আক্ষেপ নামের ছোট গল্প

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটা লম্বা সময় পার করে ফেলেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আমাদের বোলিং হয়ত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে একটু উন্নত হচ্ছে। তবে আমাদের ব্যাটিং যেন অধারাবিকতার পরিচায়ক হয়ে উঠেছে। এই ভাল, এই খারাপ। কখনো বড় বড় জুটি ম্যাচ জেতাচ্ছে তো কখনো হুরমুড় করে পুরো ব্যাটিং লাইনআপ ধ্বসে পড়ছে।

কালের বিবর্তনে আমাদের ব্যাটিং অর্ডারে যেমন চাহিদা বাড়ছে তেমনি করে সম্ভাবনার অপমৃত্যুর লাইনও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এমন কিছু আক্ষেপের উপাখ্যান নিয়ে পুরো একটা বই লিখে ফেলা যাবে হয়ত। তবে আজ কেবল পাঁচজন ব্যাটার নিয়েই হবে আলোচনা।

  • এনামুল হক বিজয়

আন্তার্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুটা বেশ আশা জাগানিয়া ছিল এনামুল হক বিজয়ের। আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম যে হয়ত আমরা তামিম ইকবালের যোগ্য এক উত্তরসূরি কিংবা তাঁর সহযোদ্ধা পেয়ে গিয়েছিলাম। যিনি কিনা দক্ষ হাতে সামলে নিবেন দলের ব্যাটিংয়ের প্রারাম্ভ। অভিষেক সিরিজেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১২০ রানের একট দুরন্ত শতক হাঁকিয়ে তিনি নিজেই আমাদের সে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলেন।

ক্যারিয়ারের প্রথমভাবে তিনটি সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে তিন লম্বা দৌড়ের ঘোরা। তাঁকে নিয়ে বাজি ধরাই যায়। বাংলাদেশ জাতীয় দলের টিম ম্যানেজমেন্টও ধরেছিল। একটানা খেলে গিয়েছেন ২০১৫ বিশ্বকাপ অবধি। সে ২০১৫ বিশ্বকাপটাই তাঁর জন্যে কাল হল। এক ইনজুরি তাঁকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেয়। সেই সাথে বাংলাদেশ জাতীয় দলেরও অপরিচিত মুখ হতে শুরু করেন তিনি।

তিন বছরের দীর্ঘ বিরতি শেষ আবার তিনি জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে নিজেকে আর সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি। পুরোনো সেই এনামুল হক বিজয়কে খুঁজে পাওয়া যায়ন। অগ্যতা আবার দলের বাইরে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি রয়েছেন দূর্দান্ত ফর্মে। তাছাড়া রয়েসয়ে ব্যাটিং করা বিজয়ের অবসান ঘটিয়েছেন তিনি। নিজের ব্যাটিংয়ের বেশ উন্নয়ন করেছেন বোঝাই যায়।

তবে কি আর একটিবার তিনি সুযোগ পেতে পারেন না? হয়ত পারেন। প্রশ্ন আসতে পারে কোন পজিশনে? অবশ্যই ওপেনিংয়ে। ওয়ানডেতে তামিমের সাথে তিনি ওপেনিং করবেন। লিটন দাস খেলবেন পাঁচ কিংবা ছয় নম্বরে অথবা সাকিবের অবর্তমানে তিন নম্বরে। যেহেতু লিটন পুরনো বলে ভাল খেলেন। তবুও ফর্মের তুঙ্গে থাকা খেলোয়াড়কে সুযোগ তো দেওয়া উচিৎ।

  • জহুরুল ইসলাম অমি

অমিত সম্ভাবনাময় একজন ক্রিকেটার ছিলেন জহুরুল ইসলাম অমি। বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক দল থেকে নিজের পারফরমেন্স ও দক্ষতার সিঁড়ি বেয়ে তিনি একদিন হাজির হয়েছিলেন জাতীয় দলে। ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ম করে পারফরম করা অমির অভিষেক হয় ২০১০ সালে। টানা কিছুদিন দলের হয়ে তিন ফরম্যাটেও খেলেছেন তিনি। তবে আশার প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি।

