ম্যাচের তখন ৬৪.১ ওভার।
চট্টগ্রামের এম.এ আজিজ স্টেডিয়াম। বাংলাদেশের দেয়া ৩৮১ রানের টার্গেটে ব্যাট করছিল জিম্বাবুয়ে। উইকেটে ছিলেন ক্রিস্টোফার এমপোফু। এপাশে বল করছিলেন এনামুল হক জুনিয়র। ওভারের দ্বিতীয় বলটা তিনি করলেন স্লটের একটু সামনে; ডিফেন্স করতে গিয়ে ব্যাট ছুঁয়ে ক্যাচ উঠে গেল। সিলি পয়েন্টে দাঁড়ানো মোহাম্মদ আশরাফুল ক্যাচ লুফে নিতে ভুল করলেন না। ক্যাচটা ধরেই এক হাতে বল আর আরেক হাতের অনামিকা আকাশের দিকে তুলে ওখানেই একটা বৃত্তাকার পথ ঘুরে এলেন তিনি।
এম.এ আজিজ স্টেডিয়ামের গ্যালারি তখন উন্মাতাল। ড্রেসিং রুমে দেখা যাচ্ছে ডেভ হোয়াটমোরকে; দাঁড়িয়ে সমানে তালি দিচ্ছেন তিনি। কমেন্ট্রি বক্সে আতহার আলী খান বলে যাচ্ছেন, বাংলাদেশ হ্যাভ ফাইনালি ডান ইট….
আসলেই তো, অবশেষে পেরেছিলো বাংলাদেশ! ৩৪ টেস্ট আর ৫ বছর পর নিজেদের ইতিহাসের প্রথম টেস্ট জিতেছিলো দলটি। আর সেই জয়ের দিনটি আজকের দিনে, ২০০৫ সালে!
এরপর আরো ৮৪ টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। এই ৮৪ টেস্টের মাত্র ১৩ টাতে জয় বলে দেয়, টেস্ট ক্রিকেটে দুই দশকে যেটুকু উন্নতি করার কথা ছিল আমাদের তা আমরা করতে পারিনি। এমনকি ন্যূনতম যেটুকু ম্যাচ আমাদের জেতা উচিত ছিল তাও আমরা জিততে পারিনি। ২০০৫ সালে প্রথম জয় পাওয়া দলটা তাদের ১৪ তম জয় পেয়েছে ২০২০ সালে এসে; এই সব কিছু নিয়েই আজকের গল্পটা!
বাংলাদেশ তাদের প্রথম টেস্ট ম্যাচ জেতে জিম্বাবুয়ের সাথে। প্রথম ম্যাচ ড্রও করে জিম্বাবুয়ের সাথে। প্রথম সিরিজও জেতে এই দলটির বিপক্ষে। অভিষেক টেস্ট খেলার ৪ ম্যাচ পর। ঠিক ষষ্ঠ ম্যাচে এসে ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের সাথে প্রথমবারের মত ম্যাচ শেষে বাংলাদেশ হারা দলের নাম নয়। সেই ম্যাচের পর আরো ২১ ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ; ২১ টাতেই হার নিয়ে মাঠ ছেড়েছে তাঁরা। এই ২১ ম্যাচের প্রতিপক্ষ হিসেবে ছিল টেস্ট ক্রিকেটের সাত দল। এখন এই ২১ ম্যাচ পর আবার যে ম্যাচটা ড্র করে বাংলাদেশ তার একটা বিশেষত্ব ছিল।
২০০৪ সালে বুলাওয়েতে ড্র করা সেই ম্যাচটা ছিল বাংলাদেশের জন্যে দেশের বাইরে ড্র করা প্রথম ম্যাচ। তবে ‘প্রথম’ এর দেখা পাওয়ার পর ‘দ্বিতীয়’-র জন্যে বাংলাদেশকে একদমই অপেক্ষা করতে হয়নি। সেই সিরিজের পরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্রোস আইলেটে ব্রায়ান লারার দলের বিপক্ষে ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ।
তবে, ড্র পেলেও বিদেশের মাটিতে জয় পেতে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছিল বাংলাদেশকে। তা বাংলাদেশকে সেই ভোগান্তি থেকে মুক্তি দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। নিজেদের টেস্ট ইতিহাসের ৬০তম ম্যাচে বাংলাদেশ যে দলটার সাথে খেলতে নামে- সেটা ছিল মোটামুটিভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তৃতীয় সারির দল। বোর্ডের সাথে ঝামেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের তারকা ক্রিকেটাররা নিজেদের নাম সরিয়ে নেওয়ায় সে ম্যাচে বড়সড় সুযোগই আসে বাংলাদেশের সামনে। তা সেই সুযোগের পুরো ব্যাবহার করে সেই ম্যাচটা জিতেও নেয় বাংলাদেশ।
২০০৯ সালের ঐ সিরিজ জয়ের পর হোম-এওয়ে মিলিয়ে আরো ১৭ টেস্ট ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ আর কোনবারই তাঁরা জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেনি। এর মাঝে আনুষ্ঠানিকভাবে টেস্ট ম্যাচের অধিনায়কত্ব নিয়ে ছেড়েও দিয়েছেন সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমকে দেওয়া হয়েছে অধিনায়কত্ব। তাও ম্যাচ জয়ের দেখা পাচ্ছিল না বাংলাদেশ।
