নি:সঙ্গ যুদ্ধের আলিঙ্গনে…

চন্দরপলের ব্যাটিং দেখা কোনো দর্শনীয় বা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ছিল না কখনোই। টেকনিক্যালি সাউন্ড তিনি নন। ব্রায়ান লারার মত অমিত প্রতিভা নিয়ে হাজির হননি। ক্রিস গেইলের মত দানবীয় ব্যাটিংও করতেন না তিনি। তবে, তিনি লড়াইটা করতে পারতেন। সেটা করেই টেস্টে ১১ হাজারের ওপর রান করেছেন তিনি টেস্টে। 

২০০৮ সাল। শেষ দু’বলে জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের দরকার ১০ রান। বোলিংয়ে আছেন শ্রীলঙ্কার ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার চামিন্দা ভাস। ব্যাটিংয়েও এমন একজন আছেন যিনি আসলে ৩০-৪০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করে উইকেটে টিকে থাকার জন্য বিখ্যাত।

সবাই ধরে নিল, যাক এবার আর হচ্ছে না। কিন্তু, সবার চোখ ছানাবড়া বানিয়ে উইকেটের সেই ‘সুপার গ্লু’ই বাজিমাৎ করলেন। এক চার ও এক ছক্কায় নিশ্চিত করলেন জয়।

স্ট্রাইক রেটের সাথে সাথে আরেকটা কারণেও বিখ্যাত ছিলেন এই ভদ্রলোক। সেটা হল তাঁর ভূতুড়ে ব্যাটিং স্ট্যান্ট। ব্যাটে লেগে থাকা লাল বলের ছোপ ছোপ দাগ, চোখের নিচে কালো দাগ, ক্রিজের মধ্যে বেল দিয়ে ঠোকা দিয়ে গার্ড নেওয়া – ভদ্রলোককে চিনতে আর কিছু প্রয়োজন হয় না।

হ্যাঁ, ভারতীয় বংশদ্ভুত সেই ক্রিকেটারটি হলেন শিবনারাইন চন্দরপল। বাঁ-হাতি এই ব্যাটসম্যানের সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল তাঁর ধৈর্য্য আর স্থায়িত্ব। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে ৮২ জন ভিন্ন ভিন্ন ব্যাটসম্যানের সাথে ২২ গজে মোট ৭৫০ টি জুটির সাথে জড়িত। এটা ক্রিকেটের ইতিহাসেই বিরাট একটা রেকর্ড। দ্বিতীয় স্থানে থাকা রাহুল দ্রাবিড় ৭৩৮ ও তৃতীয় স্থানে থাকা শচীন টেন্ডুলকার ৬৭৫ টি জুটির সাথে জড়িত।

এমনকি নন-স্ট্রাইকিং এন্ড থেকে চন্দরপল ৫০০ বার কোনো ব্যাটসম্যানের বিদায় দেখেছেন। এটাও অনবদ্য একটা রেকর্ড। চন্দরপলের মনো:সংযোগ ছিল ইস্পাতদৃঢ়। ২৬৬ টি ইনিংস খেলে ফেলার পর টেস্টে তিনি প্রথমবারের মত স্ট্যাম্পিংয়ের শিকার হন ২০১৪ সালের জুনে। ততদিনে টেস্ট ক্যারিয়ারের বয়স ২০ বছর হয়ে গিয়েছে।

ধীর-স্থীরতার প্রতীক হলেও কখনো কখনো চন্দরপলও দানবীয় হয়ে উঠতেন। ২০০২-০৩ মৌসুমে গায়ানায় অস্ট্রেলিয়া দলের বিরুদ্ধে মাত্র ৬৯ বলে তিন অঙ্কের ম্যাজিকাল ফিগারে পৌঁছান তিনি। সেটা সে সময়ে টেস্টের চতুর্থ দ্রুততম সেঞ্চুরি ছিল।

চন্দরপলের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসটা ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে। ২০১২ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের বিপক্ষে ২০৩ রান করে অপরাজিত থাকেন তিনি। ২৭২ বলের ইনিংসে ছিল ২২ টি চার। আর ওয়ানডেতে তার সেরা ইনিংসটি আসে ১৯৯৯ সালে সেবার বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে লন্ডনে ১৫০ রান করেন তিনি।

চন্দরপলের ব্যাটিং দেখা কোনো দর্শনীয় বা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ছিল না কখনোই। টেকনিক্যালি সাউন্ড তিনি নন। ব্রায়ান লারার মত অমিত প্রতিভা নিয়ে হাজির হননি। ক্রিস গেইলের মত দানবীয় ব্যাটিংও করতেন না তিনি। তবে, তিনি লড়াইটা করতে পারতেন। সেটা করেই টেস্টে ১১ হাজারের ওপর রান করেছেন তিনি টেস্টে।

অথচ, খুব ‘অযৌক্তিক’ উপায়ে চন্দরপলের ক্যারিয়ারটা শেষ করে দেওয়া হয়েছে।  ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রস আইলেটে বাংলাদেশের বিপক্ষে দুই ইনিংসে ৮৪ ও ১০১ রান করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পরের সিরিজ থেকে দু:সময় শুরু হয়। করেন মাত্র একটা হাফ সেঞ্চুরি।

এর পরের সিরিজটা ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সেখানে একটাও হাফ সেঞ্চুরি না থাকায় আজীবনের জন্য নির্বাসিত হন চন্দরপল। আদৌ আর ফিরতে পারেননি চন্দরপল।

চন্দরপলের লড়াইটা আধুনিক ক্রিকেটের জমানায় বিস্ময়কর এক ঘটনা। ২০১৭ সালে তিনি নিজের ছেলে ত্যাগ নারায়ন চন্দরপলের সাথে গায়ানার হয়ে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ব্যাটিং পর্যন্ত করেন। আসলে চন্দরপল অসামান্যই ছিলেন, তিনি এতটাই সাদামাটা মেজাজে অসাধ্য সাধন করেছেন বলে বরাবরই তাকে ‘আন্ডাররেট’ করা হয়েছে।

মজার একটা তথ্য দিয়ে শেষ করি, চন্দরপল এমন একজন ব্যাটসম্যান যার আধুনিক ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে কোনো গ্রহনযোগ্যতা নেই। তবে, মজার ব্যাপার হল চন্দরপল ২০০৮ সালে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) প্রথম আসরে তিনি তিনটা ম্যাচ খেলেন র‌য়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে। ২০১২ সালের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) খেলেন খুলনা র‌য়্যাল বেঙ্গলসের হয়ে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...