রূপান্তরের অভিনব আখ্যান

নিলামে তাঁকে ৮.৪ কোটি রুপিতে কিনে নেয় কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব। যদিও, অভিষেকে প্রত্যাশার চাপ মেটাতে পারেননি বরুণ। প্রথম ওভারেই হজম করেন ২৫ রান, সহ্য করেন নারাইনের ব্যাটিং তোপ, গড়েন লজ্জার নতুন রেকর্ড। আর মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে আসে ইনজুরি। বাকিটা মৌসুম কাটাতে হয় মাঠের বাইরে।

বরুণ চক্রবর্তী ক্রিকেট জীবন শুরু করেন সেই ১৩ বছর বয়সে। তখন তিনি ছিলেন উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান। ১৭ বছর বয়স অবধি এই পরিচয়েই খেলেছেন। কিন্তু, বারবার বয়সভিত্তিক ক্রিকেট দলগুলোতে জায়গা হচ্ছিল না কোনোভাবেই। প্রত্যাখ্যাতের যন্ত্রনা সইতে না পেরে বাইশ গজ ছেড়েই দেন বরুণ।

মন দেন পড়াশোনায়। চেন্নাইয়ের এসআরএম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষা নেন। পাঁচ বছরের শিক্ষা জীবন শেষে ফ্রিল্যান্স স্থপতি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

তখনই বোধদয় হয় বরুণের। তিনি লক্ষ্য করেন, কাজে তিনি নিজের ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে পারছেন না। পুরো সপ্তাহ তিনি অপেক্ষায় থাকেন, কখন ছুটি আসবে আর তিনি টেনিস বলের ক্রিকেট খেলতে পারবেন।

সেই ভাবনা থেকেই স্থপতির কাজ ছেড়ে দেন। বুঝতে পারেন, এই জীবন তাঁর জন্য নয়। ক্রমবেস্ট ক্রিকেট ক্লাবে সিম বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু, হাঁটুর ইনজুরিতে মোটে দুই ম্যাচ খেলার পরই ছিটকে যান ছয় মাসের জন্য।

ফিরে আসেন যখন, তখন আবারো পাল্টে যায় তাঁর পরিচয়। এবার তিনি পুরোদস্তর ফিঙ্গার স্পিনার। টেপ টেনিস ক্রিকেটে তাঁকে খুব কম ব্যাটসম্যানই ঘায়েল করতে পারতো।

এবার নিজেকে পরিচর্যায় মন দিলেন বরুণ। কিভাবে নিজের রহস্য বাড়ানো যায় – সেদিকেই ছিল তাঁর নজর। ২০১৭-১৮ মৌসুমে চেন্নাইয়ের চতুর্থ বিভাগের দল জুবিলি ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দিলেন। সেখানে সাত ম্যাচে পান ৩১ উইকেট, হলেন ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।

সেখান থেকেই তাঁর ডাক আসে তামিল নাড়ু প্রিমিয়ার লিগে (টিএনপিএল)। সিয়েচেম মাধুরাই প্যান্থার্স দলের হয়ে তিনি ২০১৮ সালের শিরোপা জয় করেন। ফাইনালে চার ওভারে মাত্র নয় রান দিয়ে নেন দুই উইকেট। ওই আসরে ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন অজি কিংবদন্তি মাইক হাসি। মাইক হাসি রত্ন চিনতে ভুল করেননি। তিনি বলেই ফেললেন, ‘বরুণ হলেন নতুন রহস্য বোলার!’

এর আগেই অবশ্য তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) দুটি দল চেন্নাই সুপার কিংস ও কলকাতা নাইট রাইডার্সে কাজ করেছেন নেট বোলার হিসেবে। কেকেআরের সময়ে তাঁর ক্যারিবিয়ান স্পিনার সুনীল নারাইনের সাথে কথাও হয়েছে।

টিএনপিএলে দারুণ মৌসুম কাটানোর পর তাঁর ডাক আসে বিজয় হাজারে ট্রফিতে। গ্রপ পর্বে ২২ উইকেট পাওয়া বরুণই ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী। নিজের বৈচিত্র দিয়ে তিনি চমকে দেন সবাইকে।

সবচেয়ে বড় চমক অপেক্ষা করছিল ২০১৯ সালের আইপিএলে। নিলামে তাঁকে ৮.৪ কোটি রুপিতে কিনে নেয় কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব। যদিও, অভিষেকে প্রত্যাশার চাপ মেটাতে পারেননি বরুণ। প্রথম ওভারেই হজম করেন ২৫ রান, সহ্য করেন নারাইনের ব্যাটিং তোপ, গড়েন লজ্জার নতুন রেকর্ড। আর মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে আসে ইনজুরি। বাকিটা মৌসুম কাটাতে হয় মাঠের বাইরে।

মৌসুম শেষে তাঁকে আর রাখেনি পাঞ্জাব। তাঁকে চার কোটি রুপি দিয়ে কেনে কেকেআর। কে জানে, মাইক হাসির ভাই ডেভিড হাসি দলটির সাথে না থাকলে হয়তো কেকেআর শিবিরে আসাই হত না বরুণের।

বরুণও অবশ্য পরিশ্রমের কমতি রাখেননি। নিজের অস্ত্রশালায় অনেক নতুন বৈচিত্র যোগ করেছেন তিনি। লেগ স্পিন, ক্যারম বল, লেগ কাটার, অফ স্পিন, ফ্লিপার, টপ-স্পিন, আর্ম বল – সবই এখন তাঁর নখদর্পনে। আর এখন তাঁকে আইপিএল থেকে বিদায় করা সেই নারাইনকেই পেয়েছেন বোলিং পার্টনার হিসেবে। সাথে সাকিব আল হাসান তো আছেনই।

বছর তিনেক আগেও যিনি খেলতেন চতুর্থ বিভাগে, আজ তিনি বিশ্বের সেরা ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে প্রশংসা কুড়ান। স্থপতি হয়েই গিয়েছিলেন, ক্রিকেটে ফিরেছেন – তাও ২৫ বছর বয়সে। উইকেটরক্ষক, পেস বোলার – সব পরিচয় ছাপিয়ে অবশেষে থিঁতু হয়েছেন – রহস্য স্পিনার পরিচয়ে। রূপান্তরের এমন গল্প রোজ রোজ শোনা যায় না!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...