ইরফানের স্বপ্নের কপিল পাজি

আমি আমার রোল মডেলের সাথে কাজ করতে পারছি ভেবে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়। কয়েক বছর আগে তিনি আমাকে তাঁর বাসায় নিমন্ত্রণ ও করেছিলেন। এত বড় আইকন হবার পরেও তিনি ভীষণ বিনয়ী একজন মানুষ। তাঁর সাথে এত সময় কাটানো, এত গল্প এগুলো মাঝেমাঝে আমার স্বপ্ন বলে মনে হয়।

আমার জন্ম হয় ১৯৮৪ সালে। আমি আমার ছোটবেলার একটা ছবিই মনে করতে পারি সেটা হলো কপিল দেব লর্ডসের বারান্দায় বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা যখন ক্রিকেট খেলতে শুরু করি তখন ওয়াসিম আকরাম আমাদের জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন। তবে কপিল দেবের থেকে বড় আইকন, স্পোর্টস হিরো আমাদের সামনে আর ছিল না।

তিনি তখন জাতীয় দলের অধিনায়ক এবং ব্যাট-বল দুটো দিয়েই দলকে জয় এনে দিচ্ছেন। সেই সময় ভারতে কেও যদি অলরাউন্ডার হতে চাইতো তাহলে অনুসরণ করার জন্য তাঁর থেকে ভালো কেও ছিল না।

আমরা ছোটবেলায় মানুষের মুখে শুনতাম কপিল দেব কীভাবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারতে বসা ম্যাচ বের করে নিয়ে এসেছিলেন। আপনি নিশ্চয়ই দেখতে চাইবেন, আপনার হিরো দলের সবাইকে আগলে রেখে একা প্রতিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন। তিনি আসলে সেটাই করতেন। নিজের কাঁধে পুরো দলের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন। এরচেয়ে বড় নায়ক আর কে বা হতে পারতেন!

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, কপিল পাজিকে নিয়ে আমার প্রথম স্মৃতি কোনো ক্রিকেট ম্যাচের নয়। এটা ছিল স্রেফ একটা বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটি আমি অনেকবার দেখেছিলাম। আসলে আমরা কপিল দেবের বেশিরভাগ খেলাই দেখতে পারতাম না। কেননা তখন সব খেলা টিভিতে লাইভ দেখানো হতো না। আর হলেও অনেক ম্যাচ দেখার সুযোগ হতো না। কারণ আমাদের বাসায় তখন টিভি ছিল না। আমাদেরকে প্রতিবেশিদের বাড়িতে গিয়ে খেলা দেখতে হতো।

খেলা নিয়ে তাঁর যেটুকু স্মৃতি আমার মনে পড়ে সেটা হচ্ছে ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে তিনি যেভাবে পিছন দিকে দৌড়ে ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচটা ধরেছিলেন। এছাড়া কয়েক বছর পরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর বোলিং যেখানে তিনি তাঁর রিভার্স সুইং দিয়ে ব্যাটসম্যানদের আউট করছিলেন। সেটাও এখনো আমার স্মৃতিতে রয়েছে।

সেই ছোট বয়সে আমরা আমাদের বন্ধুদের বলতাম, ‘আজ আমি তোমাদের কপিল দেবের মত পিছন দিকে দৌড়ে ক্যাচ ধরে দেখাব।’ ব্যাটিং করার সময়েও আমরা নাটরাজ শট খেলার চেষ্টা করতাম।

তবে তাঁর বোলিং অ্যাকশন কপি করাটা বেশ কঠিন ছিল। কেননা লোডিং পজিশনে তাঁর মাথা সবসময় একদিকে স্থীর থাকতো। ওইভাবে আপনি যদি অন্য কাউকে আউট স্যুইং করতে বলেন তাহলে কেওই সেটা পারবে না। কিন্তু কপিল দেব পারতেন। এটাই আসলে তাঁর ট্রেডমার্ক হয়ে গিয়েছিল। আমিও কখনো সিরিয়াসলি ওভাবে বল করার চেষ্টা করিনি। তবে মজার ছলে হয়তো কয়েকবার করেছি।

একজন অলরাউন্ডার হওয়া মুখের কথা না। শরীরে ওপর অনেক চাপ যায়। তবে আমরা কখনো তাঁকে ইনজুরিতে পড়তে শুনিনি। আমি শুনেছিলাম উনি নাকি মাঠে প্রচুর রানিং প্র্যাকটিস করতেন। আমিও ক্যারিয়ারের শুরুতে এরকমই করতাম।

আমি প্রথম কাপিল পাজিকে দেখি ২০০৪ সালে। কলকাতায় পাকিস্তান সফরের আগে আমাদের একটা ফাস্ট বোলিং ক্যাম্প সেখানে আমরা পেস বোলিং এর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সে সবসময় বলতো কবজিকে নমনীয় হতে হবে এবং তিনি সবসময় সিরিজের মাঝে রিকোভারিকে গুরুত্ব দিতে বলতেন।

এরপর থেকে অনেকবারই তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছে। তবেঁ আমাদের বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে আসলে শেষ কয়েক বছরে। ২০১৭-১৮ সালে আমি যখন জম্মু-কাশ্মীর দলের দায়িত্ব নেই (কোচ হিসেবে) তখন তিনি একটি বৈঠকে এসেছিলেন। তিনি সেদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি সত্যিই দেশের জন্য কিছু করতে চাও তাহলে বিভিন্ন লিগে খেলার চিন্তা ছেড়ে দাও। তুমি এই দলটার দায়িত্ব নেও এবং এখানকার নতুন ক্রিকেটারদের সাহায্য করো।’ কপিল পাজির এই কথা গুলো আমাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছিল।

তাঁর সাথে আমার সবচেয়ে মধুর সময় কেটেছে স্টার স্পোর্টস স্টুডিওতে । তাঁর সাথে এত কথা, একসাথে খাওয়া সেগুলো খুব ভালো সময় ছিল। আমি আমার রোল মডেলের সাথে কাজ করতে পারছি ভেবে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়। কয়েক বছর আগে তিনি আমাকে তাঁর বাসায় নিমন্ত্রণও করেছিলেন। এত বড় আইকন হবার পরেও তিনি ভীষণ বিনয়ী একজন মানুষ। তাঁর সাথে এত সময় কাটানো, এত গল্প এগুলো মাঝেমাঝে আমার স্বপ্ন বলে মনে হয়।

_______________

ইরফান পাঠান সাবেক ভারতীয় পেসার। ভারতের হয়ে তিনি ২০ টি টেস্ট, ১২০ টি ওয়ানডে এবং ২৪ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। ক্রিকেটার ইরফান পাঠান আদর্শ মানতেন কপিল দেবকে। ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ক্রিকেটারকে নিয়ে তিনি স্মৃতিচারণা করেন ক্রিকেট মান্থলিকে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...