বুম বুম বুমরাহ!

ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের সৌভাগ্য যে এই বোলার তাঁদেরই সৌভাগ্য, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সামলাতে হলে অবস্থা বেগতিক হত। কি নেই তাঁর! তিনি ইন স্যুইং, আউট স্যুইংয়ে সমান পারদর্শী, আছে মারাত্মক সব বাউন্সার।  গতিও উঠে যায় ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার অবধি। তবে তাঁর বিশেষত্ব হল টো-ক্রাশিং ইয়র্কারগুলো। এই মুহূর্তে তিনি বিশ্বের সেরা রহস্যময় বোলার। রহস্যময়তার সকল অস্ত্রই তিনি লুকিয়ে রেখেছেন।

২০১৩ সাল। খুব বেশি আগের কথা নয়। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের লিকলিকে এক তরুণ পেসার বিচিত্র বোলিং অ্যাকশনের জন্য বেশ হইচই ফেলে দিলেন। ততদিনে অবশ্য অনেক চড়াই উৎরাই কাটিয়ে এসেছেন জাসপ্রিত বুমরাহ।

বয়স যখন মাত্র সাত বছর, তখন হারান বাবাকে। স্কুল প্রিন্সিপাল মা’র একার শাসন ও আদরেই তিলে তিলে বড় হন বুমরাহ। যদিও, ক্রিকেট বুমরাহর শৈশবের ভালবাসা নয়। তিনি ক্রিকেট নিয়ে সত্যিকারের সিরিয়াস হন ১৪ বছর বয়সে।

বুমরাহ প্রথম নজরে আসেন সাবেক ভারতীয় কোচ জন রাইটের। সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে বোলিং দেখে বুমরাহকে মনে ধরেছিল রাইটের। রাইট তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এই বোলিং কোথা থেকে শিখেছো?’ সদা নির্বিকার বুমরাহ জবাব দিয়েছিলেন, ‘টিভি দেখে!’

কিন্তু, বাস্তবতা হল – টিভিতে আজকাল তো বটেই কোনো কালেই এমন বোলিংয়ে কাউকে দেখা যায়নি।

২০১৩ সালটাই বুমরাহর ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল। সেবার আইপিএল অভিষেক হয়, ২০১৩-১৪ মৌসুমে অভিষেক হয় রঞ্জি ট্রফিতে। খুব বেশি সময় নেননি। ২০১৬ সালে রঙিন পোশাকে অভিষেক, সাদা পোশাকে শুরু দু’বছর বাদে।

সময়ের সাথে সাথে তিনি শুধু মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স দলেই নয়, ভারতীয় পেস বোলিংয়ের অন্যতম ভরসা নয়। নতুন বলে ও স্লগ ওভারে – যেকোনো জায়গাতেই বোলিং দক্ষতার জন্য তাঁর দিকে হাত বাড়ান অধিনায়করা। বলা হয় যেকোনো ফরম্যাটেই তিনি সময়ে সেরা পেসারদের একজন। টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি – সব খানেই তাঁর বোলিং গড় ২০-এর আশেপাশে।

মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে তাঁর সাফল্য ঈর্ষণীয়। পাঁচ বারের শিরোপাধারীরা প্রতিটা ট্রফিই জিতেছে বুমরাহ যোগ দেওয়ার পর থেকে। এর মধ্যে শেষ তিনটা এসেছে গত চার মৌসুমে। প্রতিটিতেই বড় অবদান ছিল বুমরাহ। ২০১৭ সালে তাঁর বোলিং গড় ছিল ২১.৯৫, ২০১৯-তে ২১.৫২ আর ২০২০-এ ১৪.৯৬। মানে সময়ের সাথে সাথে আরো পরিণত হয়েছেন। ফ্র্যাঞ্চাইজিটির ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী তিনি।

আপাততদৃষ্টিতে বুমরাহ বোলিং অ্যাকশন খুবই নিরীহ দর্শন। তবে বলটা তাঁর হাত থেকে বের হওয়া মাত্রই যেন আগুনের গোলায় রূপ নেয়। তিনি যেকোনো কন্ডিশনে, যেকোনো ধরণের বল দিয়ে ম্যাচের যেকোনো পরিস্থিতিতে বোলিং করতে জানেন।

তাঁর বোলিং অ্যাকশনটা একটা মায়াবী বিভ্রম সৃষ্টি করে। তাতে বিভ্রান্ত হন ব্যাটসম্যানরা। বলটা খেলার আগে দু’বার ভাবেন। একটা সময় ভাবা বন্ধ করে দেন। ততক্ষণে আম্পায়ারের আঙুল উঠে যায়। পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যাটসম্যানের দেখা আজ অবধি মিলেনি যিনি বুমরাহ রহস্য ভাঙতে পেরেছেন।

ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের সৌভাগ্য যে এই বোলার তাঁদেরই সৌভাগ্য, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সামলাতে হলে অবস্থা বেগতিক হত। কি নেই তাঁর! তিনি ইন স্যুইং, আউট স্যুইংয়ে সমান পারদর্শী, আছে মারাত্মক সব বাউন্সার।  গতিও উঠে যায় ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার অবধি। তবে তাঁর বিশেষত্ব হল টো-ক্রাশিং ইয়র্কারগুলো। এই মুহূর্তে তিনি বিশ্বের সেরা রহস্যময় বোলার। রহস্যময়তার সকল অস্ত্রই তিনি লুকিয়ে রেখেছেন।

সবই মানলাম, কিন্ত এত ছোট রান আপের রহস্যটা কি? কিচ্ছু না, স্রেফ তাঁর বাড়ির উঠানটা ছোট বলে। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি ক্রিকেট শিখেছি বাড়ির উঠানে। উঠানটা খুব বড় নয়। সর্বোচ্চ এতটুকু (আট পা) রান আপেই আমি বোলিং করতে পারতাম। এটাই কারণ, আর কিচ্ছু না।’

কে জানে, উঠানটা বড় হলে হয়তো অন্য কোনো কায়দায় রহস্যের জাল বুনতেন তিনি!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...