ভারতীয় অভাগানামা

কয়েক মিলিয়ন উচ্চাভিলাষীর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন দেশের হয়ে খেলার স্বপ্নটি বাস্তবে রূপ দিতে পারেন। তবে এটাও সত্য যে, স্রেফ ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় সম্ভাব্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও কেউ কেউ নিজের স্বপ্নটার নাগাল পান না। ভারতীয় ক্রিকেটেও এই সংখ্যাটা নেহায়েৎ কম নয়।

ভারতের কোন শিশু যখন প্রথম ক্রিকেট ব্যাট হাতে তুলে নেয় তখন থেকেই ভারতীয় দলের বিখ্যাত নীল জার্সিটি গায়ে জড়ানোর আকাঙ্খা লালন করতে শুরু করে। দিনরাত পরিশ্রম করে শিশুটি সমস্ত বিপত্তি পাশ কাটিয়ে ধীরে ধীরে কিন্তু অটলভাবে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্বের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে। যদিও কয়েক মিলিয়ন উচ্চাভিলাষীর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন দেশের হয়ে খেলার স্বপ্নটি বাস্তবে রূপ দিতে পারেন। তবে এটাও সত্য যে, স্রেফ ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় সম্ভাব্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও কেউ কেউ নিজের স্বপ্নটার নাগাল পান না।

এখানে আমরা ঠিক তেমন পাঁচ জন খেলোয়াড়ের দিকে নজর দিচ্ছি যারা অসীম প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় দলে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

  • অনিল গুরাভ

অনিল গুরাভকে ডাকা হতো মুম্বাইয়ের ভিভ রিচার্ড বলে। তিনি ছিলেন খুবই সম্ভাবনাময় একজন ক্রিকেটার। তাঁর প্রতিভায় বেশ মুগ্ধ ছিলেন ভারতের স্বনামধন্য কোচ রমাকান্ত আচরেকার। তিনি এতটাই বিমোহিত ছিলেন যে নিজের অন্যতম দু’জন প্রতিভাবান শিষ্য- শচীন টেন্ডুলকার ও বিনোদ কাম্বলিকে অনিলের স্ট্রোকপ্লে অনুসরণ করে তাঁর কাছ থেকে কিছু শেখার উপদেশ দেন।

যদিও ভাগ্যের পরিহাসে খুব বেশিদূর যেতে পারেননি অনিল। তাঁর সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্রিকেট খেলা বলতে গেলে মুম্বাই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের প্রতিনিধিত্ব করা। এর পেছনে ঠিক ততটাই বেদনাদায়ক কারণ রয়েছে যতটা প্রতিভাবান ছিলেন তিনি একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে৷

অনিলের সম্ভাবনাময় ক্রিকেট ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যায় খুব নির্মমভাবে। তিনি ক্রিকেট থেকে ক্রমশ দূরে সরে যান যখন তাঁর ভাই অজিত আন্ডারওয়ার্ল্ডে যোগদান করেন। যে কারণে পুলিশ বারংবার অনিল ও তাঁর মাকে তুলে হাজতে নিয়ে আসতেন এবং অজিতের হদিস পেতে অনিলকে নিয়ম করে প্রচন্ডভাবে প্রহার করতেন। এসব পরিস্থিতির সাথে পেরে না উঠায় একসময় অ্যালকোহলের নেশায় বুদ হতে শুরু করেন অনিল। সেইসাথে ইতি ঘটে যায় মুম্বাইয়ের ভিভ রিচার্ডসের প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেট জীবনের৷

  • ইয়েরে গৌড়

‘ইয়েরে গৌড় ছিলেন রেলওয়ে দলের রাহুল দ্রাবিড়।’ – ঘরোয়া ক্রিকেটে ইয়েরে গৌড় তাঁর সাফল্যমন্ডিত ক্যারিয়ারের পর্দা নামানোর সময় উপরের মন্তব্যটি করেন সাবেক ভারতীয় ফাস্ট বোলার জাভাগাল শ্রীনাথ।

১৫ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এই প্রাক্তন রেলওয়ে ও কর্ণাটকের অধিনায়ক ১৬ টি শতক ও ৩৯ টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৫.৫৩ গড়ে সংগ্রহ করেন ৭৬৫০ রান। রেলওয়ের হয়ে ২০০১-০২ ও ২০০৪-০৫ মৌসুমের রঞ্জি ট্রফি জেতার পর তিনটি ইরানি ট্রফি, একটি দুলীপ ট্রফি ও একটি রঞ্জি ওয়ানডে ট্রফির শিরোপা বাগিয়ে নেন তিনি। তবে প্রায় এক দশক ধরে ঘরোয়া ক্রিকেটে অন্যতম বড় নাম হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় দলে কখনও ডাক পাননি গৌড়।

