ক্রিকেট শুধুই খেলা নয়, একটা আবেগও। সেই আবেগ কখনো ছুঁয়ে যায় ক্রিকেটারদের। অন্যদিকে, ক্রিকেট একটা প্যাশনেরও ব্যাপার। এই প্যাশন দিয়েই ব্যক্তিগত অনেক অপ্রাপ্তি কিংবা শোক ভুলতে ক্রিকেটাররা বেছে নেন মাঠের পারফরম্যান্সকে।
কখনও কখনও খেলোয়াড়দের অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়, তাঁরা প্রচণ্ড ত্যাগ স্বীকার করেন যা অকল্পনীয়। এই ত্যাগের মধ্যে ক্রিকেট খেলাটিকে তাঁদের পরিবারের চেয়েও এগিয়ে রাখেন। কারণ, খেলাটা তাঁদের জন্য জীবনের চেয়েও বড়। তেমনই কয়েকজন ক্রিকেটারকে নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন।
- আকবর আলী (বাংলাদেশ)
বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক আকবর আলী, বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে তার বোনকে হারান। যমজ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রাণ হারান আকবর আলীর বোন খাদিজা খাতুন। আকবর আলী থেকে ‘আকবর দ্য গ্রেট’ হওয়ার পেছনে তার বোনের অবদান কোনো অংশে কম নয়।
খবরটা প্রথমে তাঁর কাছ থেকে চেপেই রাখা হয়েছিল। কিন্তু যেভাবেই হোক আকবর তা জেনে যান। ২৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হওয়ার পরপরই আকবর ফোন দিয়েছিলেন তাঁর মেজ ভাইকে। বলেছিলেন, ‘আপার মৃত্যুসংবাদটা কেন আমার কাছে চেপে গেলেন আপনারা?’ ওই মুহূর্তের কথা জানানোর সময় হুহু করে কেঁদেছিলেন আকবরের বাবা মোহাম্মদ মোস্তফা।
বোনের মৃত্যু শোককে শক্তিতে পরিনত করেছিলেন আকবর। মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে বরং শক্ত থেকে বাংলাদেশ দলকে যুব বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন করার গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন। ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে তার দায়িত্বশীল ব্যাটিংই বাংলাদেশ দলকে চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করেছিল। সেদিন অপরাজিত থেকে দলকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করেই মাঠ ছাড়েন আকবর।
- রবিচন্দ্রন অশ্বিন (ভারতীয় ক্রিকেট)
ক্রিকেট মাঠের সবচেয়ে অনুরাগী এবং শান্ত এই স্পিনার। খেলার প্রতি তিনি কতটা আবেগী সেটা একবার প্রকাশ পেয়েছিল ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার টেস্টের সময়। ২০১৫ সালের সেই ম্যাচটি স্মরণীয় হয়ে আছে আজিঙ্কা রাহানের জোড়া সেঞ্চুরির জন্য।
রাহানের সেঞ্চুরির সাথে অশ্বিন করেছিলেন একটি চমৎকার অর্ধ-শতক। তার নিজ শহর চেন্নাইয়ে ভয়াবহ বন্যার খবর জানা থাকা সত্ত্বেও তিনি এই খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। খবরে বলা হয়েছিল যে তার বাবা-মা বন্যার মাঝে আটকে ছিলেন এবং আশ্বিন ২৪ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে তাঁদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। তবে নিজের দেশের হয়ে খেলতে তিনি নিজেকে শান্ত রেখেছিলেন।
- ব্রেন্ডন টেইলর (জিম্বাবুয়ে)
আইপিএলে বিক্রি হওয়া জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটারদের মধ্যে ব্রেন্ডন টেইলর একজন। ২০১৪ সালে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকায় তাকে দলে নিয়েছিল সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ। তিনি আইপিএলে খেলার জন্য হানিমুনে যাননি, হানিমুন না করে তিনি আইপিএল খেলতে আসেন। যদিও সে বছর কোনো ম্যাচ না খেলেই তাকে দেশে ফিরতে হয়েছিল তাকে। তারপরেও তার এই ত্যাগের কথা আজও মনে আছে।
- আসিফ আলী (পাকিস্তান)
