যখন বোলার ছিলেন

মাথায় একটা ব্যান্ড বেঁধে দূরন্ত গতিতে ফাস্ট বল করবেন, এমন স্বপ্ন নিয়ে চেন্নাই এমআরএফ ফাউন্ডেশনে গিয়েছিলেন ১৯৮৭ সালে। সেখানকার ইনচার্জ ডেনিস লিলিকে ক্রিকেট দুনিয়া একটা ধন্যবাদ দিতে পারে। কারণ, কিংবদন্তি বোলার লিলি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন টেন্ডুলকারকে। বলেছিলেন, ‘তুমি বাবা ফাস্ট বোলার হওয়ার জন্য জন্মাওনি। তুমি ব্যাটিংয়েই মন দাও।’

সাল ১৯৯৩।

হিরো কাপের সেমিফাইনাল। শেষ ওভারের খেলা শুরু হবে। রীতিমতো সমুদ্রের মতো গর্জন করছে ইডেন গার্ডেন্সের ভরা গ্যালারি। নাটকের পর নাটক চলছে।

ভারত আগে ব্যাট করে করতে পেরেছিল মাত্র ১৯৫ রান; ইডেনের বরপূত্র আজাহারউদ্দিন ৯০। সেই রানকেই শেষ ওভার পর্যন্ত টেনে এনেছেন অনিল কুম্বলেরা। শেষ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের জন্য দরকার ৬ রান। উত্তেজনায় বুক চেপে অপেক্ষায় পুরো ভারত।

কিন্তু মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো, শেষ ওভারটা কাকে দিয়ে করাবেন আজহার?

কপিল দেব, জাভাগল শ্রীনাথ, মনোজ প্রভাকর, অজয় জাদেজা; সবার একাধিক ওভার করে বাকী। কুম্বলে দশ ওভার শেষ করে ফেলেছেন। মাঝ মাঠে লম্বা মিটিং। আজাহার বল এক হাত থেকে আরেক হাতে চালান করছেন। আম্পায়ার একটু অস্থির।

মিটিং ভাঙলো।

 

সবাই যার যার ফিল্ডিং পজিশনে ফিরে যাচ্ছেন। কপিল আউটফিল্ডে, জাদেজা ক্লোজ ইনে, প্রভাকর স্লিপে; তাহলে বলটা করবে কে!

ইডেন দুই পায়ে দাড়িয়ে পড়লো অবিশ্বাসে। টিভির সামনে কোটি কোটি মানুষ হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো। টুপি খুলে আম্পায়ারের হাতে দিচ্ছেন ছোটখাটো শচীন টেন্ডুলকার!

হ্যাঁ, বোলার টেন্ডুলকার।

এই ম্যাচের ফলটা কী আবার বলে দিতে হবে? আচ্ছা, এই প্রজন্মের জন্য বলে রাখা যাক যে, টেন্ডুলকারের করা সেই ৫০তম ওভার থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা মাত্র তিনটি রান বের করতে পেরেছিলেন এবং ভারত দুই রানের জয় নিয়ে ফাইনালে চলে গিয়েছিল। সেদিন ইডেন সাক্ষী হয়েছিল আরেক টেন্ডুলকারের। এই টেন্ডুলকার বল হাতেও ম্যাচ জেতাতে পারেন।

আজ আমরা বোলার টেন্ডুলকারকে নিয়ে একটু গল্প করি বরং।

ব্যাটসম্যান টেন্ডুলকারকে নিয়ে বলার তো আর বাকী নেই কিছু। সাহিত্য বলেন, চলচ্চিত্র বলেন, পুস্তক বলেন; সব কাজই প্রায় শেষ। এই আধুনিক যুগে ব্যাটিংয়ের সিংহভাগ রেকর্ড যার দখলে, তাকে নিয়ে একটু বেশি বেশি হবে, এই স্বাভাবিক। কিন্তু এই মহা মহীরূহ ব্যাটসম্যানের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে বোলার টেন্ডুলকারের জীবন।

অনেকের হয়তো বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে, বোলার হওয়ার জন্যই ক্রিকেটে এসেছিলেন টেন্ডুলকার।

মাথায় একটা ব্যান্ড বেঁধে দুরন্ত গতিতে ফাস্ট বল করবেন, এমন স্বপ্ন নিয়ে চেন্নাই এমআরএফ ফাউন্ডেশনে গিয়েছিলেন ১৯৮৭ সালে। সেখানকার ইনচার্জ ডেনিস লিলিকে ক্রিকেট দুনিয়া একটা ধন্যবাদ দিতে পারে। কারণ, কিংবদন্তী বোলার লিলি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন টেন্ডুলকারকে। বলেছিলেন, ‘তুমি বাবা ফাস্ট বোলার হওয়ার জন্য জন্মাওনি। তুমি ব্যাটিংয়েই মন দাও।’

