জিনেদিন জিদান: মাস্টারমাইন্ড এক কোচের অতিমানবীয় উত্থান
আজ পর্যন্ত একটা ফাইনালও হারেন নি। তিন বছরে তিনটা চ্যাম্পিয়নস লিগ ভাবা যায় এইগুলা? এতো অর্জন, এতো রেকর্ড এতোবার নিজের ব্রিলিয়ান্সের প্রমান দিয়েছেন। তাও শুনতে হয় ব্ল্যাক ম্যাজিক, ভাগ্যের সহায়তা আর রোনালদোর কৃতিত্ব।
ফুটবল জগতে একটি প্রথা প্রচলিত আছে, ভালো খেলোয়াড়রা কখনো ভালো ম্যানেজার হতে পারেন না। ফুটবলে খুব অল্প কয়েকজন ব্যক্তিই এই প্রথাটা ভেঙে দেখাতে পেরেছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার জিনেদিন জিদান।
ম্যানেজার হতে গেলে বেশি কথা বলতে হয়, অথচ জিদান সবসময় ‘ইন্ট্রোভাট’ টাইপের মানুষ। যখন প্রথম কোচিং প্রফেশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন সবার একটাই প্রশ্ন ছিলো – এই অল্পভাষী লাজুক টাইপের মানুষ কিভাবে ড্রেসিংরুমে প্লেয়ারদের সামলাবে? অথচ এই লোকটাই আজ ফুটবল বিশ্বে ম্যান ম্যানেজমেন্ট এর গুরু।
একটা কথা আছে ‘Listening is a Fine Art’, আপনি যখন মনোযোগ দিয়ে শুনবেন তখন ই আপনি সবকিছু জানবেন। মার্সেলো বিসলা বলেছিলেন জিদান এর মতো মনোযোগী মানুষ তিনি আর দুইটি দেখেন নি। বড় প্লেয়াররা হয়তো এই জায়গায় ভুলটা করতেন, তারা মনে করতেন তারা সব জানেন, তাদের আর তেমন কিছু শিখতে হবে না। কিন্তু জিদান মনে করেন, ফুটবলে প্রতিদিন নতুন কিছু শিখার আছে।
কাস্তিয়ায় কাজ করেছেন, মরিনহোর অধীনে শিখেছেন, আনচেলোত্তির অধীনে এসিস্টেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। আনচেলোত্তির সব প্রেস কনফারেন্স এর সময় দেখা যেতো, জিদান সাংবাদিকদের সাথে পেছনে বসে খাতা কলম নিয়ে নোট করছেন। বিসলা, পেপদের ক্যাম্পে চলে যেতেন নতুন কিছু শেখার জন্য। এতোটা ডেডিকেটেড ছিলো মানুষটা।
জিদান জুভেন্টাসে থাকাকালীন সময়ে মার্সেলো লিপ্পি, আনচেলোত্তিদের অধীনে থেকে ফুটবলের রেয়ার কিছু টেকনিক সম্পর্কে জেনেছিলেন যা তার কোচিং ক্যারিয়ারে খুব কাজে লেগেছে । জিদান বর্তমানে যে সিস্টেমে খেলেন সেটা ‘দ্য ডার্ক আর্ট অফ ইতালিয়ান ফুটবল’-এর একটা অংশ। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ওপনেন্ট এর দূর্বলতাকে টার্গেট করে দল সাজানো। অর্থাৎ অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া।
সব কোচদের নিজস্ব সিস্টেম আছে। কিন্তু জিদানই মর্ডান ফুটবলের একমাত্র ম্যানেজার যার কোনো নিজস্ব সিস্টেম নেই। মনে করুন আপনার যদি কোনো পারমানেন্ট সিস্টেম ই না থাকে তাহলে আপনার অপনেন্ট কিভাবে আপনাকে কাউন্টার দিয়ে টেক্টিস বানাবে? জিদান এই জিনিসটার ফায়দা নেন বারবার।
এটাই তার মাস্টারস্ট্রোক বলতে পারেন , অবশ্য এই কাজে ঝুকিও অনেক বেশি, প্রতি ম্যাচে অপনেন্ট কে শতভাগ পার্ফেক্ট ভাবে রিড করে টেক্টিক্স বানাতে হয়, একটু ভুল হলেই সর্বনাশ । এরজন্য মেধা আর পরিশ্রম অনেক বেশি দরকার। জিদান গিরগিটির রংয়ের মতো প্রতি ম্যাচে সিস্টেম বদলান, স্টাইল বদলান, প্লেয়িং ইলেভেন বদলাম। বলা হয় যে জিদানের প্লেয়িং ইলেভেন আর মেয়েদের মন কেউ ই প্রেডিক্ট করতে পারবে না।
জিদানকে অনেকে ক্রস আর ‘আশাবাদী ট্যাকটিক্সের ম্যানেজার বলেন। এবার আমার প্রশ্ন হলো, মনে করুন আপনার দলে রোনালদো-বেনজেমর-বেলের মতো খেলোয়াড় আছে যারা হেডার এ খুব ই ভালো, তাহলে আপনি কি ম্যানেজার হিসেবে এটার ফায়দা নিবেন না? যেসব টিম লো ব্লক মেইনটেইন করে ডিফেন্সে বাস পার্ক করে বসে থাকে তাদের ধরাশায়ী করার জন্য এটা সবচেয়ে সেরা টেক্টিস। জিদান এই ট্যাকটিক্সে খেলার জন্য বদনামী হয়েছেন অথচ বর্তমানে ক্লপ, পেপরা এই ক্রসিং ই খুব বেশি ব্যবহার করছেন। এই সিজনে সবচেয়ে বেশি ক্রস খেলেছে পিএল চ্যাম্পিয়ন লিভারপুল।
