মোটামুটি মাঝবয়সে পাঁ দেয়া লোকটা বারবার হয়তো নিজের মুঠোফুনের দিকে চোখ রাখছেন। অফিসের জন্য বের হবার আগেও হয়তো একবার স্কোরবোর্ডে চোখটা বোলালেন। হয়তো কিছু একটার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। কোন একটা স্মৃতি আবারো ফিরে পেতে চাইছেন। মেয়েরা যখন কাণ্ডটা করেই ফেললো তখন যেন ২১ বছরের একটা টগবগে তরুণ তাঁর ভিতর থেকে নিঙরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। ১৯৯৯ সালে সদ্য তারুণ্যের ছোঁয়া লাগা এই ভদ্রলোকই তো মাতিয়ে রেখেছিলেন ঢাকার রাজপথ।
আজ বাংলাদেশের মাঝবয়সী অনেকেই আবার নিজেদের তরুণ বয়সটায় ফিরে যাবেন। ১৯৯৯ সালে আকরাম খান-খালেদ মাহমুদ সুজনরা যখন বিশ্বকাপের প্রথম জয়টা এনে দিয়েছিল তখন তাঁরা ছিলেন টগবগে তরুণ। তাঁরাই তো রাস্তায় বেড়িয়ে পড়েছিলেন বিজয় উল্লাস করতে। আজ আবারো এমন একটা ভোর। তবে এবার মুহূর্তটা এসেছে মেয়েদের হাত ধরে।
পাকিস্তানকে এই নিয়ে টানা তিন ওয়ানডে ম্যাচে হারালো বাংলার মেয়েরা। তিনটিই বিদেশের মাটিতে- লাহোর, হারারে থেকে আজ হ্যামিলটন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে আজকের এই জয়। বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রথম শিকার। যেন ইতিহাসকেই টেনে আনলেন ফারজানা হক পিঙ্কিরা। ছেলেদের বিশ্বকাপেও প্রথম জয়টা এসেছিল এই পাকিস্তানের বিপক্ষেই। আজ ২০২২ সালেও জ্যোতিরা ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ১৯৯৯ সালে। হ্যামিলটন আর নর্দাম্পটন যেন মিলেমিশে একাকার।
১৯৯৯ সালে ওয়াসিক আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, শহীদ আফ্রিদিদের পাকিস্তানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিল পুচকে বাংলাদেশ। প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া আকরাম খানরা শোয়েব আখতারদের যেন বাইশ গজে পাত্তাই দিচ্ছিলেন না। আবার ইনজামাম উল হকদের নিয়ে গড়া ব্যাটিং লাইন আপকেও ধ্বংস করে দিয়েছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজনরা।
এরপর নর্দাম্পটনের সেই বিজয় উল্লাস ছড়িয়ে পড়েছিল ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামে। রাস্তায় মিছিল বেড়িয়েছে, লোক রঙ নিয়ে ছোটাছুটি করেছে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে হঠাত করেই একটা উৎসব নেমে এসেছিল। আজও সেই ইতিহাস নতুন করে লিখা হয়েছে। পাকিস্তান বধের আরেকটি কাব্য লেখার রসদ করে দিয়ে গেলেন বাংলার মেয়েরা। যদিও আজ আজ মিছিল হচ্ছেনা, তবে ক্রিকেটপ্রেমী বাঙালির হৃদয়ে ঝড় উঠেছে নিশ্চয়ই। আবার আরেকটি বিশ্বকাপ, আরেকটি জয়, আবারো সেই ১৯৯৯।
যদিও পথটা এতটা মসৃণ ছিল না। ব্যাট হাতে অবশ্য ফারজানা পিঙ্কি ও শারমিন আক্তার দারুণ একটা শুরু এনে দিয়েছিলেন। অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি বিশ্বকাপে নিজের অধিনায়কত্ব দিয়ে নজর কাড়ছেন। তবে ব্যাট হাতে তাঁর সেরাটা দিতে পারছিলেন না। আজ সঠিক সময়ে তিনিও জ্বলে উঠলেন। তাঁর ব্যাট থেকেও আসলো অনবদ্য ৪৬ রানের ইনিংস। ফলে ৫০ ওভারে হ্যামিলটনে মেয়েদের ২৩৪ রানের লড়াকু সংগ্রহ।
তবে বল হাতে শুরুটা আশানরুপ হলো না। একটা সময় মনে হচ্ছিল এই ম্যাচ আর জেতা সম্ভব না। পাকিস্তানের ওপেনার সিদ্রা আমিনের সেঞ্চুরিতে দারুণ শুরু পায় দলটা। ৩০ ওভার যখন পেরিয়ে গেছে তখন পাকিস্তানের উইকেট গেছে স্রেফ একটি। তবে মেয়েরা বিশ্বাস হারায়নি। উইকেটের পিছন থেকে শামীমা সুলতানা বলছিলেন, ‘সহজে ছেড়ে দিও না, লেগে থাকো…’
বাংলাদেশের বোলাররা আসলেই হাল ছাড়েননি। বরং কন্ঠ ছেড়েছেন জোরে। ফাহিমা খাতুন, রুমানা আহমেদরা নিজেদের সেরাটা নিঙরে দিয়েছেন।
১৫৫ রানে এক উইকেট হারানো পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইন ভেঙে পড়লো তাসের ঘরের মত। ১৮৭ রানের মধ্যেই নেই পাকিস্তানের ৭ উইকেট। শেষ দিকে পাকিস্তান আবার ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে তবে তাতে কাজ হয়নি। বাংলার মেয়েরা হাল ছাড়েননি, শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ৯ রানের মহাক্যাবিক জয়। আবারো ক্রিকেট পাড়ায় উৎসব।
যদিও এই মেয়েরা ক্রিকেটটা খেলেন নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। তবুও বারাবার সাফল্য গুলো এনে দিচ্ছেন তাঁরাই। বাংলাদেশকে প্রথম এশিয়া কাপটাও এনে দিয়েছিলেন এই নারীরাই। তবুও নারীদের ক্রিকেটের অবকাঠামো, চেহারা কিছুই বদলায়নি। তবুও জ্যোতিরা হাল ছাড়ছেন না, তাঁরা নতুন ভোরের অপেক্ষায় আছেন।
১৯৯৯ সালের সেই জয়ে মাঠে দর্শকের ছোটাছুটির মধ্যে জন্ম হয়েছিল নতুন এক ক্রিকেট শক্তির। ২০২২ সালের বাস্তবতায় মাঠে দর্শক ঢুকের উৎসব করার বাস্তবতা নেই। তবে, নারী ক্রিকেটেও নতুন এক শক্তির জাগরণ যদি হয়, তাহলে সেটাই বা কম কিসে!