একচোখা-একরোখা

যখন মাত্র ২০ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় নিজের ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন, থেমে যেতে পারতেন। সবার কাছ থেকে হারিয়ে যেতে পারতেন আর দশজন মানুষের মতই। কিন্তু তাঁর শরীরে যে বইছে নবাব পরিবারের রক্ত। তিনি তো পারেন না কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে!অসীম সাহসিকতায় তুচ্ছ করে দিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে। এক চোখ দিয়েই ব্যাট হাতে শাসিয়েছেন বিশ্বসেরা পেসারদের বোলিং।

‘সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম তাঁর’ – এই বাক্যের সবচেয়ে আদর্শ উদাহরণ তিনি। থাকতেন প্রাসাদে, যা নামে ‘পতৌদি প্যালেস’ হিসেবে বিখ্যাত। সেখানে চাকর-বাকরই ১০ জন। শিশু বয়সে তাকে দেখভাল করার জন্যই ছিল সাত কি আটজন।

তিনি হলেন মনসুর আলী খান পতৌদি। ওরফে টাইগার পতৌদি। বন্ধুমহলে পরিচিত ছিলেন টাইগার নামে। ক্রিকেট কলিগরা কখনো ডাকতো টাইগার কিংবা প্যাট! নাম যাই হোক, সব জায়গাতেই তিনি ছিলেন প্রবল জনপ্রিয় মানুষ, তাঁর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনোভাবের জন্য, রসবোধের জন্য।

এই বন্ধুবাৎসল্যসম্পন্ন মানুষটির জীবনে আয়েশ কিংবা আভিজাত্যের কমতি না থাকলেও চলারপথটা ছিল কাঁটায় মোড়ানো। বয়স যখন ১১ তখন শোনেন বাবা ইফতিখার আলী খান পতৌদির মৃত্যুর সংবাদ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে সাসেক্সের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকের পরও সেই পথ সহজ হয়নি তাঁর।

যখন মাত্র ২০ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় নিজের ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন, থেমে যেতে পারতেন। সবার কাছ থেকে হারিয়ে যেতে পারতেন আর দশজন মানুষের মতই। কিন্তু তাঁর শরীরে যে বইছে নবাব পরিবারের রক্ত। তিনি তো পারেন না কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে!

অসীম সাহসিকতায় তুচ্ছ করে দিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে। এক চোখ দিয়েই ব্যাট হাতে শাসিয়েছেন বিশ্বসেরা পেসারদের বোলিং। অল্প বয়সেই কাঁধে চাপে ভারতীয় দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব।

১৯৪১ সালের পাঁচ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া এই মানুষটি ১৪ বছরের ক্রিকেট জীবনে খেলা ৪৬ টেস্টের ৪০ টিতেই ছিলেন অধিনায়ক। হয়েছেন ভারতের ইতিহাসে অন্যতম সফল অধিনায়ক। পতৌদি জুনিয়র ছিলেন ডানহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান এবং ডানহাতি মিডিয়াম পেস বোলার।

ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট মেধার পরিচয় দিতে থাকেন তিনি। তিনি গভীর মনোসংযোগ ও দায়িত্বশীলতার জন্য অল্প বয়সেই উইনচেস্টারের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে গণ্য হচ্ছিলেন।

তিনি ৯৫৯ সালে তাঁর স্কুল টিমকে নেতৃত্ব দেন, সেই মৌসুমে ১০৬৮ রান করেন এবং ডগলাস জার্ডিনের গড়া ১৯১১রানের রেকর্ড ভেঙে দেন। তিনি ক্রিকেট ছাড়াও অন্যান্য স্পোর্টস গেমেও দক্ষতা দেখিয়েছেন। পার্টনার ক্রিস্টোফার স্নেলের সাথে তিনি পাবলিক স্কুল র‍্যাকেট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন।

