যিনি বুঝেছিলেন সাকিবের গ্রেটনেস

ওই সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী সাকিব পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ব্লুমফন্টেইন ও সেঞ্চুরিয়নে খেলা দুই টেস্টের উভয়টিতেই তিনি পাঁচ উইকেট তুলে নেওয়ার পাশাপাশি সংগ্রহ করেন ১১ উইকেট। তখন বল হাতে সাকিবের ঘূর্ণি প্রদর্শনী দেখে একজন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার তাকে সে সময়ের বিশ্বসেরা ফিঙ্গার স্পিনার হিসেবে অভিহিত করে বসেন।তিনি কে? বলছি।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের স্বার্থে টিম ম্যানেজমেন্ট দ্বারা কোনো ক্রিকেটারের মাঠের ভূমিকায় পরিবর্তন আনার ঘটনা হরহামেশাই ঘটে থাকে। হালের আমিনুল ইসলাম বিপ্লবের কথাই ধরা যাক। পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান ও অনিয়মিত স্পিনার হওয়া সত্ত্বেও একজন লেগ স্পিনারের শূন্যতা পূরণে বর্তমানে পুরোদস্তুর বোলার হিসেবে জাতীয় দলে খেলানো হচ্ছে তাঁকে। এর আগে ২০১৬ সালে অলরাউন্ডার হওয়া সত্ত্বেও ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শুধু বোলার হিসেবে ব্যবহার করা হয় মেহেদী হাসান মিরাজকে।

ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল এক যুগ পূর্বে। তখন দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে কেবল বিশেষজ্ঞ বোলার হিসেবে খেলান তৎকালীন কোচ জেমি সিডন্স। সাকিবও বল হাতে প্রতিদানটা দিয়ে ফেলেন সিরিজের প্রথম ম্যাচেই। চট্টগ্রামে খেলা ওই টেস্টের প্রথম ইনিংসে মাত্র ৩৬ রানে সাত উইকেট তুলে নেওয়ার পাশাপাশি পুরো ম্যাচে তিনি উইকেট সংগ্রহ করেন নয়টি। এটিই ছিল টেস্ট ক্রিকেটে সাকিবের প্রথমবারের মতো পাঁচ বা তার বেশি উইকেট শিকারের ঘটনা।

ওই সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী সাকিব পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ব্লুমফন্টেইন ও সেঞ্চুরিয়নে খেলা দুই টেস্টের উভয়টিতেই তিনি পাঁচ উইকেট তুলে নেওয়ার পাশাপাশি সংগ্রহ করেন ১১ উইকেট। তখন বল হাতে সাকিবের ঘূর্ণি প্রদর্শনী দেখে একজন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার তাকে সে সময়ের বিশ্বসেরা ফিঙ্গার স্পিনার হিসেবে অভিহিত করে বসেন।

তিনি কে? বলছি।

ভদ্রলোকের নাম কেরি জেমস ও’কিফ। নামটা অনেকেরই অপরিচিত মনে হতে পারে। কারণ সব ধরনের ক্রিকেট থেকে তিনি অবসরে গিয়েছেন সেই চার দশক পূর্বে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার জার্সি গায়ে মাঠ মাতান তিনি।

বুঝাই যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার অতটা দীর্ঘ হয়নি এই সাবেক লেগির। মোটামুটি গড়নের ক্যারিয়ারে দু’টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা ও’কিফ বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন টেস্ট ক্রিকেট খেলে। তখনকার ফাস্ট বোলারদের রমরমা যুগে লেগ স্পিনার হিসেবে নিজের সামর্থ্যের জানান দেন তিনি। মূলত হাই আর্ম অ্যাকশনে বল করে উইকেট থেকে বাড়তি বাউন্স আদায় করায় ছিল তাঁর পারদর্শিতা। শুরুর দিকে তাকে ভবিষ্যত অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা প্রতিভাবান লেগ স্পিনার হিসেবেও দেখেছিলেন অনেকে। যদিও পরবর্তীতে তিনি নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি।

১৯৭০-৭১ অ্যাশেজ সিরিজের পঞ্চম ম্যাচে খেলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ও’কিফের। কিন্তু অভিষেকটা ঠিক রাঙাতে পারেননি তিনি। ম্যাচের দুই ইনিংস মিলিয়ে ৫০ ওভার বল করেও পাননি কোনো উইকেট। তারপর এক ম্যাচ বসে সপ্তম ম্যাচে সিডনির স্পিন সহায়ক উইকেট বিবেচনায় আবারও দলে ফেরেন ও’কিফ। ফিরেই নিজের অভিষেক উইকেটের দেখা পান তিনি। সেই টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৬ উইকেট।

সর্বসাকল্যে ২৪ টেস্ট খেলা ও’কিফ ৩৮.০৭ গড়ে ঝুলিতে পুরেছেন ৫৩ উইকেট। তাছাড়া ব্যাটিংয়ে কিছুটা সফল হয়েছিলেন তিনি। ব্যাট হাতে ২৫.৭৬ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ৬৪৪ রান। সবমিলিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৬৯ ম্যাচ খেলে তিনি সংগ্রহ করেন ৪১৬৯ রান ও ৪৭৬ উইকেট।

