যে গাছ কেন্দ্র করে বসে ক্রিকেটের হাট

হাট; বাংলাদেশে গ্রাম কিংবা মফস্বল এলাকার সাপ্তাহিক বিশেষ বাজারের এটাই নাম। হাটে যায়নি বাংলাদেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। এখন হাটে কি হয় চিন্তা করি! হাট বলতেই আমাদের চোখের সামনে আসবে একটা বড় গাছকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পণ্যের সওদা। বেশীর ভাগ সময়ই কোন বট গাছকে কেন্দ্র করে বসে হাটগুলো। সপ্তাহের বিশেষ কোন দিনে খোলা মাঠে হাট বসে যেখানে তা অন্যান্য দিন ফাঁকা থাকে। তখন আশেপাশের ছেলেপুলেরা সেখানে খেলাধুলা করে; আড্ডা দেয় আবার কখনও মেতে ওঠে নানান আয়োজনে!

এখন একটা আন্তর্জাতিক কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেট মাঠের কথা চিন্তা করি! একদম হাটের বিপরীত। সেখানে কোন ধরনের গাছপালা থাকবে না। হতে হবে একদম উন্মুক্ত চত্বর। শুধু ক্রিকেট কেন ফুটবল, হকি, বেসবল তথা সকল ধরনের দলীয় খেলা সেগুলোর ঘরোয়া ম্যাচ কিংবা আন্তর্জাতিক ম্যাচের মাঠ হতে হবে সমতল। খোলামেলা, কোন ধরনের কিছু থাকবে না।

তবে এইরকম বৈশিষ্ট্য ছাড়া মাঠও আছে! সেটি ইংল্যান্ডের কেন্টাবুরির সেন্ট লরেন্স ক্রিকেট গ্রাউন্ড। এটা পৃথিবীর দুইটা ফাস্ট ক্লাস গ্রাউন্ডের একটা, যার ভেতরে রয়েছে একটি বড়সড় গাছ। আর স্টেডিয়ামটি শুধু একটি সাধারণ স্টেডিয়াম নয়। এটি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম পুরোনো স্টেডিয়াম। ইংলিশ কাউন্টি দল কেন্টের হোম গ্রাউন্ড। তাছাড়া এখানে আয়োজন হয়েছে আন্তজার্তিক ম্যাচও।

১৮৪৭ সালে যখন প্রাচীন ডোবার রোডের দক্ষিণে আর সেন্ট লরেন্স হাসপাতালের পাশে কেন্ট কাউন্টি দলের জন্য স্টেডিয়ামটি বানানো হয় তখন মাঠের ভেতরের লাইম গাছটি কোনভাবেই খেলার মাঠ থেকে বাদ দেওয়া যাচ্ছিল না। তখন বাধ্য হয়ে মাঠের মধ্যেই গাছটি রেখে দেওয়া হয়। গাছটি কে, কবে লাগিয়েছে তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। কিন্তু ধারনা করা হয় গাছটি স্টেডিয়াম তৈরীর সময়ের থেকেও ৪০ বছর আগের। সেই হিসেবে করলে দেখা যায় গাছটি ১৮০০ সালের দিকে রোপন করা হয়েছে। গাছটার আদুরে নাম সেন্ট লরেন্স লাইম।

নানা ইতিহাসের সাক্ষী এই গাছটির উচ্চতা ছিল প্রায় ২৭ মিটার বা ৯০ ফুট। এই গাছে বল লাগলে তাঁর জন্য বিশেষ নিয়ম ছিল। বল যদি গিয়ে গাছের গায়ে লাগে সরাসরি তাহলে সেটা চার হবে, এমনকি যদি নিশ্চিত বোঝা যায় বলটা গাছের গায়ে না লাগলে ছক্কা হতো তবুও সেটিও চার রানই হবে। আবার বল যদি গাছে লাগে এবং তারপরে কোন ফিল্ডার যদি তা সরাসরি ধরে অর্থাৎ ক্যাচ ধরে তাহলে সেটা আউট হবে না। ক্রিকেটের ইতিহাসে গাছটির উপর দিয়ে ছয় মারেন মাত্র চারজন!

১৯৯০ সালের দিকে গাছটিতে ফাঙ্গাস জনিত ‘ডেড হার্ট’ রোগ ধরা পড়ে। তারপর এর ডালপালা ছোট করে গাছটিকে আরও বছর দশেক বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছিল। তারপর ১৯৯৯ সালে গাছটি মারা যায়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত গাছটি অক্ষত অবস্থায় থাকলেও সেই বছর এক ঝড়ো বাতাসের কারণে গাছটি ভেঙে যায়। তারপর গাছের বিভিন্ন অংশ বিক্রি করে মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)।

তারা আরও সিদ্ধান্ত নেয় যে, গাছটির জায়গায় আরও একটি নতুন গাছ লাগানো হবে। কিন্তু চারা গাছ লাগালে তো ফিল্ডারদের দৌড়ের সময় পা চাপা পড়ে চারাটি ভেঙ্গে যেতে পারে। তাই মাঠের বাইরে চারা লাগিয়ে তা ৬ মিটারের মত বড় করে পরে একই জায়গায় পুনর্স্থাপন করা হয়। এই গাছটির জন্য কোন ফিল্ডার ইনজুরিতে পড়েছেন এরকম কোন ঘটনা ঘটে নি।

কেন্ট দলের হোম গ্রাউন্ড হবার পাশাপাশি ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে সেন্ট লরেন্স স্টেডিয়ামে প্রথম বারের মত কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৫ সালের ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার একটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচও এই মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এই ম্যাচটিই ছিল এই মাঠে ছেলেদের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এ মাঠে ১৯৭৯ সাল থেকে নারীদের টেস্ট হয়। আর নিয়মিত নারী দলের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।

এবার নামকরণের স্বার্থকতায় আসি।

ওই যে শুরুতে বললাম না ক্রিকেটের হাট। এই মাঠেই হয় ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম পুরোনো ক্রিকেট আসর কেন্টাবুরি ক্রিকেট ফেস্টিভ্যাল। যা প্রতি বছরের আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয়।

এই মাঠটিকে বিখ্যাত করেছে এর লাইম গাছটি। উপমহাদেশে হলে এই গাছটি কেটে ফেলা হত। কিন্তু তারা এই গাছটিকে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে প্রায় ১৫০ বছর টিকিয়ে রেখেছিল। তার পরও স্মৃতি রক্ষার্থে সেখানে আবার নতুন গাছ লাগানো হয়। গাছটি অক্ষত রেখেই এখানে খেলা হত। এইসব কারণেই মনে হয় ক্রিকেটকে বলা হয় ভদ্রলোকের খেলা।

বেঁচে থাকুক ক্রিকেট। বাঁচুক পরিবেশ। বেঁচে থাকুক মাঠের ভেতরের এমন গাছগুলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link