তিনি ১৬ বছর বয়সে ১৯৫৭ সালের আগস্টে সাসেক্সের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন এবং কিছুদিন পর অক্সফোর্ডের হয়েও খেলেন এবং সেখানে তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয় এবং প্রথম দক্ষিণ এশিয়ান অধিনায়ক।

১ জুলাই ১৯৬১, তিনি হোভে যাচ্ছিলেন, একটা কাজে। সেখানেই ঘটে দুর্ঘটনা। গাড়িতে গাড়িতে সংঘর্ষ হয়। ভাঙা উইন্ডসিন থেকে কাচের একটি টুকরা প্রবেশ করে তাঁর চোখে, এবং ডান চোখ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ডা. ডেভিড সেন্ট ক্লেয়ার রবার্টস নামক সার্জন অপারেশন করে শুধু তাঁর বাম চোখকে বিপদমুক্ত করতে পেরেছিলেন। দুর্ঘটনার ফলে পতৌদিকে এক চোখে দ্বিগুণ ছবি দেখতে দেখা যায়, এটি তাঁকে ভোগাচ্ছিল।

তাঁর অনেক ভয় হচ্ছিল যে, এটি তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে শেষ করে দেবে। আসলে ভয় বা শঙ্কা নয়, সেটাই তখন বাস্তবতা ছিল। কিন্তু পাতৌদি তাঁর অদম্য মনোবল দিয়ে দ্রুতই মাঠে ফেরেন।

মাত্র ৬ মাসের ব্যবধান। জীবনের এপিঠ-ওপিঠ দেখা হয়ে গেল পাতৌদির। চিরজীবন এর জন্য চোখ হারানোর কষ্টের ছয় মাস পরই ইংল্যান্ড সফরে ভারতের হয়ে জাতীয় দলে ডাক পান তিনি।

১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দিল্লিতে হয় টেস্ট অভিষেক। ডান চোখের উপর ঠুলি পড়ে খেলতে নামেন যেন প্রতিটি দৃশ্য রিফ্লেক্ট না হয়, অর্থাৎ দুবার করে দেখতে না হয়।

সদ্য স্বাধীন ভারতীয় দলের খেলোয়াড় এর এ অবস্থায় স্লেজিং করতে ছাড়েনি এককালের শাসক ইংলিশরা, ডাকু সর্দার বলে টিপ্পনি কেটেছিল তাঁরা। দাঁত চেপে নবাব-বংশধর জবাব দেবার অপেক্ষায় ছিলেন।

মাদ্রাজে তৃতীয় টেস্টে ১০৩ রানের ইনিংস খেলে যখন ভারতকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জেতান, সেই উত্ত্যক্তকারীদের স্যালুটটাও আদায় করে নেন একগুঁয়ে মানুষটি।

১৯৬২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের জন্য তিনি সহ-অধিনায়ক নিযুক্ত হন। এক মাসের ব্যবধানে, ১৯৬২ সালের মার্চ মাসে, মনসুর আলী খান ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন।

তিনি ২০০৪ পর্যন্ত সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট অধিনায়কত্ব প্রাপ্তির বিশ্ব রেকর্ড গড়েন, যা পরে জিম্বাবুয়ের টাটেন্ডা টাইবু ভেঙে দেন। তাঁর অধিনায়কত্ব সম্পর্কে বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) ঘোষিত একটি প্রতিবেদনই যথেষ্ট যেখানে তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় টেস্ট অধিনায়ক এবং আন্তর্জাতিক টেস্ট অধিনায়কদের মধ্যে দ্বিতীয় হিসেবে রাখা হয়েছিল।

তিনি ১৯৬১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ভারতের জন্য ৪৬ টি টেস্ট খেলেন, যার মধ্যে ৬ টেস্ট সেঞ্চুরিসহ ৩৪.৯১ গড়ে টেস্ট ব্যাটিং গড়ে ২৭৯৩ রান করেন। মনসুর ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন ৪০টি ম্যাচে। যার মধ্যে ৯ টিতে জয়, ১৯ টি পরাজয়ের এবং ১৯ টি ড্র ছিল।

