‘দুষ্টু’ জিমি এখন

আজ ব্লন্ড তো, কাল ব্লু।

রোজ বদলাচ্ছে চুলের রং। শুধু কী চুল? সবসময় হালফ্যাশনের পোশাক। নিত্যনতুন স্টাইলের ঝকমারি টি-শার্ট, জিন্স কিংবা হঠাৎ কেতাদূরস্ত। মডেল স্ত্রীকে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন দুনিয়া। প্রায় নগ্ন হয়ে হাজির হচ্ছেন ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে। আবার নিজেই খুলে বসছেন ফ্যাশন ডিজাইনিং হাউজ।

কী ভাবছেন? ডেভিড বেকহ্যামের কথা বলছি?

মোটেও না। আজকে বললে হয়তো অনেকে বিশ্বাস করবেন না। আপনারা ভদ্রস্ত যে ইংলিশ ফাস্ট বোলারটিকে মাঠে দেখতে পান, তিনি এক সময় সত্যিই ‘প্লে বয়’ ছিলেন। তিনি ‘ক্রিকেটের বেকহ্যাম’ তকমাও শরীরে লাগিয়ে ফেলেছিলেন।

হ্যা, তিনি সর্বকালের সবচেয়ে সফল ফাস্ট বোলার। তিনি এক সময়ের রমনীমোহন তারকা জেমস মাইকেল অ্যান্ডারসন; জিমি অ্যান্ডারসন।

সময় হয়তো জিমিকে অনেকটাই সামলে রেখেছে এখন। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের আগ্রহটা এখনও থাকলেও আগের মতো মাঠে খুব স্লেজিং করেন না। এখন তিনি অনেকটাই শান্ত ধরণের পোশাক পরিচ্ছদ বাছাই করে চলেন। আগের মত কথায় কথায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেন না। কিন্তু একটা জায়গায় বদলাননি অ্যান্ডারসন; ক্রিকেট মাঠে।

বরং বলা যায়, সময়ের সাথে সাথে ওই বাইশ গজে আরও ভয়ানক হয়েছেন। একটার পর একটা মাইলফলক টপকেছেন। নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আরও ক্ষুধার্থ হয়ে উঠেছেন। এই যেমন আজকে, নিজের এলাকা ব্রিটেন থেকে বেরিয়ে এসে প্রথম ফাস্ট বোলার হিসেবে শ্রীলঙ্কার গলে তুলে নিলেন ৬ উইকেট। এতে জিমি আরেকটা রেকর্ড বইতে নাম লেখালেন।

জিমি অবশ্য শুরু থেকেই এমন।

ল্যাঙ্কারশায়ারের ঘরের ছেলে। একেবারে ছোটবেলা থেকেই নিখাদ পেসার হতে চেয়েছেন। তবে তখন ছিলেন সিম বোলার। কিন্তু ১৭ বছর বয়স আসতে না আসতে গতি দানবে পরিণত হলেন। ল্যাঙ্কারশায়ার একটুও ভুল করেনি তার ঘরের ছেলেকে লুফে নিতে।

কাউন্টি দলের হয়ে মাত্র ৩টি ওয়ানডে খেলার পরই ইংল্যান্ড জাতীয় দল থেকে ফোন পেলেন। অ্যান্ডি ক্যাডিকের ‘কাভার’ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া সফরে যেতে হবে। সেটা ২০০২ সালের ঘটনা। এতোটাই আকষ্মিক ছিলো জেমস অ্যান্ডারসনের এই ডাক পাওয়া যে, তার জন্য নাম লেখা বা নম্বর ছাপা একটা জার্সিও তৈরী ছিলো না। ওই পরিচয়হীন অবস্থায় মাঠে নামা জিমি অ্যান্ডারসন এখন ফাস্ট বোলিংয়ের সবচেয়ে বড় পরিচয়।

পরের বছর বিশ্বকাপ খেলে ফেললেন এবং পরের বছর টেস্ট অভিষেকও হয়ে গেলো। অ্যান্ডারসন কোথাও নিজেকে চেনাতে বিলম্ব করেননি। ২০০৩ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো সেই স্পেল করলেন। টেস্ট অভিষেকেই লর্ডসে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। এরপর পাকিস্তানের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক।

এখান থেকে আর জিমিকে আটকায় কে!

আটকেছিলো ইনজুরি। মনে হচ্ছিলো, জিমির ক্যারিয়ারটা বছর তিনেক বয়সেই শেষ হয়ে যাবে। ২০০৬ সালে বাজে রকম চোটে পড়েছিলেন। সে বছর ক্রিকেটই খেলতে পারেননি। ফলে ২০০৭ বিশ্বকাপটা অতিদূরের স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো। কিন্তু জিমি ওখান থেকে ফিরে এলেন।

জিমির ক্যারিয়ারে তিনটি বাঁক আছে।

২০০২ সালে অভিষেক, ২০০৭ সালে নতুন শুরু এবং ২০১০ সালে আজকের জিমির জন্ম। ২০০৭ সালে মূলত ভারতের ইংল্যান্ডে সফরে নিজের নতুন রূপটা সামনে আনলেন। সেই সফরে শচীন টেন্ডুলকারকে টেস্টেই ৩ বার আউট করেছিলেন। ১৪ উইকেট নিয়েছিলেন সেই টেস্ট সিরিজে। বলা যায়, মিডিয়া প্রথমবারের মতো ক্রিকেটীয় কারণে জিমিকে নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠলো।

