কলার উঁচিয়ে তেড়েফুঁড়ে আসা সেই স্পর্ধা

কলার উঁচিয়ে তিনিই প্রথম চোখ রাঙানোর স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। নবীন টেস্ট খেলুড়ে দেশের ক্ষুদে এক দুরন্ত পেসার যে বিশ্বসেরাদের উইকেটও উপড়ে ফেলতে পারেন, সেটা এই মাশরাফির সুবাদেই প্রথম টের পেয়েছিল বিশ্ব। মাশরাফিই প্রথম বিশ্বকাপ ফেবারিটদের বলতে পেরেছিলেন, ‘ধরে দিবানি!’ প্রখর নেতৃত্বগুণে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বসেরা না হোক, যেকোন কন্ডিশনে সমীহ করার মত শক্তিতে পরিণত করেছিলেন। জয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে বুকে সাহস লাগে। বুকে এই সাহসটা দিয়ে যাবার জন্য ধন্যবাদ মাশরাফি।

২০১৮ সাল। গেলো বছর এশিয়া কাপের ফাইনাল ম্যাচ। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে বাংলাদেশের ওপেনিং ব্যাটসম্যান সবাই-ই চূড়ান্ত ফ্লপ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে হাতের ইনজুরিতে পরে পুরো টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে গিয়েছিলেন দেশসেরা ওপেনার তামিম ইকবাল। টুর্নামেন্টের মাঝখানে যখন তামিমের রিপ্লেস হিসেবে তারই বহুদিনের ওপেনিং পার্টনার কায়েস কে নেয়া হলো তখন তিনি পুরোদস্তুর মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান।

দলের ইনিংস শুরু করবেন কে সেটা নিয়ে বাংলাদেশ দলের ক্যাপ্টেনের কপালে চিন্তার ভাজ। ভারতের সাথে ফাইনাল ম্যাচ পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনে ক্যাপ্টেন জানিয়েছিলেন চমকের কথা। বাংলাদেশ দল ব্যাটিংয়ে, তরুণ সম্ভাবনাময় লিটনের সাথে ওপেনার পার্টনার হিসেবে আনকোরা মিরাজকে দেখে আর সবার মতো আমারও চক্ষু চড়কগাছ।

বয়সভিত্তিক দলে মিরাজ মিডল অর্ডারে ব্যাট করার অভিজ্ঞতা ছিলো। কিন্তু ইনিংসের গোড়াপত্তন করতে নামবেন, সেটাও আবার এশিয়াকাপের মতো হাইভোল্টেজ ফাইনালে! মেহেদী মিরাজ নিজেও হয়তো ভাবেননি! কিন্তু একজন ঠিকি ভেবেছিলেন। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে ওপেনিং জুটির বেহাল দশা। ক্যাপ্টেনের বিশ্বাসকে শক্তিতে রুপান্তর করে লিটন-মিরাজ জুটি সেদিন করেন আসরেরই সর্বোচ্চ রানের জুটি।

লিটন খেলেন এখন অবধি তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। টানা ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া লিটন যখন সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ইশারায় ক্যাপ্টেন কে ধন্যবাদ জানান, আর ড্রেসিং রুমের দরজায় দাঁড়ানো ক্যাপ্টেন যখন বুকে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করেন ইনিংস লম্বা করে আসার, তখনও জিতে যায় বাংলাদেশ, জিতে যায় শতকোটি ক্রিকেটপ্রেমী।

নব্বইয়ের দশকে ফুটবলের জোয়ার ছাঁপিয়ে ক্রিকেটের ঢেউ আছড়ে পড়েছিলো এই বদ্বীপে। যে ক’জন উঠতি বয়সী ছেলেপুলে খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার কতো তাদের অধিকাংশই ছিলো ফুটবলে আসক্ত। এদেশে ক্রিকেটের সূচনালগ্নে ঢাকা এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলো থেকে উঠতি প্রতিভারা উঠে আসতে শুরু করলো ঢাকা লিগে। তবে ঢাকা থেকে ২১৪ কিলোমিটার দূরের নড়াইল তখনও এই ঢেউ থেকে বেশ দূরেই ছিলো। সেখানের শান্ত জনপদে শুধু চিত্রার নিরন্তর প্রবাহ। অতদূর থেকে একটা ছেলে এসে বিশ্বক্রিকেট দাপিয়ে বেড়াবেন, শরীর-মন সবকিছুর সাথে যুদ্ধ করে দেশের ক্রিকেটে মহীরুহ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবেন সেটাই হয়তো কল্পনাতীত ছিলো।