তারপরের কথা তো আপনারা সবাই জানেন। কিন্তু যেটা জানেন না, তা হলো, বোলিংয়ের প্রতি ওই ভালোবাসাটা কখনোই যায়নি টেন্ডুলকারের। মূলত লেগস্পিন করতেন শুরুর দিকে, পরে অফস্পিনও করতেন; মাঝে মাঝে ভালোবাসার মিডিয়াম পেসটাও করতেন।

আজাহারউদ্দিন অধিনায়ক হিসেবে বেশ কাজে লাগাতেন পার্ট টাইমার টেন্ডুলকারকে। আর তার সময়েই একটা বিশ্বরেকর্ড করে রেখেছিলেন টেন্ডুলকার। বিশ্বের একমাত্র বোলার তিনি, যিনি কি না ওয়ানডেতে দু বার ৫০তম ওভারে ৬ বা তার কম রান ডিফেন্ড করেছেন!

প্রথমবার তো ১৯৯৩ সালের সেই হিরো কাপ সেমিফাইনাল। আর দ্বিতীয়বার হলো ১৯৯৬ সালের টাইটান কাপে। সেবার অস্ট্রেলিয়ার ঠিক ওই ৬ রানই দরকার ছিল। টেন্ডুলকার ৫০তম ওভারে এসে প্রথম বলেই শেষ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন।

বোলার হিসেবে আরও কিছু ছোটখাটো কীর্তি আছে এই মানুষটার।

দুনিয়ার একমাত্র বোলার যিনি নিজের বয়স ২০ বছরের কম থাকতেও আর্ন্তজাতিক উইকেট নিয়েছেন এবং বয়স ৪০ পার হয়ে যাওয়ার পরও আর্ন্তজাতিক উইকেট নিয়েছেন।

১৯৯০ সালে প্রথম ওয়ানডেতে বল করেন। সে বছরই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম উইকেট পান। ফলে কনিষ্ঠতম ভারতীয় হিসেবে আর্ন্তজাতিক উইকেট শিকারের রেকর্ড করেন। ওই বছরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৪ উইকেট নেন। আর কনিষ্ঠতম ভারতীয় ৪ উইকেট শিকারী হন।

বোলার হিসেবে টেন্ডুলকারের সেরা অস্ত্র ছিল টার্ন করাতে পারা। বিশেষত রিস্ট স্পিন যখন করতেন, তখন যে কোনো উইকেটে বল স্পিন করানোর দারুন ক্ষমতা ছিল তার। রেগুলার লেগস্পিন বা গুগলি, দুটোই দারুন টার্ন করতো। আবার অফস্পিনার হিসেবে মারাত্মক টার্নার ছিলেন না। তবে বল খুব স্কিড করাতে পারতেন। একজন মিডিয়াম পেসার হিসেবে তার প্রধান অস্ত্র ছিল কাটার।

বোলার টেন্ডুলকারকে নিয়ে বলতে গিয়ে অনিল কুম্বলে বলেছেন, ‘আমরা একসাথে ১২২ টেস্ট খেলেছি। আমি কখনো ব্যাটসম্যান হিসেবে ওর জন্য কোনো হুমকি তৈরী করতে পারিনি। তবে বোলার হিসেবে সে অনেকবার দলে আমার জায়গাকে প্রশ্নের ভিতর ফেলেছিল।’

মূলত ২০০০ পরবর্তী সময়ে মেরুদণ্ডের ইনজুরিতে বোলিংটা কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ২০০৮ সাল থেকে আর খুব একটা বল করতে দেখাই যেত না। তবে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ও শেষ ওয়ানডেতে দুই ওভার করে বল করেছিলেন।

পুরোটা ক্যারিয়ার সম্ভাবনা অনুযায়ী বল করতে পারলে পরিসংখ্যানও নিশ্চয়ই সমৃদ্ধ হতো। তারপরও অবসরের আগে ২০০ টেস্টে ৪৬ উইকেট এবং ৪৬৩ ওয়ানডেতে ১৫৪ উইকেটের মালিক হয়েছেন। দু বার ওয়ানডেতে ৫ উইকেট করে শিকার করেছেন। টেস্টে ইনিংসে ১৪ রানে ৩ উইকেট আছে তার।

ওয়ানডেতে সেঞ্চুরির সাথে ৪ উইকেট শিকার করেছেন। কোথায় জানেন?

এই ঢাকায়। ১৯৯৮ সালের মিনি বিশ্বকাপে; অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। বুঝতে পারছেন, এই লেখাটা কেনো লিখলাম? টিকিট কেটে সেই ম্যাচ দেখতে ঢুকেছিলাম ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। সে ম্যাচেও প্রিয় শিকার স্টিভ ওয়াহকে আউট করেছিলেন।

বোলার টেন্ডুলকারকে কী ভোলা যায়!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...