়ে দিয়েছিলেন খানিকটা দ্রুতি আর একটা অভিমুখ। পুরো মাপ করে। আর বায়ুপ্রবাহটা হচ্ছিল এমন ভাবে, যাতে বলের ডান দিকে থাকে বিপরীতপ্রবাহ আর বাম দিকে হয় অনুকুলমুখী প্রবাহ।

তাই আপাতদৃষ্টিতে সেই যুবকের মারা শটটি প্রাথমিকভাবে ওয়ালের পাশ ঘেঁষে গোলপোস্ট থেকে দূরে সরে গিয়েও হঠাৎ করে অভিমুখ বদলে ঢুকে পড়ল জালে। হতবাক দর্শক। হতবাক গোলরক্ষক। সত্যি, এমনও কি হয়। আসলে তার মাপ করে দেওয়া ঘূর্ণন আর দ্রুতিতে বলের দুইপাশে যে বায়ুচাপের পার্থক্য হয়, সেই তারতম্যই ফোর্স হিসাবে কাজ করে আর সেই ফোর্সের অভিমুখটা থাকে উচ্চচাপ থেকে নিম্নচাপের দিকে।

এককথায় ম্যাগনাস এফেক্ট। ঠিক যেন আইজ্যাক নিউটনের কোনো যোগ্য উত্তরসূরী সবুজ মাঠে শিল্প বুনছেন। আর চিনে নিন সেই সবুজ মাঠের ফসল ফলানো গরীব পিতার সন্তানটিকে – রবার্তো কার্লোস দ্য সিলভা রোচা। ফুটবল যদি শিল্প হয়। ব্রাজিল শিল্পী। আর রবার্তো কার্লোস সেই শিল্পের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি।

একসময় গ্যারিঞ্চা এই ধরনের ব্যানানা কিক মারতেন। কিন্তু তাঁর পরবর্তী সময়ে এই ব্যানানা ফ্রি-কিককে শিল্প করে তুললেন রবার্তো কার্লোস। যে ফুলব্যাক পজিশনটা ছিল আক্রমণ সামাল দেবার পজিশন, কাফুর সাথে কার্লোসের যুগলবন্দীতে সেই পজিশনে এক নতুন ধারাপাতের বিবর্তন ঘটে—‘ওভারল্যাপিং’।

আর সেই বিষাক্ত ওভারল্যাপ গুলিতে এভাবেই কাত হয়ে যায় আর্জেন্টিনা থেকে ইন্টার মিলান।জীবনের সিংহভাগ কাটিয়েছেন রিয়ালে।সর্বকালের সেরা একাদশে স্থানও পেয়েছেন। কিন্তু যখন চলে গেলেন সেই ফুলব্যাক পজিশনটা আজও না ছোঁয়ার জগৎ। মার্সোলো কিছুটা পূরণ করলেও পুরোটা হয়ত আর হয়ে ওঠেনি।

এভাবেই সেই গল্পগুলো এগিয়ে চলে আমাজনের স্রোত বেয়ে। মারাকানার চূড়ো থেকে লাশগুলোকে দেখে বাবাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে বিশ্বকাপটা এনে তরুণ বালক এডসন হয়ে ওঠে নাসিমেন্টো এডসন পেলে। শ্রমিক বিপ্লবের সাথে ফুটবলকে একাত্ম করা মেডিসিনের ডাক্তার হয়ে ওঠেন মিডফিল্ড শ্রেষ্ঠ সক্রেটিস।

আর অসমান পা নিয়ে ব্যানানা কিকের প্রথম পুরোধা হয়ে ওঠেন ফ্রান্সিসকো ওরফে গ্যারিঞ্চা। এভাবেই তো গল্পের সাথে মিশে থাকে কত ঘাম, কত রক্ত, কত সংগ্রাম। সেই গল্পের বইয়েতে আরো একটি অধ্যায় যুক্ত হয় – রবার্তো কার্লোস। সে গল্পে কোনো নায়ক নেই। আছে পেলে-গ্যারিঞ্চা-রোনালদো-রবার্তোদের সমষ্টি। আছে তাদের গলি থেকে রাজপথের উপকথা। আর আছে সংগ্রামের কালি। দারিদ্রের চিত্রনাট্য। বিশ্বজয়ের শিরোনাম।

সে গল্পে নায়ক একজনই – ব্রাজিল। আর পেলে-রোনালদো-রবার্তোরা সেই নায়কের চরিত্র মাত্র। সে গল্প ব্রাজিলের গল্প। গল্প হলেও সত্যি!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...