জিদানের আরেকটি দারুন গুন হচ্ছে উনি ভুল থেকে শিক্ষা নেন। মানুষ মাত্রই ভুল হয়, জিদান ও তার উর্ধ্বে নন। কিন্তু জিদান সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরেরবার ঠিকই ঘুরে দাড়ান। এজন্য দেখবেন নক আউট স্টেইজে জিদান প্রথম লেগ স্ট্রাগল করলে দ্বিতীয় লেগে বারবার কামব্যাক করে ফেলতেন। উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক পিএসজির সাথের ম্যাচটা দেখুন, প্রথম ম্যাচে দুই রেগুলার মিড নিয়ে খেলে টুচেল এর কাছে ধরাশায়ী হয়ে যান, পরের লেগে তিন রেগুলার মিড আর ফ্রি রুলে ইস্কোকে নামিয়ে টুচেল কে কমপ্লিটলি আউটক্লাস করে দেন।
জিদানের ট্যাকটিক্যাল মাস্টার ক্লাসের আরেকটা সেরা উদাহরণ হচ্ছে জুভেন্টাসের বিপক্ষে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল। সেই মৌসুমে জুভের ডিফেন্স ছিলো চিনের প্রাচীর,পুরো ক্যাম্পেইন এ মাত্র ৩ গোল হজম করেছিলো। জিদান তখন ফরমেশন ডায়মন্ড থেকে ৪-৪-২ ফ্ল্যাটে সুইচ করে দুই উইং দিয়ে এটাক করে একে একে ৪ গোল দিয়ে হিউমিলেট করেন বুফনের দলকে।
নতুন মেয়াদে রিয়ালে ফিরে এসে এক বছরের মধ্যে ভাঙাচোরা দলের চেহারা বদলে দেন । যখন দেখলেন স্কোরার এর অভাব গোল কম হবে তখন তিনি ডিফেন্স শক্ত করে ফেললেন যাতে গোল কন্সিড ও কম করে। এলেগ্রি বলেছিলেন কাসেমিরোর পজিশনিং জিদানের অন্যতম সেরা ট্যাকটিক্যাল মাস্টারক্লাস। মাত্র এক বছর সময় নিয়ে রিয়ালের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ডিফেন্সিভ স্ট্রাকচার তৈরী করেছেন তিনি। ১৯ বছরের ভিনিসিয়াস আর বেঞ্জেমা কে নিয়ে মেসি-সুয়ারেজ-গ্রীজমানদের নিয়ে গড়া টিমকে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তুলেছেন।
অনেকে মজা করে বলে জিদানের কাছে কালো জাদু আছে, আমি বলবো আসলেই আছে নইলে তার ছোয়ায় প্লেয়াররা কিভাবে বেস্ট ফর্মে চলে আসে? মদরিচ, মার্সেলো, বেনজেমাদের সবাই বাতিলের খাতায় ফেলে দিছিলো, অথচ জিদান আসতেই এরা যেনো নবযৌবন লাভ করেছে । রামোস সত্যিই বলেছিলেন, ‘জিদান যেখানেই হাত দেন সেটাই সোনায় রুপান্তরিত হয়।’
বড় ম্যানেজার হতে হলে বড় মানুসিকতা থাকতে হয়। একটা উদাহরন দেই, কিছুদিন আগে বার্সার ম্যানেজার সেতিয়ান বলেছিলেন, ‘টানা সব ম্যাচ জেতা সম্ভব না, আমি নিশ্চিত মাদ্রিদও পয়েন্ট হারাবে’ আর জিদান বলেছিলেন, ‘বার্সা পয়েন্ট হারালো কি না সেটা আমার দেখার বিষয় নয়, আমাদের ১১ টি ম্যাচ বাকি আমরা এই ১১ টি ম্যাচ ১১ টি ফাইনালের মতো খেলবো।’ ‘Winners Focus On Winning’- এর পারফেক্ট উদাহরণ হচ্ছে এটা।
যে দল নিয়ে খেলে আনচেলোত্তি, বেনিতেজরা বরখাস্ত হলেন সেই দল নিয়ে ম্যানেজার জিদান ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন হন। জিদান দুইটি ফাইনাল জিতেন সেইম একাদশ খেলিয়ে। আজপর্যন্ত ইউসিএল এর নক আউটে স্টেইজে কেউ জিদানকে হারাতে পারে নি।
আজ পর্যন্ত একটা ফাইনালও হারেন নি। তিন বছরে তিনটা চ্যাম্পিয়নস লিগ ভাবা যায় এইগুলা? এতো অর্জন, এতো রেকর্ড এতোবার নিজের ব্রিলিয়ান্সের প্রমান দিয়েছেন। তাও শুনতে হয় ব্ল্যাক ম্যাজিক, ভাগ্যের সহায়তা আর রোনালদোর কৃতিত্ব।
জিজু সম্পর্কে বর্তমান সময়ে বসে একটা কথাই বলা যায় – আমরা ভাগ্যবান যে তাঁর মত অতিমানবীয় এক ক্রীড়াব্যক্তিত্বকে দেখছি!