২০১৯ সালে নিজের দুই বছরের মেয়েকে হারিয়েছিলেন আসিফ আলী। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে নিজের ছোট্ট মেয়েকে আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেন। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত আসিফ আলীর ব্যাট হাতে সময়টাও তখন খুব ভালো যাচ্ছিল না। তবে, মেয়ের মৃত্যুশোক ভুলে শেষকৃত্য শেষ করার একদিন বাদেই যোগ দেন দলের সাথে। খেলতে যান ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ আসর।
- ব্রেট লি (অস্ট্রেলিয়া)
তিনি খেলার প্রতি প্রচণ্ড প্যাশনেট হিসেবে সুপরিচিত। ২০০৬ সালে অ্যাশেজের সময় সেই প্যাশনের চূড়ান্ত চিত্রটা দেখা যায়। অ্যাশেজে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি সে সময় সন্তান সম্ভাব্য স্ত্রীর পাশে না থেকে অস্ট্রেলিয়ার জন্য প্রথম টেস্টে অংশগ্রহণ করেন। সেই সিরিজটি অজিরা জিতেছিল ৫-০তে।
- মোহাম্মদ সিরাজ (ভারত)
যখন আইপিএল খেলছিলেন, তখন থেকেই বাবা খুব অসুস্থ ছিলেন। আইপিএল খেলেই সিরাজকে উড়াল দিতে হল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। সেখান থেকেই শুনলেন বাবার মৃত্যুর খবর। চাইলে ফিরতে পারতেন দেশে। টিম ম্যানেজমেন্টও অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু বায়ো বাবল না ভেঙে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে থেকে যান দলের সাথে। বাকিটা ইতিহাস। ভারত অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ঐতিহাসিক এক বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির শিরোপা জয় করে। আর সিরাজ ছিলেন সেই সফরে ভারতের সেরা বোলার।
- বাবর আজম (পাকিস্তান)
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছে পাকিস্তান ক্রিকেট দল। ব্যাট হাতে দলের অন্যতম সেরা পারফর্মার অধিনায়ক বাবর আজম। তিনি চাইলে অসুস্থ মায়ের কাছে থাকতে পারতেন। মা হাসপাতালে লড়ছেন জীবন-মৃত্যুর সাথে। তবে, বাবর আজম নিজের দায়িত্বকেই আগে স্থান দিয়েছেন।
- জেসন রয় (ইংল্যান্ড)
২০১৯ বিশ্বকাপের আগের কথা। বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য পাকিস্তান ওয়ানডে সিরিজের জন্য ইংল্যান্ড সফরে যায়। জেসন রয় পুরো সিরিজ জুড়ে দর্শনীয় ফর্মে ছিলেন। তবে চতুর্থ ওয়ানডের ঠিক আগে তাঁর মেয়ের অসুস্থতার জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার কথা জানানো হয়েছিল। রয় তাঁর সন্তানের কাছে থেকে যান। তবে, চতুর্থ ওয়ানডেতে খেলতে ফিরে এসে ইংলিশ দলকে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতিয়েছিলেন তিনি। চতুর্থ খেলা শেষে তিনি তার পরিবারে কাছে ফিরে যান।
- রশিদ খান (আফগানিস্তান)
সময়ের সেরা লেগ স্পিনার রশিদ খান। একবার বিগ ব্যাশের খেলা চলছিল। তখনই তিনি তাঁর বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন। যাই হোক, রশিদ খান দেশে না ফিরে খেলার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় থেকে যান।
- মোহাম্মদ শামি (ভারত)
ভারতের এই বোলিং জাদুকর ২০১৬ সালে ব্যক্তিগত ট্রাজেডিতে ভুগেছিলেন। সে সময় তার মেয়েকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছিল। তবে, এই পেসার যিনি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের দলে ছিলেন, তখন তার জাতীয় দায়িত্ব তার পারিবারিক সমস্যার থেকেও ওপরে রেখেছিলেন। তার কাজের জায়গা থেকে এই তারকা কলকাতায় গিয়েছিলেন। খেলায় তাঁর প্যাশন দেখে তার সতীর্থরা হতবাক হয়েছিলেন। কোহলি প্রকাশ্যে শামিকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।
- মহেন্দ্র সিং ধোনি (ভারত)
