তখনও পর্যন্ত ভারতের কোন ব্যাটসম্যান একদিনের ম্যাচে সেঞ্চুরি করে নি। কোন বোলার একদিনের ম্যাচে ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেয় নি। ফিল্ডিং, বিশেষ করে আউট ফিল্ডিং এবং রানিং বিটুইন দ্য উইকেট – একদিনের ক্রিকেটের এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের দিকেও ভারত তখনও নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।
স্বাভাবিক কারণেই একদিনের ক্রিকেটে ভারতকে পাত্তা দেওয়ার কোন কারণ খুঁজে পায় নি ক্রিকেট বিশ্ব। ১৯৮৩ বিশ্বকাপে সবকিছুই পাল্টে যাবে। একজন ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করবেন। একজন বোলার ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেবেন।
একজন ফিল্ডার বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন না হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচটি ধরবেন। এবং একজন ভারতীয় অধিনায়কের হাতে বিশ্বকাপের ট্রফি উঠবে। না, এরা চারজন ক্রিকেটার নয়। একজনই। কপিলদেব রামলাল নিখাঞ্জ – পুরো নাম।
কিন্তু বিশ্বকাপের আগে অব্দি এই কপিলেরও একদিনের ক্রিকেটে পরিসংখ্যান খুব একটা পাতে দেওয়ার মতো ছিল না। কিন্তু বিস্ফোরণের ইঙ্গিত ছিল। চারটে হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন এ অবধি, তিনটেতেই স্ট্রাইক রেট ১৫০-র বেশি।
কয়েক মাস আগেই পরপর দুটো সিরিজে বোথামকে টপকে ম্যান অফ দ্য সিরিজ হয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, ক্রিকেট মাঠে কোন ব্যাগেজ নিয়ে নামতেন না। সেজন্যেই সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দল ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও ভয় পেতেন না। লড়ে যেতেন বথাম বা ভিভের বিরুদ্ধে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একাই।
বলা হয় ভোমরার (bumble bee) নাকি যা শরীরের গড়ন তাতে Laws of Aerodynamics হিসেবে তার উড়তে পারার কথা নয়। সৌভাগ্যের কথা বিজ্ঞানীরা এটা জানলেও, ভোমরা নিজে সেই কথাটা জানে না। এবং সেইজন্যেই সে স্বচ্ছন্দে উড়ে বেড়ায়।
অনেকটা সেই রকমই, ১৯৮৩’র যে দলটার কপিল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কেন, সেমিফাইনালেও ওঠার কথা ছিল না। কিন্তু কপিল সেটা জানতেন না। মানতেন তো নাই। এবং সেজন্যেই হয়ত ১৯৮৩’র ভারতে কপিল দেবের মতো অধিনায়কের প্রয়োজন ছিল।
ইতিহাসে কপিলের মতো আরও একটি ক্রিকেটার খুঁজে পাওয়া কঠিন যার মধ্যে ক্রিকেট দেবতা এতটা প্রতিভা দিয়েছেন, অথচ যে ক্রিকেটের ঐতিহ্য, ক্রিকেটের ইতিহাস সম্বন্ধে এতটা উদাসীন। যে বিশ্বরেকর্ড করে জিজ্ঞেস করবে, এত হাততালি কীসের?
আমরা যখন ক্রিকেট দেখতাম তখন শুধু কপিলের ব্যাটিং, বোলিং বা ফিল্ডিং-ই নয়, উপভোগ করতাম তার ম্যানারিজমও। ফলো থ্রুতে বুটের টোকা দিয়ে বল নিজের হাতে তুলে নেওয়া। ঘাড় ঘুরিয়ে সূর্যের দিকে তাকাতে তাকাতে ব্যাট করতে নামা। বোলিং আরম্ভ করার আগে টি শার্টের বুকের অংশটায় অল্প টান মারা।
ডান হাত আকাশের দিকে, বাঁ হাত মাটির সমান্তরাল ভাঁজ করে এল বি’র আপিল করা। উইকেট পড়লে সতীর্থদের সঙ্গে দল বেঁধে এমন ভাবে সেলিব্রেট করা যে দেখে মনে হবে দাদুর চায়ের দোকানের সামনে কলেজের বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছে।
সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয়ের পর ব্যাট হাতে হাসতে হাসতে কপিল ছুটছেন – এ দৃশ্য যতবার দেখি ততবার আমার মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। অথবা ভিভের ক্যাচ ধরার পর স্প্রিন্ট টেনে মাঠে অনুপ্রবেশকারী দর্শকদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখে। তাদের মধ্যে একজন আবার তার কাঁধে উঠে পড়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্যে।
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালের দিন গ্যালারীতে একটা ফেস্টুন দেখা গেছিল, ‘কপিল ইটস বোথাম ফর ব্রেকফাস্ট।’ চিন্তা করুন একবার, খোদ ইংল্যান্ডের মাঠে তাদের সবচেয়ে বড় হিরোকে খেয়ে ফেলার কথা হচ্ছে। আর লাঞ্চের মেন্যু? ভিভ রিচার্ডস? কুকড বাই মদনলাল, ইটেন বাই কপিল! – ইস, এই ফেস্টুন কেন যে কেউ লর্ডসে ওড়ায় নি সেদিন!
এই দেখুন, আজে বাজে কথার মধ্যে কপিলদেব কেমন ক্রিকেটার ছিলেন সেই বিষয়ে তেমন আলোচনাই হল না। অবশ্য করেই বা কি লাভ! যারা কপিলের ক্রিকেট দেখেছেন তাদের কাছে এই আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। যারা দেখেন নি তাদের নিছক কয়েকটি সংখ্যা দিয়ে কপিলের ক্রিকেট বোঝাতে যাওয়া পণ্ডশ্রম।
তবে সংখ্যার কথা যখন উঠলোই তখন একটা সংখ্যা হয়ত অনেকেরই মনে আছে। ১৭৫। নটরাজের প্রলয় নৃত্যের শ্রেষ্ঠ উপাখ্যান এই সংখ্যা।