ডন-নৈবদ্য

ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে নামার আগে ওনার ব্যাটিং ছিল ১০১। মাত্র ৪ রান হলে তা অন্তত ১০০ হয়। এরপরের গল্প, ক্রিকেটের বিখ্যাত শূন্য রানের ইনিংসের গল্প, জানেনা এমন মানুষ পাওয়া যাবেনা। ম্যাচ শেষে উনি বলেছিলেন, ‘গড়ের এই ব্যাপারটি আমার জানা ছিলনা। আমার মনে হয় ইংলিশরাও জানতো না। জানলে ওরা অবশ্যই আমাকে চারটে রান করতে দিত!’

১৯২৮ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে পাঁচ ডিসেম্বর।

পৃথিবীতে ঠিক কী কী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল তা ঠিক না জানা গেলেও ব্রিসবেনের এক্সিবিশন গ্রাউন্ড এমন কিছুর সাক্ষী হলো, যার প্রভাব থেকে ক্রিকেট নামক খেলাটি আর বের হতে পারলো না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবার পা রাখলেন একজন।

ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষ তিনি। মাঠে এবং মাঠের বাইরে – তাঁর মত আর কেউ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। মনে হয়না, কেউ কখনো পারবে। ৯৯.৯৪ কোথাও ভেসে উঠলে আলাদা করে আর নাম বলতে হয় না, ক্রিকেট জানে এরকম যে কেউ বুঝে যায় কার কথা বলা হচ্ছে।

১৯০৮ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের ছোটখাটো এক গ্রাম কুটামুন্দ্রায় তার জন্ম। বেড়ে ওঠা বাউরালে। গলফ বল আর একটা স্ট্যাম্প- পানির ট্যাংকিতে একা একা ব্যাটিং অনুশীলন করতেন। প্রথাবিরোধী গ্রিপের শুরু তখন থেকেই। ১৯২১ সালে বাবার সাথে সিডনিতে অ্যাশেজ টেস্ট দেখতে গিয়ে বলেছিলেন, এই মাঠে আমি একদিন খেলবই। তা এমন উচ্চাশা তো কত শিশু, কিশোরেরই রয়, কথা রাখতে পারে কজন। উনি রেখেছিলেন। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সাথে তার আত্মা জুড়ে গিয়েছিল হয়ত সেদিনই। ক্রিকেট বিশ্ব তার প্রমাণ পেয়েছিল আরো পরে।

এরপরের গল্প ক্রিকেটরাজ্যে সর্বজনবিদিত। ১৯ বছরেই রাজ্যদলের হয়ে প্রথম শ্রেণির অভিষেক। নেমেই করলেন সেঞ্চুরি। সব মিলিয়ে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে তাঁর ক্যারিয়ার – ২৩৪ ম্যাচ, রান? ২৮ হাজারেরও বেশি।

টেস্ট দলে ডাক পেলেন। টাইমলেস টেস্টের চলন, যেসময়ের কথা শুরুতেই বলা হলো। দুইদিন ক্রিকেট আর একদিনের রেস্টডে’র পরে ব্যাটিং এর সুযোগ পেলেন। ১৮, ১ রান করলেন দুই ইনিংসে। দল হারলো ৬৭৫ রানের অবিশ্বাস্য ব্যবধানে! বাদ পড়লেন। (হ্যা, উনিও ড্রপড হয়েছিলেন, ওই একবারই।) সিরিজের তৃতীয় টেস্ট মেলবোর্নে, ফিরেই সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ানের রেকর্ড গড়লেন।

১৯৩০’র অ্যাশেজে যাবেন ইংল্যান্ডে। মাত্রই প্রথম শ্রেণীতে রেকর্ড ৪৫২* রানের ইনিংস খেলেছেন। কথার লড়াইয়ের অংশ হিসেবে এক ইংলিশ অলরাউন্ডার বললেন, ‘তাকে আউট করতে খুব একটা বেগ পেতে হবেনা। ছোড়া একই ভুল বার বার করে, নিজেকে বদলায় না।’ ওই সিরিজে উনি লাঞ্চের আগে সেঞ্চুরি করেছেন, একদিনে তুলেছেন ৩০৯ রান! পুরো সিরিজে ১৩৯ গড়ে রান করলেন ৯৭৪! এক সিরিজেই ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচসহ ২,৯৬০ রান! ইংলিশরা চিনল ২২ বছরের, ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার এই বিস্ময়কে। চিনলো পুরো বিশ্ব।

১৯৩২/৩৩ অ্যাশেজ। ইংলিশ অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিন তাঁকে আটকানোর জন্যে এক ‘কুখ্যাত’ উপায় বেছে নিলেন। হ্যারল্ড লারউড, বিল ভোসদের সাথে নিয়ে আঁকলেন ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত সিরিজের চিত্রনাট্য। বডি লাইন সিরিজ! লেগ সাইডে প্রায় সব ফিল্ডার সাজিয়ে, টানা তার শরীরে বল করে গেলো ইংলিশ দীর্ঘদেহী পেসাররা। তাকে ‘আটকানো’ গেল, অস্ট্রেলিয়া হারলো বাজেভাবে সে সিরিজ। (তাঁর গড় মনুষ্যসম হয়ে উঠল, ৫৭!)
পরের সিরিজেই তিনি ইংল্যান্ডের মাটিতে অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করেন, যা ইংলিশরা আর কখনোই নিতে পারেনি যতদিন এই লোকটা ছিলেন ক্রিকেট মাঠে।

ওই সিরিজের শেষে লোকটা ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। লম্বা এক অপারেশনের দরকার হয়, ইংলিশ ডক্টররা তার কন্ডিশন ‘ক্রিটিক্যাল; হিসেবে ঘোষণা দেন। অপারেশনের জন্যে ব্লাড লাগবে জানতে পেরে হসপিটালে এত মানুষ এসেছিল যে কতৃপক্ষ তা সামলাতে হিমশিম খেয়ে যায়! রাজা থেকে শুরু ইংল্যান্ডের (তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের) সমস্ত মানুষ তার জন্যে প্রার্থনায় বসে। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসেন তিনি। প্রায় শত্রু বনে যাওয়া প্রবল প্রতিপক্ষের মাটিতে আর কেউ কোনদিন এত ভালবাসা পেয়েছিল?