জেলাটা পরিচিত ছিলো চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের কারণে। মাটি, মানুষ আর সমসাময়িক জীবনের ছবি অঙ্কিত হতো যার তুলির আঁচড়ে। সেই শহরটা এখন মাশরাফির নামে পরিচিত হয়! নব্বইয়ের শেষে কিশোর ছেলেটার ভাবনার জগতের দূরতম আকাশেও কি এতটা কল্পনা ছিলো? কে জানে!

মাশরাফির বেড়ে ওঠা নড়াইলের ছোট্ট চিত্রাপাড়ে, নদীর জল গায়ে মেখে। কৌশিকদের বাড়ি আর চিত্রার মাঝে ছোট্ট একটা পায়েচলা পথ, সেটা ধরে দৌড়ে এসে বন্ধুদের সাথে চিত্রায় আছড়ে পড়তেন ছোট্ট কৌশিক। দুরন্ত ছেলেটার প্রধান কাজ ছিল দলবল নিয়ে চিত্রায় ঝাঁপ দেয়ার জায়গাগুলো খুঁজে বের করা।

কখনো বিপজ্জনক পথেও হাঁটা হয়েছে; বেড়িবাঁধ থেকে খেজুর গাছ, কিংবা নতুন ব্রীজ থেকে নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো- আমাদের অধিনায়কের দুরন্ত কৈশরের সাক্ষী ছিল এরা সবাই, পুরো নড়াইল শহরটাই। একবার তো দুটো বিশাল বজরার মাঝে চোরাবালিতেও এক বন্ধুসহ ডুবে যাচ্ছিলেন। ভাগ্য সেবার সুপ্রসন্ন ছিল, নিয়তি হয়তো ঠিক করেই রেখেছিল পোর্ট অফ স্পেনে শেবাগের স্ট্যাম্পের ছত্রখান মাশরাফির হাতেই ঘটবে- তাই কৈশোরের দুরন্তপনা বাধা হতে পারেনি কোথাও।

কৌশিক নামের ছেলেটা তখন মাঠে দাপিয়ে ক্রিকেট খেলেন, বর্ষায় ফুটবল নিয়ে নেমে পড়েন। তবে প্রতিভার সবটুকু বিচ্ছুরণ দেখা যায় চিত্রায় সাঁতার কাটার ব্যাপারে। আর রাতে নদীর বুকে নৌকা নিয়ে ছোটার বেলায় তো কথাই নেই! সেখানে কৌশিক অবিসংবাদিত চ্যাম্পিয়ন। কিন্ত মাশরাফির জন্ম তো চিত্রার বুকেই সীমাবদ্ধ থাকার জন্যে হয়নি, তাঁকে যে দেশের মানচিত্র ছাপিয়ে বিশ্ব-দরবারে নিজের নামটা লিখে দিতে হবে! সেই স্বপ্নের শুরুটা হলো অনূর্ধ্ব-১৭ দলের ট্রায়ালে ডাক পাবার পরেই। সেখান থেকেই ব্যাট-বলের এই খেলাটাকে সিরিয়াসলি নেয়া।

এই ভূখণ্ডে পেস আক্রমণের শুরুটা হয়েছিলো দৌলত-উজ-জামান আর আলতাফ হোসেন নামের দুই ভদ্রলোকের হাত ধরে। পেসারদের বধ্যভূমি এই বঙ্গদেশে কাজটা সহজ ছিলো না মোটেও। ষাটের দশকের বিস্মৃত স্মৃতি সেটা, বাংলাদেশ নামের দেশটার জন্মও হয়নি তখন। সত্তরের দশকে সেই মশালটা বয়ে নিয়েছেন জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা- কারো কারো মতে যিনি এই বঙ্গের সর্বকালের সেরা পেসার। উদীতি ক্লাবের হয়ে একাই শক্তিশালী পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টকে হারিয়ে দিয়েছিলেন যিনি, যে পাবলিক ওয়ার্কসে খেলতেন সে সময়ের নামজাদা সব খেলোয়াড়, কেউ কেউ ছিলেন জাতীয় দলের অংশও!

পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্ব একাদশের দলেও ডাক পেয়েছিলেন, মহসিন খান, জাভেদ মিঁয়াদাদ আর সেলিম মালিকের মতো ব্যাটসম্যানেরা ছিলেন তাঁর শিকার। বাদশার দেখানো পথে হেঁটে এসেছেন হাসিবুল হোসেন শান্ত, বিকাশ রঞ্জন দাশ, মঞ্জুরুল ইসলাম, এবং বিংশ শতাব্দীতে যে ব্যাটনটা হাতে পেলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা।

সময়টা একবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ারের উড়ন্ত স্ট্যাম্পের ছবিটা গুগলে খুঁজেও পাওয়া যায় না। কিন্ত বাংলাদেশের শুরুর সময়ের ক্রিকেট প্রেমীদের স্মৃতিতে সেটা আমরণ সতেজ থাকবে। ব্যাটিংয়ে বরবারের মতোই কলাপ্স, বাংলাদেশের ব্যাটিং বিপর্যয়ে থমকে যাওয়া দর্শকদের উল্লাস রূপ নিলো গর্জনে, হিথ স্ট্রিক আর ব্রায়ান মারফিকে আউট করে অভিষেক ইনিংসেই চার উইকেট ঝুলিতে পুরলেন নড়াইল এক্সপ্রেস, হাত ঘুরিয়েছিলেন বত্রিশ ওভার। বৃষ্টি বিঘ্নিত সেই ম্যাচে তার ঝুলিতে ১০৪ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট। এর আগে যিনি কখনও ইনিংসে ষোল ওভারের বেশি বোলিংই করেননি, তাঁর জন্যে এটা ম্যারাথন স্পেলই ছিল।

টগবগে তরুণ, ক্রিকেটের এই রাজসিক ফরম্যাটে খেলার অভিজ্ঞতা ছিলো না বললেই চলে! লংগার ভার্সনের মাত্রারিক্ত প্রেশার, অনুমিতভাবেই আঘাত হানলো ইনজুরি। অভিষেকের দু’মাস পরেই কাঁধ আর পিঠের ইনজুরিতে পড়লেন। তার মাসতিনেক পর বিদ্রোহ করলো হাঁটু। ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারের অনেকগুলো পাতা মাশরাফিময় হতে পারেনি শুধু এই ঘাতক ইনজুরির থাবায়।

২০০৩ বিশ্বকাপ। আবার সেই ইনজুরি, দুই ম্যাচ খেলেই আবার মাঠের বাইরে, এই দফায় থাকতে হলো বারো মাস। অভিষেকের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় শতাধিক ওয়ানডে ম্যাচ মিস করেছেন ইনজুরীর কারণে, ২০০৯ সালের পর তো প্রিয় সাদা পোশাকে মাঠে নামার আশা ছেড়েই দিয়েছেন। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-ভারতজুড়ে এই আহত শরীর নিয়ে ছুটতে হয়েছে মাশরাফিকে, বেশিরভাগ সময়েই একা।

২০১১ বিশ্বকাপের তখনো অনেকদিন বাকি। আবাহনীর হয়ে ঘরোয়া কাপে খেলতে গিয়ে হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ল, পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় ফিট হয়েও উঠছিলেন মাশরাফি। যদিও কোচ জেমি সিডন্স শতভাগ ফিট মাশরাফিকেই চেয়েছিলেন, সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আপাতত মাশরাফিকে ভাবনার বাইরে রেখেই দল সাজাচ্ছেন তিনি। মাশরাফির অনুপস্থিতিতে ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড পড়া সাকিব তখন নিজেকে বিশ্বসেরা হিসেবে প্রমাণের পণ করেছেন। দেশের ক্রিকেটের আরেক মহারথী লড়াই করছেন ইঞ্জুরির সাথে। যে ইনজুরি কেড়ে নিয়েছে তার ক্যারিয়ারের অনেকটা সময়।