ধোনি তর্কসাপেক্ষেও ভারতের হয়ে সবচেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ খেলোয়াড়। তাঁর পারফর্ম করার আকাঙ্ক্ষা তাঁকে মাঠে বড় করে তুলেছিল। ২০১৫ সালের একটি ঘটনা, ভারতীয় দল বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ছিল। এর পরে ৬ ফেব্রুয়ারি ধোনির প্রথম কন্যা জিভা জন্ম গ্রহণ করেছিল।
যদিও, ধোনি চাইলেই তখন দেশে ফিরতে পারতেন, কন্যাকে এক ঝলক দেখে আসতে পারতেন। ধোনি সেই সুযোগটা নেননি এবং তার পরিবর্তে বিশ্বকাপের প্রস্তুতির দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। ধোনি মার্চ মাসে জিভাকে প্রথম দেখেন।
- শচীন টেন্ডুলকার (ভারত)
১৯৯৯ সালে ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা পারফর্মার ছিলেন ডান-হাতি এই ব্যাটসম্যান। তবে, বিশ্বকাপে খেলতে গিয়ে তিনি পিতার মৃত্যুর হৃদয় বিদারক সংবাদ পেয়েছিলেন। বাবার শেষকৃত্যে অংশ নিতে শচীন মুম্বাই চলে গেলেন। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি কেনিয়ার বিপক্ষে খেলার জন্য দলে ফিরে এসেছিলেন। ফিরেই করেছিলেন সেঞ্চুরি। ব্যাট আকাশের দিকে তাক করে স্মরণ করেছিলেন বাবাকে।
- বিরাট কোহলি (ভারত)
ক্রিকেট মাঠে বিরাট কোহলি হলেন প্যাশনের অপর নাম। তখনকার যে ঘটনার কথা বলবো, তখনও তিনি আজকের মত মহীরূহ হননি। তখন তিনি ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর। রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ। কর্ণাটকের বিরুদ্ধে তিনি দিল্লীর প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, দল তখন ফলোয়ানে পড়ার পথে। তবে, চতুর্থ দিন শুরুর মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে দলটি বিরাট কোহলির বাবার মৃত্যুর দুঃখজনক সংবাদ পেয়েছে।
কোহলি মাঠে নেমে গেলেন। নব্বই রানের এক ইনিংস খেলে তিনি তাক লাগিয়ে দিলেন। এরপরই তিনি রওনা দিলেন দিল্লীর পথে। তখনই বোঝা হয়ে গিয়েছিল, ভারতীয় ক্রিকেটে ‘নেক্সট বিগ থিঙ’ চলে এসেছেন।
- শহিদুল ইসলাম (বাংলাদেশ)
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যতম দুর্দান্ত পেসার শহিদুল ইসলাম। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ চলাকালে হারান বাবাকে। টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলাটা অনিশ্চিত ছিল তার। মাত্র কিছু দিন আগে বাবাকে হারানো শহিদুলকে ফাইনালে খেলাতে চায়নি তাঁর দল জেমকন খুলনার টিম ম্যানেজমেন্ট, তাঁকে সময় নিতে বলেছিল টিম ম্যানেজমেন্ট।
কিন্তু, শহিদুল ম্যাচ খেলার ব্যাপারে অটুট ছিলেন এবং ফাইনাল ম্যাচে খেলেছিলেন। ফাইনালে গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামের শেষ ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৬ রান। খুলনার অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ শেষ ওভারে ভরসা রাখেন ২৫ বছর বয়সী শহিদুলের উপর। শহিদুল শেষ ওভারের তৃতীয় বলেই আউট করেন মোসাদ্দেক হোসেনকে, পরের বলে দারুণ ইয়োরকার বোল্ড করেন ম্যাচে হাফ-সেঞ্চুরিয়ান সৈকত আলীকে। শেষ ওভারে মাত্র ১০ রান নিতে পেরেছিল গাজী গ্রুপ চট্রগ্রাম। জেমকন খুলনার হয়ে ফাইনালে দুর্দান্ত বোলিং করেন শহিদুল, অনবদ্য বোলিংয়ে ছিলেন ফাইনালের নায়ক।
- পার্থিব প্যাটেল (ভারত)
মায়াবী হাসির জন্য খুব বিখ্যাত ছিলেন, বাচ্চাসুলভ চেহারার জন্যও ছিলেন সুপরিচিতি। ২০১২ সালের আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে দুর্দান্ত খেলেছিলেন। তবে তাঁকে পুরো মৌসুম ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। তাঁর বাবা অজয় প্যাটেল পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। পার্থিব অবশ্য গোটা আসর জুড়েই ছিলেন দলের সাথে। টুর্নামেন্ট শেষে গিয়েছিলেন বাবার কাছে।