ফর্মের চূড়ায় ছিলেন, পৃথিবীর বুকে নেমে এল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের অংশ হলেন, আর্মির ফিজিক্যাল টেস্টে দেখা হল তাঁর ‘আই সাইট পুওর!’ সাথে ধরা পড়ল আরো কিছু অসুখ। এসব নিয়ে উনি ক্রিকেট কিভাবে খেলেছেন, তা এক মিথে পরিণত হয়।

১৯৪৬ সালে আবার ফিরলেন ক্রিকেট মাঠে। ততদিনে বয়স আটত্রিশ। ৮ বছরের লম্বা বিরতি দিয়ে ফিরেই উনি খেললেন ১৮৭ রানের এক ইনিংস। যুদ্ধের আগে ওনার গড় ছিল প্রায় ৯৮, পরে ১০৫.৭২!

ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে নামার আগে ওনার ব্যাটিং ছিল ১০১। মাত্র ৪ রান হলে তা অন্তত ১০০ হয়। এরপরের গল্প, ক্রিকেটের বিখ্যাত শূন্য রানের ইনিংসের গল্প, জানেনা এমন মানুষ পাওয়া যাবেনা। ম্যাচ শেষে উনি বলেছিলেন, ‘গড়ের এই ব্যাপারটি আমার জানা ছিলনা। আমার মনে হয় ইংলিশরাও জানতো না। জানলে ওরা অবশ্যই আমাকে চারটে রান করতে দিত!’

লোকটা রসিক ছিলেন। ছিল অসম্ভব মনে রাখার ক্ষমতা। কবে কোথায় কোন ইনিংস কিভাবে খেলেছেন, সব বলে দিতে পারতেন, শেষ বয়সেও। ক্রিকেট দিয়ে পেট চলতোনা, ক্রীড়াসামগ্রীর এক দোকানে কাজ করেছেন, যেখানে কিনা তারই সাইন করা সুভ্যেনির চড়া দামে বিক্রি হয়। প্রেসে কাজ করেছেন। কলাম লিখেছেন। লিখেছেন বই। সংগীত অসম্ভব টানতো, পারতেন পিয়ানো বাজাতে। এতটাই খ্যাতি ছিল এক সময় বীতশ্রদ্ধ হয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। তার ছেলে নিজের নামের শেষ অংশ বদলে ফেলেছিল কিছুদিনের জন্যে, বাবার খ্যাতির বিড়ম্বনা তাঁকে এতটাই জাপটে ধরেছিল।

দেশের প্রেসিডেন্ট নিজে তাকে ‘গ্রেটেস্ট লিভিং অস্ট্রেলিয়ান’ উপাধি দেন। রিচি বেনো বলেছিলেন, ‘সে সম্ভবত সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ট্রেলিয়ান!’ লক্ষণীয়, এখানে তাকে কিন্তু শুধু শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটারের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের ‘ডিপ্রেশন পিরিয়ডে’ এই লোককে মাঠে দেখতে এক সিরিজে সব মিলিয়ে প্রায় ৯ লাখ লোক মাঠে এসেছিল। উনি ব্যাট হাতে কারিশমায় হাসি ফোটাতে পারতেন মানুষের মুখে।

তার জীবনের গল্প এত ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে ধরা অসম্ভব। প্রতিটি পরতে পরতে বিস্ময় জমিয়ে রেখেছিলেন। রান আউট, হিট উইকেট হয়েছেন মাত্র একবার, কখনোই স্ট্যাম্পিং হননি, ছক্কা মেরেছেন মাত্র ৬টি; কারণ বাতাসে খেললে আউট হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়- অথচ উনি রানই করতেন বাউন্ডারিতে! আনঅফিশিয়াল এক ম্যাচে ২২ বলে সেঞ্চুরিও আছে!

তাকে নিয়ে অসংখ্য শংসাবচনের মধ্যে ইতিহাসে সর্বপ্রথম ৩০০ উইকেট নেওয়া ফ্রেড ট্রুম্যানের কথাগুলি হুবহু তুলে দেওয়ার লোভ সামলানো গেলনা, ‘The scene is an Ashes test. The Australian openers are in the middle, I run upto the wicket and rap the batsman on the pads. Howzat? He’s gone, and the score is zero for one.
The next batsman walks in, I knock his stumps over. Score is zero for two. Next walks in this FELLOW. I have to do my best, I run into the wicket and hurl the ball. This FELLOW hits it high in the air and it’s a magnificent catch at long on. Score is three hundred and seventy six for three!’

উইনস্টন চার্চিল এই ‘ফেলো’কে দেখেই বলেছিলেন, ‘Isn’t that him over there? I would like to be introduced.’ লোকটার নাম ব্র‍্যাডম্যান, স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র‍্যাডম্যান।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...