সুলতান জারাওয়ানি: এক বিস্মৃত সম্রাট

কেবল নামে তিনি ‘সুলতান’ নন।

সাম্রাজ্য অধিপতির মতই বৈভব ছিল তাঁর, এখনও থাকার কথা। এখানে ওখানে বাড়ি, গ্যারেজ ভরা গাড়ি এবং পেট্রো ডলার; আরব আমিরাতের সুলতানদের যেমন হয়ে থাকে।

চাইলেই পায়ের উপর পা রেখে, ডলার গুনে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। চাইলেই কোথাও একটা ক্রিকেট দল কিনে নিজের শখ মেটাতে পারতেন।

এসব কিছুই করেননি সুলতান মোহাম্মেদ জারওয়ানি।

সাধারণের একজন হয়ে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তিলে তিলে নিজেকে একজন ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তুলেছেন। হেলমেট ছাড়া অ্যালান ডোনাল্ডের বল খেলেছেন, শচীন টেন্ডুলকারের সামনে হাজির হয়েছেন লেগ স্পিন নিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, চোখের সামনে অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করেছেন। এই প্রতিবাদ করতে গিয়ে শেষ করেছেন নিজের ক্যারিয়ার। তারপরও আপোষ করেননি।

হ্যাঁ, তিনি এক আপোষহীন সম্রাট। আরব আমিরাতের বিরল একজন ‘লোকাল’ ক্রিকেটার। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অধিনায়ক। অসীম সাহসের প্রতীক সুলতান মোহাম্মেদ জারওয়ানি।

সুলতানের বেলায় সাহসের শুরুটা করেছিলেন তার বাবা।

পাকিস্তানের সাথে কী একটা সূত্রে সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রে পড়াশোনার জন্য ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানে। আর সেখানেই ক্রিকেট শিখে ফেলেন সুলতান জারাওয়ানি।

আরব আমিরাতে ক্রিকেটটা উপমহাদেশীয়রাই ধরে রেখেছিলেন। তার মধ্যে জারওয়ানির মত কিছু ক্রিকেটার পাকিস্তান, ইংল্যান্ড থেকে খেলাটা শিখে এসেছিলেন। আর ভারত-পাকিস্তানের বংশোদ্ভূতরা তো ছিলেনই। এরা মিলে আরব আমিরাতের নিজস্ব একটা দল তৈরী করে ফেললেন।

তখন সেই অর্থে আরব আমিরাতের নিজস্ব কোনো ক্রিকেট কাঠামো বা বোর্ড নেই। নামকাওয়াস্তে যা বোর্ড ছিল, তা দিয়ে কাজ হচ্ছিল না। পাকিস্তান থেকে ফেরা সুলতান নিজেই আইসিসির স্বীকৃতির জন্য দৌঁড় ঝাঁপ শুরু করলেন। লন্ডনে ছুটলেন সুলতান। সেখানে আইসিসিকে নিজেদের স্টেডিয়াম বা দলের খোঁজ খবর দিয়ে রাজী করিয়ে ফেললেন।

১৯৯৬ বিশ্বকাপ খেলা দলের সদস্য মোহাম্মেদ ইশাক স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘সে সময় আরব আমিরাতের ক্রিকেট মানে জারওয়ানিই সব ছিল। ও লন্ডন গিয়েছিল আইসিসির অফিসে। কয়েক দিন দৌঁড় ঝাঁপ করলো। তারপর একদিন ফোন করে বললো, ‘মোবারক হো, ইশাক। আরব আমিরাত দল স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছে।’ সেই এই দলটা করেছিল।’

 

জনশ্রুতি আছে, ১৯৯৪ আইসিসি ট্রফির জন্য দলের সব খরচ ব্যক্তিগত কোষাগার থেকে বহন করেছিলেন সুলতান। সেই দলটা ১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফি জিতেও নিল। ফলে তারা সুযোগ পেল ১৯৯৬ বিশ্বকাপে।

আর এই বিশ্বকাপই প্রথম সুলতানের বীরত্বের সাক্ষী হলো।

রাওয়ালপিন্ডিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩২২ রান তাড়া করছিল আরব আমিরাত। ৬৮ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল তারা। তখন বল করছিলেন অ্যালান ডোনাল্ড। সেই সময় ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে এলেন সুলতান; মাথায় একটা রিচি রিচার্ডসন স্টাইলের হ্যাট!

কল্পনা করতে পারছেন ব্যাপারটা ?

দুনিয়ার ভয়ঙ্করতম ফাস্ট বোলার, সাদা বিদ্যুৎ ডোনাল্ড বোলিং অপারেট করছেন। আর হেলমেট ছাড়া একটা হ্যাট পরে তাকে মোকাবেলা করতে আসছেন প্রায় অ্যামেচার একজন ৮ নম্বর ব্যাটসম্যান!