ভয় ছিলো ওয়ার্ল্ডকাপে দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে। তেমনটাই হলো, বিশ্বকাপের একমাস আগে আচমকা বাজ পড়লো ক্রিকেটাঙ্গনে, প্রধান নির্বাচক রফিকুল আলম সাংবাদিকদের সামনে যখন ঘোষনা করলেন দল, দেখা গেল মাশরাফির নাম নেই তেইশ জনের স্কোয়াডে! অশ্রুসজল মাশরাফির ছবিটা হৃদয়ে গেঁথে আছে অজস্র ক্রিকেটপ্রেমীর, দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো আয়োজিত ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসরে খেলতে না পারার বেদনা কি চোখের জলে ধুয়ে যায়? না বোধহয়। ১৯ জানুয়ারির দিনটাকে মাশরাফি সেদিন বলেছিলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন, মোটেই প্রস্তত ছিলেন না এমন একটা ঝড়ের জন্যে।

বুকে পাথর বেঁধে শুভকামনা জানিয়েছেন সতীর্থদের, স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়েও অভিযোগ জানাননি কারো প্রতি। এমন কত ঝড় এসেছে, মাশরাফি নামের ছোট্ট গাছটা ততদিনে মহীরূহ, তিনি নুইয়ে পড়েননি। তাঁর তো ভেঙে পড়া চলবে না, এই মহীরূহের সুশীতল ছায়ায় যে একদিন আশ্রয় নেবে বাংলাদেশের ক্রিকেট, সেটা কি ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারী মাশরাফি ভেবেছিলেন?

২০১৪ সাল। আমাদের ক্রিকেটের জন্যেই হয়তো ছিলো ভূতুড়ে। জয় নেই, জয়ের মুখ থেকে ফিরতে হয়েছে বেশ ক’বার। এশিয়া কাপে আমাদের বাঘের ডেরায় এসে হারিয়ে গেছে আফগানিস্তানের মতো তরুণ দলও। বছরের প্রথম ন’মাসের হালখাতা চোখ কপালে ওঠার মতো, সাতাশটি আন্তর্জাতিক ম্যাচের বাইশটিতেই হারের করুন রাগিণী!

২০১৪’র সেপ্টেম্বরে হারের বৃত্তে ঘুরতে থাকা বাংলাদেশ দলটাকে যখন মাশরাফির অভিভাবকত্বে দেয়া হয়, তখন অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপ নিয়ে সমর্থকদের আশা ছিলো শূন্যের কোঠায়। এমনকি জিম্বাবুয়েকে সব ভার্সনে হোয়াইটওয়াশ করার পরেও। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের দুর্বোধ্য কন্ডিশানে খাবি খাওয়াটা উপমহাদেশীয় দলগুলোর পুরনো স্বভাব। ‘পুঁচকে’ বাংলাদেশ সেই চ্যালেঞ্জ জয় করতে পারবে, এমনটা কট্টর সমর্থকেরাও পুরোপুরি বিশ্বাস করেছিলেন কিনা সন্দেহ।

অস্ট্রেলিয়ায় চারটি প্রস্ততি ম্যাচের সবক’টিতে হার, শেষ ওয়ার্মআপ ম্যাচে আইরিশরাও গুঁড়িয়ে দিলো টাইগারদের। প্রত্যাশার পারদ তখন হিমাঙ্কের নীচে। কিন্ত মূল পর্ব শুরু হতেই পাল্টে যেতে শুরু করলো হিসেব নিকেশ। বাংলাদেশের মিডিয়ায় দৈত্য হয়ে ওঠা আফগানিস্তান হার মানলো, স্কটল্যান্ডের রানের এভারেস্ট চাপা পড়লো তামিমের ব্যাটে। তারপর অ্যাডিলেড- যে রূপকথার রূপের বর্ণনা শেষ করা যাবে না কখনও। ক্রিকেটতীর্থ মেলবোর্নে বিতর্কিত কিছু সিদ্ধান্তে শেষ আমাদের বিশ্বকাপ অভিযান, তাতে ঢাকা পড়েনি তাসমান সাগরপাড়ে গড়া গৌরবগাঁথা।

