দ্য সিলি সেমিফাইনাল

২২ মার্চ রবিবার, ১৯৯২।

দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট অধ্যায়ের এক করুন দিন! সেদিন সিডনিতে কোনো ভুত ছিল কিনা, সেটিও অজানা। ওয়েসেলরাই নয় সেদিনে অদ্ভুতুড়ে কান্ডে হতবাক ছিল ক্রিকেট বিশ্ব। বৃষ্টি আইন সেদিন কত অদ্ভুতুরে সব কান্ডই না জন্ম দিয়েছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের সেই অন্ধকার ঢাকা দিনটি এখনো ক্রিকেট বিশ্বে বিস্ময়কর ঘটনা হয়ে আছে।

বর্ণবাদে জর্জরিত দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট কেবল নির্বাসন থেকে ফিরেছে! সব কিছু কাটিয়ে ফিরলেন ৯২ এর বিশ্বকাপে। দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে জায়গাও করে নিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালের মঞ্চে। তবে তারা কি জানতেন সিডনিতে সেদিন তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড নয় বৃষ্টি!

বিশ্বকাপের আগেই বৃষ্টি আইনে বেশ কিছু বিষয়ে সংশোধন করা হয় সেবার। রান তাড়ায় সুবিধের কথা মাথায় রেখে নিয়ম করা হয় বৃষ্টিতে যত ওভার কাটা পড়বে, পরে ব্যাটিং করা দলের লক্ষ্য ঠিক করা হবে প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং করা দলের সর্বনিম্ন রানের ততো ওভারগুলো বাদ দিয়ে!

এই নিয়ম তৈরির পেছনে গুরুদায়িত্বে ছিলেন রিচি বেনো। পূর্বের নিয়ম ছিল ওভারপ্রতি রানরেটের অনুপাত অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্র কমানো হবে। এই নতুন নিয়মই যেন সেমিফাইনালে কাল হয়ে দাঁড়ালো প্রোটিয়াদের জন্য।

সিডনিতে সেদিন টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নামে ইংলিশরা। শুরুতেই বৃষ্টির বাগড়ায় খেলা বন্ধ থাকে ১০ মিনিট, তবে কোনো ওভার কাটা যায়নি। খেলা শুরু হওয়ার পর গ্রায়েম হিকের ৮৩ আর বাকিদের ছোট ছোট কন্ট্রিবিউশনে ৪৫ ওভার শেষে ৬ উইকেটে ২৫২ রান করে ইংলিশরা। যেহেতু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যত ওভার হবে তত ওভারের প্রতিপক্ষ ব্যাট করতে সে হিসেবে ৪৫ ওভারেই নির্ধারিত হয় দক্ষিণ আফ্রিকার লক্ষ্যমাত্রা আসে ২৫৩ রান।

শুধু বৃষ্টি আইন নয় ছিল বেশ কিছু নতুন নিয়মও! ব্রডকাস্টারদের চাপের মুখে সেবার ইনিংস শেষের একটা  নির্ধারিত সময় বেঁধে দেওয়া হয় এবং সে সময়ের মাঝে যত ওভার হয়, ম্যাচ হবে ততো ওভারেই হবে এমন নিয়ম করা হয়! যার ফলে স্থানীয় সময় ৬টা ১০ মিনিটে প্রথম ইনিংস শেষ হবার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত সময়ে ৪৫ ওভার বল করে প্রোটিয়া বোলাররা যার জন্য খেলা নির্ধারণ হয় ৪৫ ওভারেই।

জবাবে লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে শুরুতে ওয়েসেলস দ্রুত ফিরলেও হুডসনের ব্যাট ভালো শুরু করে প্রোটিয়ারা। পিটার কার্স্টেন দ্রুত ফিরলেও আরেক প্রান্তে কুইপারকে নিয়ে এগোতে থাকে হুডসন! এরপর হুডসন ৪৩ রানে ফিরলেও ক্রুনযে ও জন্টি রোডসের ব্যাটে জয়ের দিকেই এগোতে থাকে প্রোটিয়ারা।

৪২.৫ ওভারে ৬ উইকেটে যখন প্রোটিয়াদের ২৩১ রান। ১৩ বল থেকে তাদের প্রয়োজন ছিল মাত্র ২২ রান। খুব কঠিন সমীকরণ নয়, ম্যাকমিলান রিচার্ডসনরা তখনো ক্রিজে সেট অনেকটাই! ঠিক তখনি সিডনির আকাশে নামলো মুশলধারে বৃষ্টি!