তিনি বড্ড ফ্যাকাশে ছিলেন জাতীয় দলে। ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ প্রসিদ্ধ অমি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাদামাটা। অল্প দিনেই জাতীয় দলের ক্যারিয়ার স্তিমিত হতে শুরু করে তাঁর। বাদ পড়েন জাতীয় দল থেকে। অথচ প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটে তাঁর রান প্রায় আট হাজার ছুঁই ছুঁই। আর ‘লিস্ট এ’- তে রান ছাড়িয়েছে চার হাজারের গণ্ডি। পারিবারিক দুর্যোগ আর প্রিয়জন হারানোর বেদনায় সিক্ত অমি ক্রমশ ক্রিকেট থেকে যেন হারিয়ে যেতে বসেন।

অথচ তাঁকে এক সময় বিবেচনা করা হত বাংলাদেশ দলের টপ অর্ডার সামলে নেওয়ার অন্যতম অস্ত্র। তাঁর উপর ভীষণরকম আস্থা ছিল সবার। তবে তিনি সে প্রতিদানটুকু দিতে পারেননি। ঘরোয়া ক্রিকেটেও এখন আর আলো ছড়ান না অমি। হয়ত নিজের ক্যারিয়ারের গোধুলি লগ্নের দিকে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছেন। এমন সাদামাটা সমাপ্তি নিশয়ই পোড়াবে জহুরুল ইসলাম অমিকে।

  • নাসির হোসেন

‘মিস্টার ফিনিশার’ এই তকমাটার মাহাত্ম্য ঠিক কতটা তা হয়ত আন্দাজ করতে পারেননি নাসির হোসেন। ইনিংসের শেষের দিকে শক্তহাতে প্রতিপক্ষ বোলারদের সামলে নিয়ে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার কাজটা তো আর সবাইকে দিয়ে হয়না। নাসির সেটা পারতেন। তাইতো ভক্তকূল তাঁকে মিস্টার ফিনিশার তকমা দিয়েছিলেন ভালবেসে।

দারুণ অ্যাক্রোব্যাটিক ফিল্ডিং এবং ব্যাট হাতে চাপের মুখে ব্যাট করে যাওয়ার সামর্থ্য এসবকিছু নাসিরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে বাধ্য করেছিল। তাছাড়া পার্টটাইম বোলিংও তিনি করতে জানতেন। মূলত একজন প্যাকেজ ক্রিকেটার হিসেবে তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ। আর বাংলাদেশ দলে একজন ফিনিশারের অভাব তো একেবারে শুরু থেকেই। সে জায়গাটা দখল করতে পেরেছিলেন নাসির।

কিন্তু নিজের উশৃঙ্খল জীবনযাপন আর পরিশ্রম না করার মানসিকতা তাঁকে ছিটকে দিয়েছে জাতীয় দল থেকে। এখন আর জাতীয় দলের রাডারেও নেই তিনি। রয়েছেন যোজন-যোজন দূরে। থাকাটাও বেশ স্বাভাবিক। তিনি যে রানে নেই। পরিশ্রম করার মানসিকতার অভাব তাঁর ধারাবাহিক রান করার অপ্রতুলতাকে বাড়িয়ে দিয়েছেন বহুগুণে। তাই তো তিনি পরিণত হয়েছেন আক্ষেপে।

  • নাঈম ইসলাম 

ঘরোয়া ক্রিকেটে টানা ছয় বলে ছয় ছক্কা ছাড়াও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেষ উইকেটে তিন বলে তিন ছক্কা হাঁকিয়ে ‘ছক্কা নাঈম’ হিসেবেই বিপুল পরিচিতি লাভ করেছিলেন ডান হাতি ব্যাটার নাঈম ইসলাম। এখনও তরুণ সব নাঈমদের ভীড়ে তাঁকে আলাদা করা যায় ছক্কা নাঈম বলে। ঠিক এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন তিনি।

