সেতুর জন্য অনন্ত অপেক্ষা

দুটি বাইক রাস্তায় প্রায় সমান্তরালভাবে চলছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই রানার বাইকটি দেখতে পাচ্ছেন না সেলিম। হয়তো একটু পিছিয়ে পড়েছে কিন্তু দৃষ্টির অগোচর হওয়ার মতো এত পিছিয়ে পড়ার তো কথা নয়! সেলিম বাইক নিয়ে একটু পেছনে ফিরে গেলেন। পরক্ষণে যা দেখলেন তা খুবই মর্মান্তিক।

দুপুরে একসাথে খাবার খাওয়ার জন্য ছেলের  অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন মা।

ছেলে কখন ম্যাচ শেষে বাড়ি ফিরবে সে আশায় পথ চেয়ে আছেন। সময় নদীর স্রোতের মতো পেরিয়ে যাচ্ছে। কত লোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু ছেলের দেখা মেলে না!

এই অপেক্ষার আর শেষ হলো না। আর কখনোই বাসায় ফিরলেন না সাজ্জাদুল হাসান সেতু।

তখন সবেমাত্র জাতীয় লিগে নিজের ৫০তম ম্যাচটি খেলে বাসায় ফিরেছেন সাজ্জাদুল হাসান সেতু। ফিরেই পরদিন সকালে স্থানীয় এক ম্যাচ খেলতে বাসা থেকে কিটব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে যান তিনি। ম্যাচ শেষে রিকশায় করে বাসার দিকে রওনা হতেই পেছন থেকে কে যেন ডেকে বসল। ঘাড় ঘুরাতেই সেতুর চোখে পড়ল সেলিমকে। এই সেলিম হলেন খুলনার মোহাম্মদ সেলিম যিনি বাংলাদেশ দলে উইকেটরক্ষক হিসেবে টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন।

খুলনার চুকনগরে আব্বাস নামের একজনের হোটেল খুব জনপ্রিয়। সেখানকার খাসির মাংস পুরো এলাকাজুড়ে বিখ্যাত। সেদিন সেতুকে নিয়ে দুপুরের খাবার সেখানেই সেরে নিতে চাইলেন সেলিম। এদিকে মা নিশ্চয়ই সেতুর জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তাই সেতুর মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না।

সেলিমের সাথে ছিলেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার এবং জাতীয় লিগে খুলনা বিভাগের অধিনায়ক মানজারুল ইসলাম রানা। সেলিম, রানা ও আরেক ক্রিকেটার শাওনের জোরাজুরিতে অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকে না করতে পারেননি সেতু। কিটব্যাগটা রিকশাচালককে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পাশাপশি বলে দিলেন তিনি যেন মাকে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে বলেন। পরে বাসায় ফিরে মা-ছেলে একসাথে রাতের খাবার খাবে।

সেলিম ও রানার বাইকে চড়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পথ পাড়ি দিচ্ছেন সেতু ও শাওন। শাওন বাইকের পেছন থেকে খুনশুটি করে বিরক্ত করায় পথিমধ্যে শাওনকে সেলিমের বাইকে পাঠিয়ে দেন রানা। তাই সেতু চলে আসেন রানার বাইকে।

দুটি বাইক রাস্তায় প্রায় সমান্তরালভাবে চলছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই রানার বাইকটি দেখতে পাচ্ছেন না সেলিম। হয়তো একটু পিছিয়ে পড়েছে কিন্তু দৃষ্টির অগোচর হওয়ার মতো এত পিছিয়ে পড়ার তো কথা নয়! সেলিম বাইক নিয়ে একটু পেছনে ফিরে গেলেন। পরক্ষণে যা দেখলেন তা খুবই মর্মান্তিক।

দেখলেন, রানার বাইকটি পড়ে আছে রাস্তার পাশে। একটু আগেও যাঁরা চোখের সামনে ছিলেন সেই রানা ও সেতুর নিথর দেহ পড়ে রয়েছে রাস্তায়। তাঁদের গা গড়িয়ে পড়া রক্তে রঞ্জিত সে রাস্তা। দুঃখজনকভাবে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় রানার। অন্যদিকে গুরুতর আহত সেতুকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও হয়নি শেষরক্ষা।