বিশ্বকাপ শেষে ঘরে ফিরলো দল, বীরের অভ্যর্থনা জানালো দেশবাসী। মাশরাফির মানসপটে ভেসে ওঠে ২০০৭, ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে ফেরার পরও তো এমন সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিলো তাঁদের! প্রিয় বন্ধু মানজারুল ইসলাম রানার মৃত্যুশোক বুকে চেপে ভারতকে বিদ্ধ করেছিলেন বল হাতে, সেবারের জয়ও কম গৌরবের ছিল না। তবে এবার যেন একটু বাড়াবাড়ি ঠেকে তাঁর চোখে।

মাশরাফি জানতেন, বিশ্বকাপের দারুণ পারফরম্যান্সও অনেকের চোখে আকস্মিক সাফল্য হয়ে যাবে, যদি নিয়মিত বড় দলগুলোর বিপক্ষে জয় পাওয়া না যায়।

মানিক মিয়া এভিনিউতে বিশাল মঞ্চ, কনসার্টের আয়োজন, আর তার ভিড়ে প্রথমবারের মতো ওয়ার্ল্ডকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে আসা ক্রিকেটারেরা। চারপাশের রাস্তাঘাট বন্ধ করে রাখা হয়েছে অনুষ্ঠানের জন্যে- এমনটা তো মাশরাফি চাননি। মাসদুয়েক পরে মিডিয়ার সাথে আলোচনায় বলেছেনও, ‘আমরা যা অর্জন করেছি, তাতে সংবর্ধনা হয়তো দেয়াই যায়, কিন্ত রাস্তা বন্ধ করে জনদুর্ভোগ তো কাম্য নয়!’ চিত্রাপাড়ের দুরন্ত ছেলেটা এখানেও নেতার মতোই কথা বলেন, নেতার মতোই ভাবেন! এই মাশরাফি নেতা হবেন না তো হবেটা কে?

বিশ্বকাপের পর অধিনায়ক মাশরাফির সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার নাম ছিলো সমর্থকদের প্রত্যাশার ফানুস। সেটা জয় করেই ঘরের মাঠে পাকিস্তানবধ হলো, ভারতও হার মানলো সিরিজে। উড়তে থাকা বাংলাদেশকে মাটির কাছাকাছি নামিয়ে আনলো দক্ষিণ আফ্রিকা; টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডে মিলিয়ে টানা তিন ম্যাচের হারে বাংলাদেশ দলে তখন ছন্দপতনের বীণা।

ঢাকায় দ্বিতীয় ওয়ানডে জিতে সিরিজে সমতায় ফিরলো স্বাগতিকরা। মাশরাফিকে সংবাদ সম্মেলনে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, এটাই কি অধিনায়ক মাশরাফির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল? মুচকি হেসে অধিনায়ক জবাব দিয়েছিলেন – ‘ছেলে মেয়ে দুটোকে গড়ে তোলার চেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ আমার জীবনে আর কিছুই নেই।’ মাশরাফির কাছে ক্রিকেটটা পেশা, হয়তো অনেকটা আবেগও জড়িত এখান; কিন্ত ক্রিকেটটাই জীবন নয়। বারবার তিনি বলে এসেছেন, দিনশেষে এটা একটা খেলামাত্র

মাশরাফি সেরা নেতা কেন? কারণ ড্রেসিংরুমে সবচেয়ে আমুদে লোকটা বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়কই। সিনিয়র থেকে জুনিয়র, কারো সাথেই বিন্দুমাত্র দূরত্ব নেই তাঁর, বিশ্বসেরা সাকিব আল হাসানের সাথে তাঁর যে সম্পর্ক, সেই একই মমতায় তিনি পাশে টেনে নেন আনকোরা মিরাজ কিংবা মোসাদ্দেককে।

