বর্ণবাদ-উমহাদেশ ও ক্রিকেটার পালওয়ানকার

১৯১১ সালের গ্রীষ্ম মৌসুমে অল ইন্ডিয়ান একটি দল ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল। সেই সফরে বালোই ভারতীয়দের মধ্যে একমাত্র সফল ছিলেন। অন্যপ্রান্তে ভয়াবহ অবস্থা নিয়েও বালো ওই মৌসুমে ১১৪ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন এবং শিভরাম সামারসেটের বিরুদ্ধে ১১৩ রানে অপরাজিত একটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলে ইংরেজদের সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন।বালো বেশ কয়েকটি ইংরেজ ক্লাবের লোভনীয় অফার পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁদের সবাইকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দেশে ফিরে পালওয়ানকার বালো শোষিত শ্রেণীর জন্য অনুপ্রেরণীয় এক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন।

প্রাচীন ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে, কিছু ক্রিকেটার যুগ যুগ ধরে পাওয়া জনপ্রিয়তা ও তাঁদের নিয়ে গবেষণার ফলে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন, আবার ঐতিহাসিক কিছু মহান ক্রিকেটার বড় বড় নামের আড়ালে ধীরে ধীরে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন। পালওয়ানকার বালো, এমনি একটি নাম। একসময় তিনি ক্রিকেট দিয়েই ভারতীয়দের কাছে বীরত্ব ও গর্বের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।

বালোর জন্ম ও বেড়ে উঠা পুনেতে, যেখানে তাঁর পিতা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গোলাবারুদ ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। তিনি জন্মসূত্রে ‘অস্পৃশ্য’ চামার জাতের ছিলেন, যাদের তখন ভারতে খুব নিচু চোখে দেখা হত।

তিনি ছোটবেলা থেকেই তাঁর ভাই শিভরামের সাথে তিনি পুনের একটি ক্লাবে ক্রিকেট খেলতেন ব্রিটিশ সৈনিকদের ফেলে দেয়া সরঞ্জাম দিয়ে । চামারের ছেলে হয়ে রাজার খেলা খেলে দেখানো তখন সাহসের ব্যাপার ছিল বইকী!

তাঁর জীবনের প্রথম চাকরি ছিল, পার্সি ক্রিকেট ক্লাবের পিচ রোলিং ও সোয়াপিং করা । সেইসময় তিনি মাঝে মাঝে নেটে বোলিং করার সুযোগ পেতেন। পরে যখন তিনি পুনে ক্রিকেট ক্লাবে চলে আসেন, তখন সেই সময়ের সেরা ইউরোপিয়ান-ভারতীয় ব্যাটসম্যান জি গ্রেগ তাঁর নেট বোলিংয়ে প্রতিভার স্ফুরণ দেখেছিলেন।

বালোর বল খেলতে তাঁর ভাল লাগত। বালো যখন তাঁর উইকেট নিতে পারত, তিনি বালোকে আট আনা বকশিশ দিতেন। বালো বকশিশ দ্বিগুণ করতে আরো ভাল বল করতে চেষ্টা করতেন।

যদিও তিনি বোলিং ছাড়াও বাকি অংশে খারাপ ছিলেন না, কিন্তু বালোকে ব্যাটিং দেওয়া হত না, কারণ ব্যাটিং ছিল অভিজাতদের প্রতীক – ভারতীয় বা ব্রিটিশ, অভিজাতদের হাতেই ব্যাটিং দেয়া হত। তবে তিনি ক্লাবের বাকি অন্য যাবতীয় কাজকর্ম করে বালো ব্রিটিশদের কাছ থেকে তাঁর বেতন তিনগুণ বাড়িয়ে নেন।

তাঁর চিত্তাকর্ষক বোলিং দক্ষতার কথা শহরের সকল স্থানীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লেও, কিছু গোড়া হিন্দু দলে একজন ‘চামার’ বোলারকে অন্তর্ভুক্ত করায় সন্তুষ্ট ছিল না, কারণ ক্রিকেটের নিয়মানুসারে, চামারের ছোঁয়া বল অন্য উচুজাতের বোলারের হাত দিয়ে ধরতে হচ্ছিল!

যাই হোক জি গ্রেগ একটি প্রেস ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, ভারতীয়রা এসব গোঁড়ামি ছেড়ে বালোর মত জিনিয়াসের সুবিধা ভোগ না করলে শেষপর্যন্ত তাঁরাই ঠকবেন।

এমনকি বালো হিন্দ স্কোয়াডের জন্য নির্বাচিত হলেও, তাঁকে আলাদা ভাঁড়ে চা দেওয়া হত এবং আলাদা টেবিলে পৃথক প্লেটে খেতে দেওয়া হত। কিন্তু তাঁর দারুণ পারফরম্যান্সে পুনে হিন্দ একাদশের কাছে পুনে ব্রিটিশ একাদশ পরাজিত হলে মানুষ তাকে গ্রহণ করতে থাকে।

এর পরপরই, বালো তার পরিবারের সাথে মুম্বাই চলে যান এবং তাঁর ক্রিকেট দক্ষতা সারা দেশে খ্যাতি ছড়াতে থাকে। এই সময়ে, তাঁর ভাই শিভরাম একজন হার্ডহিটার ব্যাটসম্যান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করছিলেন।

১৯০৬ সালে দুই ভাই একসাথে হিন্দু দলকে বোম্বের জিমখানাতে ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য জয় অর্জনে নেতৃত্ব দেয়। স্বদেশী আন্দোলনের চরম সময়ে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচটি কেবলমাত্র জাতীয় অনুপ্রেরণাই নয় বরং লড়াই করার মনোভাবের জন্য বিশ্বমহলেও প্রশংসিত হয়েছিল। পালওয়ানকার ভাইদের অবশেষে দলের মূল শিবিরে বরণ করে নেয়া হয়েছিল এবং বাকিদের সাথে একইসাথে খাওয়ার জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছিল।