২০০৭ সালের ১৬ মার্চ নিভে যায় সাজ্জাদুল হাসান সেতু ও মানজারুল ইসলাম রানার প্রাণপ্রদীপ। মাত্র ২২ বছর বয়সে রানা ও ২৮ বছর বয়সে সেতুকে ছেড়ে যেতে হয় এই ধরাধাম। খুব সম্ভবত একটি দ্রুতগামী অ্যাম্বুলেন্সের সাথে বাইকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে মৃত্যু হয় তাঁদের দুজনের।

মানজারুল ইসলাম রানা জাতীয় দলে খেললেও খেলতে পারেননি সাজ্জাদুল হাসান সেতু। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে সেতুর অবাধ বিচরণ ছিল। সেতু ছিলেন একজন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। খুলনা বিভাগের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলতেন তিনি।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৫০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেন সেতু যেখানে তিনটি শতক ও ১২ টি অর্ধশতকে সংগ্রহ করেন ২৪৪৩ রান। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে ধানমন্ডি ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও সিটি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন তিনি। একটি শতক ও দুটি অর্ধশতকে লিস্ট ‘এ’ ক্যারিয়ারে ৩৯ ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ৬৮০ রান।

মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও সেতু বলেছিলেন বাসায় ফিরে মাকে নিয়ে একসাথে রাতের খাবার খাবেন। কিন্তু সে খাওয়া আর হলো কোথায়! তার আগেই যে মায়ের মমতার মায়া ত্যাগ করে চিরতরে হারিয়ে গেলেন সাজ্জাদুল হাসান সেতু।

সেতুর বন্ধু মানজারুল ইসলাম রানার খুব ইচ্ছা ছিল একদিন লাল-সবুজের জার্সি গায়ে বিশ্বকাপে খেলার। ওয়েস্ট ইন্ডিজে তখন চলছিল বিশ্বকাপ,  বাংলাদেশ দলে সুযোগ পাননি রানা। যদিও বন্ধু মাশরাফির আশ্বাসে একদিন না একদিন বিশ্বকাপ খেলার সে স্বপ্ন মুছে ফেলেননি তিনি। কিন্তু সে স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত হতে দিলো না এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা।

ওই দুর্ঘটনার পর একে একে চৌদ্দটি বছর কেটে গেল। সেতু ও রানা আজ আমাদের মাঝে কেবল ছবি হয়ে রয়েছেন। সন্তান হারানোর কষ্টে সেতুর মা এখনো ডুকরে কাঁদেন। সেতুর মৃত্যুর দুই বছর পর নিজের স্বামীকেও হারান তিনি। এতে অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল হয়ে পড়ে সেতুর পরিবার।

সেতুর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী আরেকটি বিয়ে করেন। সংসারে একা হয়ে যান সেতুর মা। বিগত চৌদ্দ বছর ধরে ছোট ছেলের স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে একাই বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এ লড়াইয়ে সঙ্গী হিসেবে পাশে পাননি কাউকে। সেতুর মৃত্যুর পর যে বিভিন্ন অনুদান আসছিল সেগুলো পেয়েছিলেন সেতুর স্ত্রী। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় টেলিভিশন প্রতিবেদনে সেতুর মাকে আক্ষেপ করতেও দেখা গিয়েছে। কারণ তাঁর খোঁজ-খবর নিতে যে কেউই আসেন না।

জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার আতহার আলী খান ও হাবিবুল বাশার একসময় সেতুর বাসায় আসতেন, খোঁজ নিতেন। কিন্তু নানা বাস্তবতায় এখন সেটাও সম্ভব হয়ে ওঠে না।

বর্তমানে বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন সাজ্জাদুল হাসান সেতুর মা। এর আগে ইতালিতে বড় ছেলে মাসুদুল হাসান মিতুর কাছে গিয়ে হৃদপিণ্ডে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন তিনি। সেখানে বড় ছেলে মাকে নিজের কাছে রেখে দিতে চাইলেও থাকেননি মা। থাকবেন কী করে! সেতুর পোশাক, ছবি, ক্রিকেটের সরঞ্জাম সবই যে খুলনার বাসায় পড়ে রয়েছে!

সেতুর স্মৃতিগুলোকে অবলম্বন করে আজও একাই লড়ে যাচ্ছেন মা। এই স্মৃতিগুলো নিয়েই এখন বাঁচতে চান তিনি, কাটিয়ে দিতে চান বাকি জীবনটা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...