  • ধ্রুব পাণ্ডব

আরেকজন উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার যিনি অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স দিয়ে ক্রিকেট পাড়ায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। পাঞ্জাব অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৭ দলে দুর্দান্ত খেলে প্রথমবারের মত পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন ধ্রুব পাণ্ডব।

১৯৮৭-৮৮ বিজয় হাজারে ট্রফিতে জম্মু ও কাশ্মীর অনূর্ধ্ব-১৭ দলের বিপক্ষে ১৫৯ এবং দিল্লি অনূর্ধ্ব-১৭ দলের বিপক্ষে ৫১ রান করার পর খুব শীঘ্রই মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ ঘটে তাঁর। হিমাচল প্রদেশের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচেই ৯৪ রান করে নিজের নামের প্রতি সুবিচারও করেন তিনি।

১৯৮৭-৮৮ বিজয় মার্চেন্ট ট্রফির সেমিফাইনালে সেন্ট্রাল জোন অনূর্ধ্ব-১৫ দলের বিপক্ষে ২০৬ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলার পর ফাইনালে ইস্ট জোন অনূর্ধ্ব-১৫ দলের বিপক্ষে ধ্রুব খেলেন ১১৭ ও অপরাজিত ৪২ রানের ইনিংস৷ শ্রীনগরে জম্মু ও কাশ্মীরের বিপক্ষে নিজের তৃতীয় প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলতে নেমেই ১৩৭ রান করেন তিনি এবং মাত্র ১৪ বছর ২৯৪ দিন বয়সে বনে যান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ ও পৃথিবীর অন্যতম সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান।

তারপর দিন যত যায় ধ্রুব পাণ্ডবের পারফরম্যান্সের গ্রাফ ততই উর্ধ্বমুখী হতে থাকে। ১৯৯০-৯১ কোচবিহার ট্রফিতে পাঞ্জাব অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে নেতৃত্ব দেন তিনি। সেখানে পরপর দুটি সেঞ্চুরি হাকান ধ্রুব। মাত্র ১৭ বছর বয়সে রঞ্জি ট্রফিতে ১০০০ রানের মাইলফলকটি স্পর্শ করেন তিনি। কিন্তু তাঁর প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেট ক্যারিয়ারটি হঠাৎ শেষ হয়ে যায় একটি ট্র্যাজিডিতে৷ ১৯৯৯ সালে দেওধর ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনাল শেষ করে ঘরের ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় জীবন নদীর ওপারে পাড়ি জমান অমিত প্রতিভাধর এই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান।

  • পদ্মকর শিভালকার

তর্কসাপেক্ষে ভারতের শ্রেষ্ঠ স্পিনার যিনি জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তুলতে পারেননি। ভয়ংকর সব স্পিন ঘূর্ণিতে ঝুলিতে পুরেন ৫৮৯ উইকেট যেখানে তাঁর অবিশ্বাস্য গড় ১৯.৬৯ ও ইকোনোমি ২ এর কিছুটা উপরে। কিন্তু বিষান সিং বেদি ও এরাপাল্লি প্রসন্নর মত স্পিনাররা দলে নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করায় ভারতের হয়ে খেলার স্বপ্নটা অধরাই থেকে যায় পদ্মকর শিভালকারের।

  • অমল মজুমদার

শিভালকার যেমন ভুল সময়ে জন্মেছিলেন যখন ভারতীয় দল ছিল বিশ্বমানের স্পিনারে ঠাসা ঠিক তেমনি অমল মজুমদারকে মূল্য চোকাতে হয় ভুল সময়ে খেলা শুরু করায় যখন শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, ভিভিএস লক্ষ্মণ ও রাহুল দ্রাবিড়ের মত ব্যাটসম্যানরা ভারতীয় ক্রিকেটে রাজত্ব করছিলেন।

রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই খেলোয়াড় অভিষেকেই দেখা পান দ্বিশতকের। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে তাঁর নামের পাশে যুক্ত হয় ১০,২০৮ রান। ২৫ সেঞ্চুরিতে যার ব্যাটিং গড় ছিল ৪৭.৪৭। যদিও জাতীয় দলে কখনও ডাক মেলেনি তাঁর।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...