প্রায় ১২ মিনিট বৃষ্টি চলার পর সিডনিতে শুরু হলো এক অদ্ভুতুরে নাটক! যার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না প্রোটিয়ারা কিংবা ক্রিকেট বিশ্ব। চ্যানেল নাইন ও প্রোটিয়া ম্যানেজারের  ভুল বোঝাবুঝিতে স্কোরবোর্ডে দেখানো হলো বৃষ্টি আইনে ৭ বলে প্রয়োজন ২২ রান! কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেলো আসলে ৭ নয় ১ বলে প্রয়োজন ২২ রান।

ইংল্যান্ড ব্যাটিং করার সময় দুই ওভার মেইডেন হয় যার ফলে ওই দুই ওভারও কাটা যায়! এতে লক্ষ্যমাত্রা নেমে আসে ১ বলে ২২ রানে।

এমন অদ্ভুতুড়ে নাটকীয় টার্গেটে হতবাক শুধু দক্ষিণ আফ্রিকান খেলোয়াড়রাই না, পুরো ক্রিকেট বিশ্বই অবাক! এক অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে আবার নামবে প্রোটিয়ারা ব্যাপারটা হাস্যকর হলেও এই অদ্ভুতুরে নিয়মেই সেদিনের দিনটি দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট কালো অধ্যায় হিসেবে থাকবে চিরকাল।

‘সাউথ আফ্রিকা টু উইন, নিড টুয়েন্টি টু রানস, ফ্রম ওয়ান বল’ – জায়ান্ট স্কিনে এটা দেখে বুকে চাপা কষ্ট নিয়েই এক বল খেলতে নামেন ম্যাকমিলান-রিচার্ডসন। ক্রিস লিউইসের করা মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে এক রান নেন ম্যাকমিলান। কি ভাবছেন?  দক্ষিণ আফ্রিকা বৃষ্টি আইনে ২০ রানে হেরে গেছে?

একদমই না। ম্যাচ শেষে আরেক নাটকের জন্ম দেন অফিসিয়ালরা! হিসেব করে দেখলেন ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের সময় ওই দুই মেইডেন ওভারে একটি লেগ বাই রান ছিল৷ যার জন্য ইংল্যান্ডরা ম্যাচটা জেতে ১৯ রানে!

এতো সব ভূতুরে নাটকের শেষটা এখানেও নয়! শেষে হিসেব করে দেখা গেল ম্যাচ শেষ হবার পরেও নির্ধারিত সময় আরো দুই মিনিট বাকি ছিল খেলা! অর্থ্যাৎ চাইলেই আরো দুই ওভার খেলানো যেত সে সময়ে। অন্তত এক ওভার হলেও তো লক্ষ্যমাত্রা টা এমন ভুতুরে অসম্ভব কিছু হতো না। তাহলে কি ম্যাচ অফিসিয়ালসদের ভুলেই দক্ষিণ আফ্রিকার এমন ভূতুড়ে পরাজয়?

“যদি ভিনগ্রহের কেউ সেদিন এসসিজিতে নেমে আসতো, তাহলে এ পৃথিবীতে কোনও বুদ্ধিমান প্রাণী নেই ভেবে আবার ফিরে যেত।” – সেদিনের পর মার্টিন জনসন এক আর্টিকেলে বলেন। এরপর অবশ্য ১৯৯৯ সালে এই বৃষ্টি আইনের পরিবর্তন করা হয়। তবে ২৯ বছর কেটে গেলেও সেদিনের সেই রাত ক্রিকেট ভক্তদের জন্য অন্ধাকারচ্ছন্ন!

সেদিনের খেলার শেষ সময়টা নির্ধারিত ছিল স্থানীয় সময় রাত ১০ টা ১০ মিনিট পর্যন্ত। খেলা যখন শেষ হয় তখন বাজে রাত ১০ টা ৮ মিনিট। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে উদ্ভট নিয়ম আর ভুতুরে কান্ড সাথে দায়িত্বহীনতাই কি দক্ষিণ আফ্রিকার পরাজয়ের মূল বাধা নয়?

সেবারের পর আরো তিনবার বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেললেও ফাইনালে পৌঁছাতে পারেনি প্রোটিয়ারা। তবে কি ৯২ এর সেই কালো অধ্যায় ছায়া হয়ে প্রোটিয়াদের পিছনে ছুটছে? তারা কি পারবে সেই কালো ছায়া কাটিয়ে বিশ্বমঞ্চের ফাইনালে পা দিয়ে আলোর রেখায় দাগ কাটতে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link