সম্ভাবনাময় একজন অলরাউন্ডার ছিলেন তিনি। ইনিংসের শেষ দিকে স্লগ করার ক্ষমতা ছিল তাঁর। শারীরিক গঢ়নে খুব বেশি হৃষ্টপুষ্ট না হলেও দারুণ টাইমিংয়ের তিনি বাউন্ডারি হাঁকাতে ছিলেন বেশ পটু। তাছাড়া ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে ব্যাটিং করা মত সামর্থ্য এবং ধৈর্য্য দুইই ছিল নাঈমের মধ্যে। তবুও কোন এক অজানা কারণে তিনি বাদ পড়েন জাতীয় দল থেকে।

তিনি যেবার বাদ পড়েন তার ঠিক আগের সিরিজেও তিনি টেস্টে করেছিলেন সেঞ্চুরি। তবুও তাঁকে তিন ফরম্যাট থেকেই ছুড়ে ফেলে দেওয়ার কোন উত্তর হয়ত জানা নেই বাংলাদশ টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে বিসিবির। অজ্ঞাত সে কারণেই ২০১৪ এর পর আর তাঁকে দেখা যায় নি জাতীয় দলের জার্সি গায়ে। রীতিমত হারিয়ে গেলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে হারিয়ে গেলেও তিনি সরব ছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেট।

প্রতিটি মৌসুমে তিনি রান করে গেছেন। ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন। তবুও নির্বাচকদের অগ্রাহ্যের পাত্র যেন সবসময়ই তিনিই ছিলেন। অথচ তিনি হতে পারতেন আমাদের লোয়ার মিডল অর্ডারের এক আস্থা, ভরসার অটুট স্তম্ভ। বাংলাদেশ ক্রিকেট তাঁর সেই সম্ভাবনাময় স্তম্ভকে নিজ হাতে হাতুড়িপেটা করে ভেঙে ফেলেছে। তবে এখনও ধারাবাহিকভাবে উজ্জ্বল নাঈম। আরেকটি সুযোগের অপেক্ষা তিনি হয়ত করেন। কম করে হলেও বছর তিনেক তিনি সার্ভিস দিতে পারবেন জাতীয় দলকে।

  • জিয়াউর রহমান

হালের সাইফউদ্দিনদের আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটেও একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার এসেছিলেন, জিয়াউর রহমান। মিডিয়াম পেস বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাট হাতে হার্ডহিটও অনায়াসে করতে পারতেন জিয়াউর রহমান। তিনি এক কার্যকরী পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে বাংলাদেশকে সার্ভিস দিয়ে যেতে পারতেন। তবে বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট আরও একজন সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে বড্ড বেশি অধৈর্য্য।

পর্যাপ্ত সুযোগ তিনি কখনোই পাননি। তাঁর ব্যাটিং সত্ত্বার প্রমাণ রাখার মত পরিস্থিতি তিনি খুব কমই পেয়েছেন। তাছাড়া তিনি যে পজিশনে সাধারণত ব্যাটিং করতে নামতেন তা ছিল বড্ড চাপের এক অবস্থান। ইনিংস প্রায় শেষের দিকে দ্রুত রান তুলতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিদিন একজন ব্যাটার রান করবেন সমানতালে এমন প্রত্যাশা করাটা মুর্খের কাজ। তাঁর থেকে হয়ত আমরা তেমনটাই প্রত্যাশা করা শুরু করেছিলাম।

ফলস্বরুপ প্রত্যাশার চাপের ভার সইতে না পেরে তিনি আজ বহুদূরে। ২০১৪তে তিনি শেষবার খেলেছিলেন টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে। এরপর আর তাঁকে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়াতে দেখা যায়নি। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি নিয়মিত তাঁর রোল বুঝে পারফরম করছেন। হার্ডহিটারের অভাব ঘুচাতে তাঁকে আরও একবার সুযোগ কি দেওয়া যায়?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link