মাশরাফির যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক, তাসকিন তখনও হামাগুড়িও দিতে শেখেননি বোধহয়, সেই তাসকিনের সাথে তাঁর ম্যাশকিন জুটি সমাদৃত হয়েছে বিশজুড়েই। নড়াইল থেকে একশো কিলোমিটার দূরের শহর সাতক্ষীরা, সুন্দরবনের একদম কোল থেকে উঠে এসে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন পেসার রবিউল ইসলাম। শুরুতে মাশরাফির সাথে কথা বলতেই নাকি ভয় পেতেন তিনি, আর এখন? রবিউলের সবচেয়ে বড় মেন্টরের নাম মাশরাফি!

নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ। পুরো বিশ্বকাপজুড়েই সতীর্থদের পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে গিয়েছেন মাশরাফি। দেশ থেকে বিতর্ক সঙ্গী করে নিয়ে যাওয়া রুবেল হোসেনের পাশে দাঁড়িয়েছেন বড় ভাইয়ের মতো, তাসকিনকে আগলে রেখেছেন পুরো টুর্নামেন্টে। আর ফলাফল? ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রুবেলের বিধ্বংসী দুটি স্পেল, আনকোরা তরুন তাসকিন আহমেদের দলের পক্ষে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী হয়ে ওঠা।

টিমমেটদের ভেতর থেকে সেরাটা বের করে আনার কাজ মাশরাফির মতো করে আর কেউ সম্ভবত পারেন না। ২০২০ সালে অধিনায়ক হিসেবে শেষ ম্যাচটা যেদিন খেলে ফেললেন, সেদিনও ঠিক সব সময়ের মতই অনুপ্রেরণাদায়ী ছিলেন তিনি।

৩৬ টেস্টে ৭৮ উইকেট, চল্লিশের বেশি গড়ে একজন বোলার কতটা কার্যকরী জাতীয় দলে? বোলার মাশরাফিকে পরিসংখ্যানের আলোকে মাপতে গেলে বোকামী হবে। মাশরাফি তো শুধু দলের একজন ফার্স্ট বোলার নন, মাশরাফি একটা চেতনার নাম, একটা মা্নদন্ডের নাম। ক্রিকেটের জোয়ারে ভেসে যাওয়া এদেশের আনাচে কানাচের প্রতিটা অঞ্চলের কিশোর তরুণ যুবাদের অনুকরণীয় আদর্শের নাম মাশরাফি বিন মুর্তজা।

বাংলাদেশের কিশোরেরা মাশরাফি হতে চেয়েছে, তরুণেরা মাশরাফিকে দেখে পেসার হয়েছে, জাতীয় দলের জার্সি গায়ে নড়াইল এক্সপ্রেসের মতো করে কলার উঁচিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের দিকে ছুঁড়ে দিতে চেয়েছে আগুনের গোলা। বাগেরহাট থেকে রুবেল, সাতক্ষীরার রবিউল-মুস্তাফিজ কিংবা ঢাকার তাসকিন, জাতীয় দলের এই অমূল্য রত্নরাজি উঠে এসেছে মাশরাফিকে আদর্শ মেনেই। আদর্শ নেতার মতো কখনও বড় ভাইয়ের মতো সদুপদেশে সমৃদ্ধ করেছেন এসব জুনিয়র খেলোয়াড়কে।

দেড়যুগের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলায় অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারটা যথেষ্টই সমৃদ্ধ, সেটাই বিলিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। এই মাশরাফিই আবার সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দেশের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী, সাকিবের ঝলক কিংবা মুস্তাফিজের আবির্ভাবও যাকে সেরাদের শীর্ষস্থান থেকে টলাতে পারেনি।