এরপর নিজেদের ৭৯তম টেস্ট ম্যাচে এসে জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ- সেটাও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারে ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। এই সময়টা থেকে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। মুশফিকুর রহিম ডাবল সেঞ্চুরি করেন, শ্রীলঙ্কায় গিয়ে দল টেস্ট ড্র করে, আবুল হাসান রাজু আর সোহাগ গাজীরাতো রেকর্ড বুকেই নাম উঠিয়ে ফেলেন আর সাকিব আল হাসান তো আগে থেকেই আছেন।
মোটামুটিভাবে টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাক্তিগত পারফর্ম্যান্সের উন্নতির গ্রাফটা এ পর্যায়ে উর্ধ্বমুখী হলেও জয়ের গ্রাফটা যা ছিল তাই থেকে যায়। ঘর কিংবা ঘরের বাইরে বাংলাদেশ কোনভাবেই টেস্ট ম্যাচে জয় পাচ্ছিল না। বেশ কিছু ম্যাচে অবশ্য আমরা ড্র নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলাম কিন্তু সেগুলো ঠিক পর্যাপ্ত ছিল না।
টেস্ট ক্রিকেটে জয়ের এই খরা কাটাতে এক সময় হোম ম্যাচ জয়ের এক পরিকল্পনা আঁটে বাংলাদেশ। নিজেদের মাটিতে নিখাদ ঘূর্ণি উইকেট তৈরি করে আর একাদশে একঝাঁক স্পিনার নিয়ে সে সময় বেশ কিছু ম্যাচ জিততে পারে দলটা। এই পরিকল্পনাতে অবশ্য বাংলাদেশ এখনও অটুট আছে। আর থাকবে নাই বা কেন? ঘরের মাঠে সুবিধা নেওয়া তো অন্যায় নয়। নিউজিল্যান্ড কিংবা ভারত কি স্পোর্টিং পিচে ম্যাচ খেলে এক নম্বর টেস্ট দল হয়েছে? হয়নি!
তবে, এই ঘরের ম্যাচ জয়ের পরিকল্পনাও খুব বেশি সুবিধার হবেনা বাংলাদেশের জন্যে। এর কারণ, এই পরিকল্পনাতে নির্ভর করতে হবে স্পিনারদের ওপর। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ছড়ি ঘোরানোর মত স্পিনার আর পাইপলাইন থেকে পাচ্ছেনা বাংলাদেশ। বাঁহাতি স্পিনারের সরবরাহ তো বন্ধ হয়েছে আগেই। স্পিনারদের আভিজাত্যও কমতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। শেষ দুই ঘরোয়া টুর্নামেন্টের কোনটাতেই সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর তালিকায় কোন স্পিনার নেই। আগে যেমনটা দেখা যেত, ঘরোয়া সার্কিটে দলগুলি স্পিনারদের ওপরই ভরসা করত। সেই ভরসার জায়গাটা এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে, আর তা পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার পথেই আছে।
দ্বিতীয় আরেকটা সমস্যা হল, আমাদের দলে নিখাদ ঘূর্ণি পিচে ব্যাট করার মত ব্যাটসম্যানের সংখ্যা খুবই কম। স্পিনিং পিচগুলিতে ব্যাট করতে গেলে যেটা হয়, টেকনিক্যালি খুবই শক্ত হতে হয় ব্যাটসম্যানকে। আমাদের দলে ওরকম ব্যাটসম্যান খুবই কম। তাই এই পরিকল্পনাতে খুব বেশিদূর আগানোটা আসলে বাংলাদেশের জন্যে শক্ত হবে।
যাহোক, টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের গল্প বলছিলাম।আজকের দিনে আমাদের প্রথম টেস্ট জয়ের ১৬ বছর পূর্তি হয়েছে। সেই গল্পে ফিরে আসি।
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জিতেছে জিম্বাবুয়ের সাথে। ১৭ ম্যাচে ৭ জয়, ৭ হার আর ৩ ড্র।
দ্বিতীয় স্থানে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এদের সাথে ১৬ ম্যাচ খেলে ৪ জয়, ১০ হার আর ২ ম্যাচে ড্র নিয়ে মাঠ ছেড়েছে বাংলাদেশ।
এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার সাথে ৬ ম্যাচ খেলে ১ জয় আর ইংল্যান্ডের সাথে ১০ ম্যাচ খেলে ১ জয় আছে বাংলাদেশের।
জয়ের শতাংশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে করুণ অবস্থা শ্রীলঙ্কার সাথে। নিজেদের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২০ ম্যাচ তাঁরা খেলেছে শ্রীলঙ্কার সাথেই। সেই ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে মাত্র একটা ম্যাচে। সেই জয়টা ছিল দেশটির শততম টেস্ট ম্যাচে!