পরে সুলতান বলেছেন, হেলমেট পরে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তাই তিনি হ্যাট পরে এসেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকানরা এটা দেখে নিজেদের মধ্যে আলাপ করে নিচ্ছিল। তারা বুঝতে পারছিল না, এ অবস্থায় সুলতানের সাহসকে সম্মান দেখানো উচিত, নাকি অহমিকা গুড়িয়ে দেওয়া উচিত। ডোনাল্ড পরের পথটাই বেছে নিলেন।

প্রথম বলটাই ছিল মাথা লক্ষ্য করে ছোড়া ভয়ানক এক বাউন্সার। লাইন থেকে সরতে পারেননি। খট করে মাথায় আঘাত করল বল। উইকেটে লুটিয়ে পড়লেন সুলতান। তাকে হাসপাতালেও নিতে হয়েছিল। ডোনাল্ড তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তিনি মানুষ মেরে ফেলেছেন বলে ভয় পাচ্ছিলেন।

না, সুলতান মরেননি। পরে বলেছেন, ‘আমার পায়ে ব্যাথা ছিল তো, তাই ডাক করতে পারিনি।’

সুলতানের বীরত্বের গল্প এখানেই শেষ নয়।

ভারতের সাথে একটা ম্যাচ খেলছিল আরব আমিরাত। শচীন টেন্ডুলকার তখন নাস্তানাবুদ করে ফেলেছেন আমিরাতের বোলারদের। কেউ বল করতে যেতেই সাহস পাচ্ছিলেন না। সুলতান তখন নিজের অর্ডিনারি লেগ স্পিন নিয়ে এসে দাঁড়ালেন শচীনের সামনে। বলেছিলেন, আমাকে তখন সামনে আসতেই হত; উদাহরণ তৈরী করতে হত।

সুলতানের ক্যারিয়ার দিয়ে আপনি তাকে ঠিক চিনতে পারবেন না। ৭টি মাত্র ওয়ানডে খেলেছেন। ২৬টি রান করেছেন এবং ৫টি উইকেট পেয়েছেন। এই সামান্য আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের পরিসংখ্যান কী পারে সুলতানের বীরত্ব বোঝাতে!

সুলতান জীবনে উদাহরণ কম তৈরী করেননি। কিন্তু নিজ দেশে শিকার হয়েছেন ভয়াবহ অবিচারের।

১৯৯৬ বিশ্বকাপের পরপর আরব আমিরাত সিদ্ধান্ত নিল, তারা সরাসরি ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের আমিরাতের জাতীয় দলে খেলার সুযোগ দেবে। এর ফলে আমিরাতে এতদিন ধরে যারা খেলাটি ধরে রেখেছিলেন, তারা বঞ্চনার শিকার হলেন। কার্যত আমিরাতে তৃনমূল ক্রিকেট ওখানেই শেষ হয়ে গেল।

আর এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে কঠোর কথাবার্তা বললেন সুলতান। তিনি পরিষ্কার বললেন যে, আমিরাত বোর্ড কর্মকর্তাদের এই লোভী সিদ্ধান্ত একটা ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের উত্থানকে বন্ধ করে দিল। নিজের ক্যারিয়ার দিয়ে এই কথার প্রতিদান পেয়েছেন সুলতান।

সাথে সাথেই তাদের সারা জীবনের জন্য ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। সুলতান বলেছিলেন, তাকে কোনো কারন দর্শানোর নোটিশ দেওয়া বা মৌখিক আলাপও এই নিষিদ্ধ করার আগে করা হয়নি।

তারপর?

তারপর খুব রহস্যময় অধ্যায়। সুলতান জারওয়ানি এখনও আমিরাতেই আছেন। ব্যবসা করেন, ভালো আছেন; এটুকু জানা যায়। কিন্তু তার সাথে ক্রিকেট বা সংবাদ মাধ্যমের আর কোনো যোগাযোগ নেই। দু একজন চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু সুলতান আর আগ্রহ দেখাননি। হঠাৎ করেই যেন স্মৃতির ক্যানভাস থেকে হারিয়ে গিয়েছেন এই বিশাল মনের মানুষটি।

যে আরব আমিরাতের ক্রিকেট নিজে হাতে দাঁড় করিয়েছিলেন, যাদের স্বীকৃতি নিজে এনে দিয়েছিলেন; সেই দেশটির ক্রিকেট থেকেই নিশব্দে হারিয়ে গেলেন। সেই আরব আমিরাতে আজও আইপিএল, পিসিএল আওয়াজ তোলে, ভারত-পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া এখানে ক্রিকেট লড়াই করে। কিন্তু সুলতানের খোঁজ আর কেউ রাখে না।

ঠিক কেমন আছেন, কোথায় আছেন; জানা হল না। তারপরও ভাল থাকার প্রার্থনা। সাহসটা বুকেই থাকুক। সাহস ছড়িয়ে দিন সুলতান মোহাম্মেদ জারওয়ানি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link