১৯১০ সালে বোম্বে ত্রিজাতীয় টুর্নামেন্টে হিন্দু, পার্সিস এবং ইউরোপীয়রা অংশ নেয় – পালওয়ানকার ভাইদের তৃতীয় পালওয়ানকার ভাইথাল হিন্দ স্কোয়াডে তাঁর ভাইদের সাথে যোগ দেন।

১৯১১ সালের গ্রীষ্ম মৌসুমে অল ইন্ডিয়ান একটি দল ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল। সেই সফরে বালোই ভারতীয়দের মধ্যে একমাত্র সফল ছিলেন। অন্যপ্রান্তে ভয়াবহ অবস্থা নিয়েও বালো ওই মৌসুমে ১১৪ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন এবং শিভরাম সামারসেটের বিরুদ্ধে ১১৩ রানে অপরাজিত একটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলে ইংরেজদের সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন।

বালো বেশ কয়েকটি ইংরেজ ক্লাবের লোভনীয় অফার পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁদের সবাইকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দেশে ফিরে পালওয়ানকার বালো শোষিত শ্রেণীর জন্য অনুপ্রেরণীয় এক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন।

১৯১৩ সাল নাগাদ, মুম্বাই ত্রিজাতীয় সিরিজ চারজাতি সিরিজে পরিণত হয় মুসলিমরা নিবন্ধন করার পর। সে বছর পালওয়ানকার ভাইদের সবার ছোট ভাই গণপতি হিন্দ দলে যোগ দেন। তখন অধিকাংশই ভেবেছিল যে, সবচেয়ে সফল ও অভিজ্ঞ খেলোয়াড় হিসেবে হিন্দু দলের অধিনায়ক হবেন বালো।

কিন্তু, নির্বাচকরা বালোকে সামনে রেখেও ব্রাহ্মণ ব্যাটসম্যান এমডি পাইকে বেছে নিয়েছিল। ব্যাপারটা বালোকে পীড়ন দিলেও কিছু করার ছিল না। ১৯২০ সালে পালওয়ানকার গণপতির মৃত্যু হয়। একই বছরে, বালোকে তাঁর বেশি বয়সের অজুহাতে হিন্দু স্কোয়াড থেকে বাদ দেওয়া হয়। যদিও বালো তখনও দেশসেরা বোলার ছিলেন।

ক্যাপ্টেন এমডি পাই অসুস্থ হয়ে পড়লে, অন্য একজন ব্রাহ্মণ ব্যাটসম্যান ডিবি দেওধারকে অধিনায়কত্ব করা হয়, যদিও সেইদলে সবচেয়ে সিনিয়র খেলোয়াড় পালওয়ানকার শিভরাম ছিলেন, ছিলেন ভিঠাল। তাদের ডিঙিয়ে একজন জুনিয়র ক্যাপ্টেন বনে যাওয়ায়, হতাশা ও অভিমানে তাঁরা দল ছেড়ে দেন।

তবে পরের সিরিজে হিন্দুদের শক্তিশালী পার্সিদের মুখোমুখি হতে হয়। এমডি পাই ফিট হয়ে ততদিনে হারানো অধিনায়কত্ব ফেরত পান, এবং পালওয়ানকার ভাইদেরও ডাকা হয়, তারা এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছিলেন। ম্যাচের মাঝখানে পাই বিরতি নিয়ে মাঠের বাইরে গেলে, সহ-অধিনায়ক বালো কিছুক্ষণের জন্য দলের অধিনায়কত্ব করেন।

১৯২২ সালে আবারো আরেকজন ব্রাহ্মণ ব্যাটসম্যানকে অধিনায়ক নিযুক্ত করলে পালওয়ানকার ভাইরা বিক্ষোভ শুরু করে, দলে ব্রাহ্মণদের সাথে একটি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির পর, নির্বাচকদের কোন বিকল্পও ছিল না, ভিঠালকে অধিনায়ক করা ছাড়া, যিনি চার বছর নেতৃত্ব দিয়ে তিনবার দলের জন্য কাপ নিয়ে আসেন।

সমাজে একটা গ্রহণযোগ্য স্থান পাওয়ার অধিকারের জন্য যখন তাদের সম্প্রদায়ের সদস্যরা লড়াই করছিল, তখন হিন্দু দলের অধিনায়ক ভিঠালের খবরটি মহৎ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। এ সময়ও বি.আর. আম্বেদকর রাজনৈতিক পর্যায়ে ব্যাপারটি উত্থাপন করেন। একই সময় মহাত্মা গান্ধীও অস্পৃশ্যতা বিলুপ্তির পক্ষে দাবি তুলছিলেন।

সম্প্রদায়টির কোন নেতা হয়তো ছিল না, যিনি তাদের উজ্জীবিত করবেন, তবু পালওয়ানকার ভাইদের লড়াই ও জয় সমাজের একচোখা মনোভাবের উপর সজোরে আঘাত হানে, এবং তাদের এই লড়াই জাতির চেতনা জাগ্রত করেছিল এবং তাদের সম্প্রদায়ের সম্মান বয়ে এনেছিল। পুরো ভারতবাসীরই গর্ব বোধ করেছিল তাদের জন্য। সর্বোপরি ক্রিকেট বর্ণকে ছাপিয়ে আপন মহিমায় প্রকাশিত হতে পেরেছিল।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...