এছাড়া টেস্ট খেলুড়ে অন্য দেশগুলির মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে এখন অব্দি জয়ের দেখা পায়নি বাংলাদেশ।
মাঠের হিসেবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জিতেছে শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামে। খুবই অনুমিত তথ্য, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ম্যাচ জিতেছে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। এছাড়া দেশের বাইরে দুই দশকে বাংলাদেশ ম্যাচ জিতেছে মাত্র চারটি স্টেডিয়ামে- সেন্ট ভিনসেন্ট, হারারে, গ্রানাডা আর কলম্বো!
টেস্ট ম্যাচ জয় উপলক্ষ্যেই যেহেতু আজকের এই গল্প বলা, তাহলে আরেকটু বাড়িয়ে বলা যাক। জয়ী টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন মুশফিকুর রহিম। বাংলাদেশের জেতা ১৪ টেস্ট ম্যাচের ১৩ টাতেই মুশফিক দলীয় সদস্য ছিলেন। এই ১৩ ম্যাচে মুশফিক করেছেন ১০৫৭ রান, গড় ৫২.৮৫! গড়ের হিসেবে অবশ্য জয়ী ম্যাচে সবচেয়ে বেশি গড় মুমিনুল হকের- ৫৯.৬৬! (ন্যূনতম ৫ জয়ী ম্যাচের সদস্য হিসেবে)
বাংলাদেশ এখন অব্দি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে ১১৯টি। এর মধ্যে ৬৩টি ম্যাচ খেলেছে ঘরের মাঠে, আর ৫৬টি ম্যাচ খেলেছে প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে। ঘরের মাঠে ৬৩ ম্যাচের বিপরীতে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ১০টি ম্যাচে, আর ঘরের বাইরে ৫৬ ম্যাচের বিপরীতে বাংলাদেশের জয় মাত্র ৪ ম্যাচে!
বোঝাই যাচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের দৈন্যদশা অনেক বেশিই। এই বেশি হবার দায় যে শুধু বোর্ড কিংবা খেলোয়াড়দের তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশ যে পর্যাপ্ত টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগই পায় না। একটা খেলা যত বেশি খেলা হবে, সেই খেলা সম্বন্ধে তত বেশি জানা যাবে। বাংলাদেশ গড়ে বছরে টেস্ট ম্যাচ খেলে মাত্র পাঁচটি। এক বছরে সবচেয়ে বেশি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশ ২০০৩ সালে। সেবার এক বছরে ৯ ম্যাচ খেলার পর আবার এক বছরে ৯ ম্যাচ খেলার সুযোগ মেলে ২০০৮ সালে। এর মধ্যে ২০১২ আর ২০১৬ তে মাত্র দুই ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ।
তাই, দুই দশক টেস্ট ক্রিকেটে কাটিয়ে দেওয়ার পর বাংলাদেশ যে টেস্ট ক্রিকেটের বেসিকটুকু ধরতে পারেনি তার পেছনে এই কম ম্যাচ খেলাটাকে কিছুটা হলেও দায় করা যায়। অবশ্য পুরো দায় অবশ্যই করা যায়না। টেস্ট ক্রিকেটে চর্চা যেখানে হবে, সেই ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের কাঠামোটাও যে আমাদের খুব বেশি ভাল না। আবার, আমাদের খেলোয়াড়দের টেস্টে উন্নতির মানসিকতাও কতটুকু সেটা নিয়েও একটা প্রশ্ন তোলা যায় জোরেশোরেই।
তা যাক, সে প্রশ্ন অন্যদিন তোলা যাবে। আপাতত টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়ের ১৬ বছর পূর্তির গল্পই হোক কেবল।