ডাচ ট্র্যাজেডির নায়ক

নেদারল্যান্ডসের খেলোয়াড় হওয়ায় কখনোই ল্যাটিনদের মতো তেমন লাইমলাইট পাননি। তবে নেদারল্যান্ডের সোনালি প্রজন্মের অন্যতম সেনানী ছিলেন। অবশ্য বরাবরের মতোই সোনালি রঙ উজ্জ্বলতা না ছড়িয়ে বেদনার নীল রঙে প্রায় পুরো ক্যারিয়ারটা কেটে গিয়েছে।কেমন ছিলেন আয়াক্স, ইন্টার মিলান কিংবা রিয়াল মাদ্রিদের মতো ঐতিহ্যবাহী ক্লাবে খেলা স্নাইডারের ক্যারিয়ার?

১.

অনেক মানুষের মাঝে বসে থেকে খেলা দেখার সময় স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সমর্থন করার অভিজ্ঞতা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। ১৯৯৬ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে আমার পুরো বাসার মানুষ শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা সেই সময়ে খুব দূর্দান্ত কোন দল নয়। কিন্তু এরপরেও বিপুল সমর্থন পাবার কয়েকটি কারণ ছিল।

প্রথম কারণটি ছিল এশিয়ান দল। এশিয়ান দলের বিপরীতে অস্ট্রেলিয়াকে সমর্থন দেবার কোন কারণই নেই। দ্বিতীয় কারণ ছিল এক শ্রেণীর মানুষ যখন নিজের সমর্থন করা দল টুর্নামেন্ট থেকে বাদ হয়ে যায় তখন চায় নতুন কোন দেশ যেন চ্যাম্পিয়ন হয়।

আর তৃতীয় এবং একটা বড় কারণ ছিল শ্রীলঙ্কা সেই বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে হারিয়েছিল ভারতকে যেই ভারত আবার কোয়ার্টারে পাকিস্তানকে হারিয়ে এসেছিল। কাজেই ভারত বিরোধীরা সেমিতে ভারতের পরাজয়ে খুব খুশি।

চতুর্থ কারণটি ছিল অস্ট্রেলিয়া। কোন এক বিচিত্র কারণে অস্ট্রেলিয়া দলের হেটার সেই সময়ে অনেক ছিল। ১৯৯৬ সালে বসে খুব অল্প সংখ্যক মানুষই ছিল যারা কিনা অস্ট্রেলিয়াকে সমর্থন করতো।

সেই অল্প সংখ্যক মানুষের মাঝে একজন ছিলাম আমি।

এমনিতেই প্রায় ৫০ জন একসাথে খেলা দেখা পাবলিকের মাঝে আমি একা অস্ট্রেলিয়ার সমর্থক, অন্য দিকে অস্ট্রেলিয়া একতরফা ভাবে হেরে চলেছে। এই অবস্থায় আমাকে নিয়ে ট্রল করাটা খুবই স্বাভাবিক। দাতে দাত চেপে সেই সময়টা সহ্য করে গিয়েছি। অবশ্য তার পরের একটা যুগ বারবার আমিই মানুষকে ট্রল করেছিল।

প্রায় একই অবস্থায় পড়লাম ২০১০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে।  কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি ব্রাজিল বনাম নেদারল্যান্ড। বাসায় দেখতে আসা বেশির ভাগই ব্রাজিলের সমর্থক। আর্জেন্টাইন কিছু সমর্থক একাধারে নেদারল্যান্ডকে সমর্থন দিচ্ছে। এর মাঝে আমি একা নেদারল্যান্ডসের সমর্থক।

ব্রাজিল সেই বিশ্বকাপের টপ ফেভারিট। আর নেদারল্যান্ডসের অনেক খেলোয়াড়ের নামও অনেকে জানে না। খুব অস্বাভাবিক না বিষয়টা।

ম্যাচ শুরু হবার কিছুক্ষন পরেই ট্রল করার সুযোগ পেয়ে গেল আমার সাথের মানুষেরা। ব্রাজিল গোল করে এগিয়ে গেল। কিন্তু ম্যাচ শেষ হলো আমার উল্লাসে। পরবর্তীতে ২ গোল করে এক হাতেই ম্যাচটা বের করে নিল ফিফা গেমসে আমার অন্যতম প্রিয় খেলোয়াড় ওয়েসলি স্নাইডার। ম্যাচটা জিতে ব্রাজিলকে বিদায়ই করে দিল টুর্নামেন্ট থেকে। খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে কান্নারত কাকাকে দেখেও আনন্দ লুকাতে পারছিলাম না।

তবে ২০১০ বিশ্বকাপের শুরু থেকেই কিন্তু স্নাইডার দূর্দান্ত ছিলেন। গ্রুপ পর্বের প্রথম দুই ম্যাচেই ম্যান অব দি ম্যাচ। এরপর ব্রাজিলের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালেরও ম্যান অব দ্য ম্যাচ। সেমিতে উরুগুয়ের বিপক্ষে ৩-২ গোলে জেতা ম্যাচেও ম্যান অব দি ম্যাচ স্নাইডার। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এক টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি বার (৪ বার) ম্যাচ সেরার রেকর্ড স্নাইডারের (পরবর্তীতে মেসি এই রেকর্ড স্পর্শ করেছেন)।