ওয়ানডেতে ত্রিশ ছুঁইছুঁই গড়টা চটপট বিশে নেমে আসে বাংলাদেশের জেতা ম্যাচগুলোতে। মাশরাফির দারুণ বোলিং আর বাংলাদেশের জয় যে সমার্থক শব্দ! ছোট্ট শহরের বাতাস গায়ে মেখে আসা কৌশিক নামের ছেলেটার সৌরভে পুরো দেশ মাতোয়ারা ছিল একটা সময়! বাংলাদেশের ছোট্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে আবেগী এবং সমৃদ্ধ অধ্যায়টার নাম মাশরাফি বিন মুর্তজা, আবার কখনও এই মাশরাফিই হয়ে উঠেছেন ক্রিকেটীয় ভাবমূর্তির বিমূর্ত প্রতীক।

একদিন ট্রেনিং সেশনে যোগ দিতে রিকশায় করে স্টেডিয়ামে আসছিলেন মাশরাফি। শেরে বাংলা থেকে বাসা তাঁর কাছেই, তাই রিকশাতেই যাতায়াত বেশি হয়। বিধিবাম, আচমকা এক বাস এসে ধাক্কা দিলো তাঁর রিকশাকে, পড়ে গেলেন মাশরাফি। যদিও হাতে সামান্য ছড়ে যাওয়া ছাড়া তেমন কিছু হয়নি, এক ট্রাফিক পুলিশের সাহায্য নিয়ে স্টেডিয়ামেও এসে ঢুকলেন বাংলাদেশ দলপতি।

তবে এর আগে রিকশাওয়ালাকে তার ভাঙা রিকশার ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু অর্থ দিয়ে এসেছিলেন, সেই বাস ড্রাইভারের যাতে কিছু না হয় সেই অনুরোধও করেছিলেন। আবার ২০১৬-এর এশিয়া কাপে এক আধাপাগল সমর্থক নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে মাঠে ছুটে এসেছিলেন শুধুমাত্র ম্যাশকে একবার জড়িয়ে ধরবেন বলে, আগুয়ান নিরাপত্তাকর্মীদের থাবা থেকে ভক্তকে আগলে তো রেখেছেনই, ম্যাচ পরবর্তী ব্রিফিংয়ে তাঁকে ছেড়ে দিতে অনুরোধও জানিয়েছেন। নেতা তো এমনই হন, সবদিকে যার সমান নজর থাকে!

পোর্ট অব স্পেনে ভারত বধের দিনে আমরা পেয়েছি সাকিব, তামিম, মুশফিকদের জেনারেশন। এরপর থেকে আমরা কেউ কেউ সাকিব হতে চেয়েছি, তামিম হতে চেয়েছি, মুশফিকের মতো স্লগ সুইপে বলকে সীমানাছাড়া করতে চেয়েছি, কিন্ত তাঁদের আগেও আমরা মাশরাফি হতে চেয়েছিলাম, আমাদের বয়সীদের ক্রিকেটে প্রথম প্রেমের শুরুটাই তো কলার উচিয়ে তেড়েফুঁড়ে বল ছুড়তে আসা এই কিশোরের সাথে। ক্রিকেটের বিশাল পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ নামের গ্যালাক্সীতে সবচেয়ে বড় নক্ষত্রটার নামই তো মাশরাফি বিন মুর্তজা, সবচেয়ে উজ্জ্বলতমও কি নয়? এখানেই তো শেষ নয়, লোকটা মাশরাফি বলেই হয়তো, দেখার এখনও অনেক কিছুই বাকি, লেখারও অনেক অনেক কিছুই বাকি।

কলার উঁচিয়ে তিনিই প্রথম চোখ রাঙানোর স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। নবীন টেস্ট খেলুড়ে দেশের ক্ষুদে এক দুরন্ত পেসার যে বিশ্বসেরাদের উইকেটও উপড়ে ফেলতে পারেন, সেটা এই মাশরাফির সুবাদেই প্রথম টের পেয়েছিল বিশ্ব। মাশরাফিই প্রথম বিশ্বকাপ ফেবারিটদের বলতে পেরেছিলেন, ‘ধরে দিবানি!’ প্রখর নেতৃত্বগুণে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বসেরা না হোক, যেকোন কন্ডিশনে সমীহ করার মত শক্তিতে পরিণত করেছিলেন। জয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে বুকে সাহস লাগে। বুকে এই সাহসটা দিয়ে যাবার জন্য ধন্যবাদ মাশরাফি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...