আস্তে আস্তে ইংল্যান্ডের প্রধাণতম ভরসা হয়ে উঠলেন। তবে জিমির একটা সীমাবদ্ধতা ছিলো। মূলত ইংল্যান্ডের মাটিতেই তিনি বেশী উজ্জল ছিলেন। ডিউক বলের খেলা, ইংলিশ কন্ডিশন; এসব সহায়তা পেলে তবেই যেনো স্পিডস্টার হিসেবে তিনি নিজেকে চেনাতে পারতেন।

২০১০ সালের দিকে এসে অ্যান্ডারসন নিজেকে আরও ভয়ানক রূপে নিয়ে এলেন। যে কোনো কন্ডিশনে বলকে দু দিকে সুইং করাতে শুরু করলেন। দু দিনের এই চিরায়ত সুইয়ের সাথে যোগ হলো রিভার্স সুইং। শুধু মুডের আর কন্ডিশনের ওপর নির্ভরশীল নয় এই জিমি। টানা ডট বল, একটা দুটো ভয়ানক বিষাক্ত ডেলিভারি; জেমস অ্যান্ডারসন কার্যত বিশ্বের ভয়ঙ্করতম একজন ফাস্ট বোলার হয়ে উঠলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে ট্রেন্ডব্রিজে ১১ উইকেট বা সেই শীতেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেরা বোলার হওয়াটা ছিলো বিজ্ঞাপন।

২০১৪ সালে ভারত ও শ্রীলঙ্কা সফরে ৩৪ উইকেট নিয়ে বুঝিয়ে দিলেন তিনি আর কেবল ইংলিশ কন্ডিশনের বোলার নন।

প্রথম ইংলিশ বোলার হিসেবে ৪০০ ও ৫০০ উইকেটের মাইলফলকে পৌছালেন। স্টুয়ার্ট ব্রডের সাথে অবিশ্বাস্য এক জুটি গড়ে তুললেন টেস্ট ক্রিকেটে।

সাধারণত খেলোয়াড়রা সীমিত ওভারের ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করার জন্য টেস্ট ছেড়ে দেন। জিমি হাটলেন উল্টো পথে। তিনি আরও বেশী দিন টেস্ট খেলতে পারার জন্য ২০১৫ সালে ওয়ানডে ছেড়ে দিলেন। ১৯৪ ওয়ানডেতে ২৬৯ উইকেটে; খারাপ নয়, কী বলেন?

টি-টোয়েন্টিও ২০০৯ সালের পর আর খেলেননি। নজর কেবলই টেস্ট ক্রিকেটে। আর পুরষ্কারও পেয়েছেন। ম্যাকগ্রার ৫৬৩ টপকে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী ফাস্ট বোলার হয়েছেন। এরপর প্রথম ফাস্ট বোলার হিসেবে ৬০০ উইকেট ছুয়েছেন। এখন তার নাজর ৭০০ উইকেটে।

৬০০ উইকেট শিকারের পর পরিষ্কার বলেছেন, ‘আমি ৭০০ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব কি না? কেন নয়? আমি এখনো রোজ ট্রেনিংয়ের জন্য তৈরি হওয়া, কঠিন পরিশ্রম করা এবং ইংল্যান্ডের হয়ে একটা জয়ের জন্য লড়াই করাটা উপভোগ করছি। আর এসবই আমি আমার সারা জীবনে গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। এটাই আমি করে যেতে চাই। আমি জিমে কঠোর পরিশ্রম করব এবং নিজেকে খেলার জন্য প্রস্তুত রাখব।’

এই গল টেস্ট প্রমাণ করছে যে, অ্যান্ডারসন কথার কথা বলেননি। তিনি এখনও খেলাটা উপভোগ করছেন এবং করাচ্ছেন। এখনও তিনি একাই ম্যাচ ঘোরাতে জানেন।

বয়স ৩৮ পার হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো।

ফাস্ট বোলারদের জন্য এটা কোচ হয়ে আয়েস করার বয়স। এই বয়সে নতুন স্বপ্ন দেখার কথা নয়। তারপরও অ্যান্ডারসন দেখছেন। তবে জিমি তো বাস্তবহীন লোক নন। তিনি জানেন, কোথাও না কোথাও থামতে হবে। আর সেই থামার পরের জীবনটাও ঠিক করে রেখেছেন।

এরই মধ্যে একটা ‘ফ্যাশন ডিজাইনিং’ প্রতিষ্ঠান করেছেন। টিভি উপস্থাপনাও করেছেন। নিজেই বলেছেন, এই দুই পেশাতে দেখা যাবে তাকে। তাহলে ক্রিকেটের সাথে আর থাকবেন না, জিমি?

এই ২০ বছরের বন্ধন কী চাইলেই কেটে ফেলা যায়? জিমি ঠিক ক্রিকেটে থাকবেন। তার জীবনটাই তো ক্রিকেট।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link