তবে, ফাইনালে স্পেনের কাছে একেবারে অন্তিম মূহুর্তে হেরে যায় ডাচরা। পাঁচ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন যৌথভাবে ফোরলান, থমাস মুলার আর ডেভিড ভিয়ার সাথে। এছাড়া টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন স্নাইডার। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি সেই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় ফোরলানের পরিবর্তে স্নাইডারেরই পাওয়া উচিত ছিল।

ইন্টার মিলানের হয়ে সেই মৌসুমে ট্রেবল জেতা স্নাইডারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট (৬ টি) ছিল । এছাড়া উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে সমর্থকদের ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরষ্কারও পান স্নাইডার। ২০১০ সালে স্নাইডার কাপ জিতেন পাঁচটি  – সিরি এ, ইতালিয়ান কাপ, ইতালিয়ান সুপার কাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ আর ক্লাব বিশ্বকাপ।

এর সাথে বিশ্বকাপ রানারআপ তো ছিলই। স্নাইডার শুধু কাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন না বরং প্রায় প্রতিটি কাপ জয়ে তার সক্রিয় অবদান ছিল। এরপরেও কেন ফিফা ব্যালন ডি অর জিতলেন না! জেতা দূরে থাক তিনি সেরা তিনেও কখনো আসেননি। ব্যাপারটা আমার কাছে আজীবনের এক রহস্য!

২.

নেদারল্যান্ডসের খেলোয়াড় হওয়ায় কখনোই ল্যাটিনদের মতো তেমন লাইমলাইট পাননি। তবে নেদারল্যান্ডের সোনালি প্রজন্মের অন্যতম সেনানী ছিলেন। অবশ্য বরাবরের মতোই সোনালি রঙ উজ্জ্বলতা না ছড়িয়ে বেদনার নীল রঙে প্রায় পুরো ক্যারিয়ারটা কেটে গিয়েছে।

কেমন ছিলেন আয়াক্স, ইন্টার মিলান কিংবা রিয়াল মাদ্রিদের মতো ঐতিহ্যবাহী ক্লাবে খেলা স্নাইডারের ক্যারিয়ার?

ক্লাব ফুটবলে আয়াক্সের হয়ে উজ্জ্বল স্নাইডারের সিনিয়র দলে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় ২০০৩ সালে পর্তুগালের বিপক্ষে। জাতীয় দলের হয়ে ইউরো ২০০৪ এ সেমিফাইনাল খেললেও মূলত বদলী খেলোয়াড় হয়েই মাঠে নামা হতো তার। তবে ২০০৬ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের হয়ে চারটি ম্যাচেই শুরুর একাদশে সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে পর্তুগালের কাছেই থেমে যায় তাদের বিশ্বকাপ যাত্রা।

এরপর ২০০৮ সালের ইউরোতে স্নাইডার তাঁর কৃতিত্ব দেখান। এই টুর্নামেন্টে নেদারল্যান্ড ছিল গ্রুপ অফ ডেথে। গ্রুপের বাকি দলগুলো ছিল ইতালি, রোমানিয়া আর ফ্রান্স। টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ইতালিকে ৩-০ গোলে হারানো ম্যাচে স্নাইডার একটি গোল করেন এবং ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন।

ফ্রান্সের বিপক্ষে পরের ম্যাচেও নেদারল্যান্ড জিতে ৪-১ গোলে এবং স্নাইডার আবারও ম্যান অব দ্য ম্যাচ। রোমানিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচটাও জিতে নেদারল্যান্ড কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে রাশিয়ার কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে যায়। ইউরো ২০০৮ এর সেরা দলে সুযোগ পান স্নাইডার। তিনি বাদে কেবলমাত্র গোলরক্ষক ভ্যান ডার সার নেদারল্যান্ডস দল থেকে সুযোগ পেয়েছিলেন।

২০১২ ইউরোতে নেদারল্যান্ডস আবারও গ্রুপ অফ ডেথ এ পড়ে যায়। গ্রুপের বাকি তিন দল ছিল পর্তুগাল, জার্মানি আর ডেনমার্ক। কিন্তু তিন ম্যাচের তিনটিতেই হেরে নেদারল্যান্ড গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় হয়। ২০১০ বিশ্বকাপের কথা তো আগেই বলা হলো।

২০১৪ বিশ্বকাপেও স্নাইডার প্রতিটি ম্যাচে খেলেন কিন্তু সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে টাইব্রেকার ভাগ্যে বাদ পড়ে যায়। টাইব্রেকারে স্নাইডারও পেনাল্টি মিস করেন। দু:খজনক বিষয় হচ্ছে ইউরো ২০১৬ আর বিশ্বকাপ ২০১৮ তে দুর্দান্ত দল নিয়েও নেদারল্যান্ডস বাছাইপর্ব পার হতে পারেনি।

অবসর নেওয়ার সময়ে নেদারল্যান্ডসের জার্সি গায়ে স্নাইডারের মাঠে নামা ১৩৩ বার যা কিনা নেদারল্যান্ডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তিনি জাতীয় দলের হয়ে ৩৩ টি গোলও করেছেন। নেদারল্যান্ডস হয়তো নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তবে আরেকজন স্নাইডারকে কবে পাবে সেটা একটু ভাবনারই বিষয়।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...