কেরি ও’কিফ বরাবরই বেশ রসিক একজন মানুষ। রসিকতার ছলে তিনি প্রায়ই একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে নিজের বোলিংয়ে তীক্ষ্মতার অভাব নিজেই প্রদর্শন করেন। সেটা হলো, তিনি একমাত্র বোলার যিনি টেস্ট ক্রিকেটে শতকরা সর্বাধিকবার ব্যাটসম্যানদের ক্যাচ আউট করেছেন। তাঁর ৫৩ উইকেটের মধ্যে ৪৪টি ছিল ‘কট’ যার শতকরা হার দাঁড়ায় ৮৩! ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রায় সময়ই মজা করে এই পরিসংখ্যানটা তুলে ধরেন তিনি।

ও’কিফ ১৯৮০ সালে চিরতরে ব্যাট-প্যাড তুলে রাখার পর ধারাভাষ্যকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (এবিসি) রেডিওর ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়ার নাইন নেটওয়ার্কেও মাঝেসাঝে ধারাভাষ্যকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ধারাভাষ্য থেকে অবসরে যাবার দু’বছর পর পুনরায় এ পেশায় ফেরেন ও’কিফ। তখন অস্ট্রেলিয়ার রেডিও চ্যানেল ‘ট্রিপল এম’-এর হয়ে কাজ শুরু করে দু’বছর পর ‘ফক্স স্পোর্টস’-এর ধারাভাষ্য প্যানেলে যোগ দেন তিনি।

খেলোয়াড়ি জীবনে বিতর্কের ধারেকাছে না ঘেঁষলেও ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে একাধিকবার বিতর্কে জড়ানোর ঘটনা রয়েছে ও’কিফের। ২০১৮ সালে রঞ্জি ট্রফিতে খেলা বোলারদের ক্যান্টিন কর্মী হিসেবে আখ্যা দিয়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেন তিনি। ঘটনার সূত্রপাত ভারতের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার বক্সিং ডে টেস্টে। অভিষেক টেস্টে ওপেনার মায়াঙ্ক আগারওয়াল অর্ধশতক তুলে নিলে ধারাভাষ্যকক্ষে রঞ্জি ট্রফিতে তাঁর ত্রিশতক হাঁকানোর ঘটনাটি নিয়ে কথা ওঠে। তখন ও’কিফ বিদ্রুপ করে বলেন যে, আগারওয়ালের ত্রিশতক নাকি এসেছিল রেলওয়ের ক্যান্টিন কর্মীদের বোলিংয়ের বিপক্ষে। তাঁর এই বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যে তৎক্ষণাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরগরম হয়ে ওঠে। টুইটারে ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তরা একের পর এক জবাব দিতে থাকেন। পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে পরে অবশ্য ক্ষমা চান ও’কিফ।

এ বিতর্কের রেশ কাটতে না কাটতেই নতুন এক বিতর্কের জন্ম দেন এই অজি ধারাভাষ্যকার। এবার তাঁর বিরুদ্ধে ওঠে নাম ব্যঙ্গ করার অভিযোগ। ওই বক্সিং ডে টেস্টে রবীন্দ্র জাদেজা ও চেতেশ্বর পূজারার নাম উচ্চারণ করতে বেশ খাবি খেতে হয়েছিল ও’কিফকে। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস চলাকালে বিশেষ করে জাদেজার নাম উচ্চারণ করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তাঁর।

তারপর তিনি ঠাট্টা করে বলে ওঠেন, ‘কেউ নিজেদের বাচ্চার নাম জাদেজা বা চেতেশ্বর রাখেন কেন?’ তাঁর এরূপ মন্তব্যে ভারতীয়দের প্রতিবাদে আবারও গরম হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বার বার এমন সব বিতর্কিত বিবৃতি দেওয়ায় সিরিজের বাকি ম্যাচগুলোর ধারাভাষ্য প্যানেল থেকে অপসারণ করা হয় তাকে।

ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার ও’কিফ ২০০৪ সালে লেখক হিসেবে একটি বইও বের করেন। ‘অ্যাকর্ডিং টু স্কাল’ নামে একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। বইয়ের নামটা লিখতে গিয়ে একটা কথা মনে পড়ল। কেরি ও’কিফের আদুরে নামও কিন্তু ‘স্কাল’।

কেরি ও’কিফের বর্তমান বয়স ৭১ ছুঁই ছুঁই। এই বয়সে তিনি এখনও সাকিব আল হাসানের খেলা দেখেন কি না জানা নেই। তবে যদি দেখে থাকেন তাহলে সেটা হতে পারে তাঁর জন্য এক চরম তৃপ্তির উপলক্ষ্য। কেননা একসময় বিশ্বের সেরা সামসময়িক ফিঙ্গার স্পিনার হিসেবে যাঁকে তিনি অভিহিত করেছিলেন সেই সাকিব বল হাতে এখনও যে আগের সাকিবই রয়ে গেছেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...