কিন্তু, এ পরিসংখ্যান আসলে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করতে যথেষ্ট না। তিনি ভারতের টেস্ট ক্রিকেটকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করান। ভারত তখনো নবীন দল হিসেবে গণ্য হচ্ছিল, তিনি এ দলকে বড়দলের কাতারে নিয়ে আসেন। অধিনায়ক হিসেবে ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর যে অবদান সেটা কোনো ভাবেই আজকের দিনের আধুনিক কালের সৌরভ গাঙ্গুলি কিংবা মহেন্দ্র সিং ধোনির চেয়ে কম নয়।

নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভারত প্রথম সিরিজ জয় করে তাঁর নেতৃত্বগুণে। ১৯৭০ সালে অধিনায়কত্ব হারিয়েছিলেন এবং দুই বছর কোন টেস্ট খেলেননি ইনজুরি ও ক্লান্তির জন্য। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় টেস্টে তিনি ১৯৭৩ সালে অধিনায়কত্বে ফেরেন।

এবং ১৯৭৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ভারতের অধিনায়কত্ব করেন, এটি তাঁর শেষ সিরিজ। ১৯৫৭ ও ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে মনসুর, রঞ্জি ট্রফি ও দীলিপ ট্রফিতে প্রচুর ম্যাচ খেলেন, সাসেক্সের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন ১৩৭ টি, ২২.২৯ গড়ে ৩০৬৬ রান করেছেন। তিনি সাসেক্সকে ১৯৬৬ সালে নেতৃত্ব দেন। ভারতে তিনি ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দিল্লীর হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলেন এবং তারপর হায়দ্রাবাদের হয়ে খেলেন।

 

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্জনের খাতাটা তাঁর পরিপূর্ণ। ১৯৬৮ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬৯ সালে তাঁর আত্মজীবনী ‘টাইগার’স টেল’ প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৭৫ সালে ভারতীয় দলের ম্যানেজার ছিলেন এবং ১৯৯৩ সালে অ্যাশেজে দুই টেস্টে ম্যাচ রেফারি ছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি আইপিএল কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন।

২০০৭ সালে ভারতের টেস্ট অভিষেকের ৭৫ তম বার্ষিকী উপলক্ষে, এমসিসি ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার টেস্ট ম্যাচ সিরিজের নামকরণ করে পতৌদি ট্রফি যা মনসুর আলী খানের মরহুম পিতা অষ্টম পতৌদির সম্মানে করা হয়েছিল। ২০১১ সালে ৭০ বছর বয়সে পতৌদি পরিবারের এই নক্ষত্র মৃত্যুবরণ করেন। নামের পাশে রেখে যান বিরাট এক লিগ্যাসি।

এই কিংবদন্তি জীবদ্দশাতেই রাস্ট্রপতির হাতে পদ্মশ্রী সম্মান গ্রহণ করেন। মনসুর আলীর কিছুটা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব, সুপুরুষ চেহারা, পারিবারিক অবস্থানের জন্য নারীকুলে বেশ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলেন।

এক চোখ দিয়েই ঘায়েল করেন তৎকালীন বলিউড পাড়ার অন্যতম সেরা সুন্দরী ও আরেক অভিজাত ঠাকুর পরিবারের সদস্য শর্মিলা ঠাকুরকে। স্ত্রী শর্মিলা একবার বলেছিলেন, ‘ড্যান্স ফ্লোরেও ও সমান স্পোর্টিং!’

পারিবারিক জীবন সুখী ছিল তাঁদের। তাঁর সন্তানদের নতুন করে পরিচয় দেয়ার মত কিছু নেই। সাইফ আলী খান, ও সোহা আলী খান তাঁদের মায়ের পথ অনুসরণ করে বলিউডে এসেছেন। বাকিটা সবাই জানেন, নিজগুণে তাঁরা সবার মন জয় করে নিয়েছেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...