লং অনের উপর ছক্কা হাঁকিয়েই মহেন্দ্র সিং ধোনি ব্যাট ঘুরিয়ে উদযাপন শুরু করলেন! কমেন্ট্রি বক্সে রবি শাস্ত্রীর উল্লাস ভরা কণ্ঠে, ‘ধোনি ফিনিশেস অফ ইন স্টাইল। আ ম্যাগনিফিসেন্ট স্ট্রাইক ইন দ্য ক্রাউড, ইন্ডিয়া লিফট দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ আফটার টোয়েন্টি এইট ইয়ার্স…’
ড্রেসিং রুমে শচীন-বিরাটদের বাধ ভাঙা উল্লাস। কানায় কানায় পূর্ণ ওয়াংখেড়েতে দর্শকদের খুশির জোয়ারে সেদিন বিশ্বকাপ ঘরে তুলেছিল ভারত। গম্ভীরের মাটি মাখা জার্সির কথা মনে আছে তো? ধোনির অধিনায়কত্ব আর ম্যাচ জয়ী ইনিংস? বিধাতা যেন সেদিন ষোল আনাই দিয়েছিলেন ভারতকে! একদিকে ধোনির উদযাপন আরেকদিকে লঙ্কান অধিনায়ক সাঙ্গাকারার বুকে কষ্ট চেপে রাখা হাসি, ক্রিকেটের অবিস্মরণীয় মূহুর্তগুলোর একটি।
১৯৮৩ সালে যখন প্রথমবার ভারত বিশ্বকাপ জয় পায় তখন এ দলের অনেকের জন্মই হয়নি, আবার অনেকেই ছিলেন ছোট শিশু! যারা তাদের বাবা-মা কিংবা অন্য কারো থেকে শুনেছিল ৮৩ এর বিশ্বকাপ জয়ের সেই কাব্য কাহিনী। সেবারসহ টানা ছয়বার বিশ্বকাপ খেলতে নামার রেকর্ড করেছিলেন শচীন! কিন্তু তারপরও সেই খুশিটা নেই! দীর্ঘদিন ধরে যে মনে লালন করে আসছেন বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন সেটা কি পূর্ণ হবে? পাকিস্তানকে সেমিফাইনালে হারিয়ে ফাইনালে ভারত, ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা। ঘরের মাঠে মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়েতে হবে ফাইনাল।
এবার কি শচীনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে তাহলে? কারণ এটাই ছিল তার শেষ বিশ্বকাপ! যে মানুষটা ক্রিকেটে সর্বক্ষেত্রে নিজের নাম ছাপিয়ে দিয়েছে সেই মানুষটার একটা স্বপ্ন অধরা থাকবে তা হয়তো বিধাতাও চাননি। পাঁচ বিশ্বকাপ খেলার পর অবশেষে নিজের ষষ্ঠ ও শেষ বিশ্বকাপে পূরণ হলো ট্রফি জয়ের স্বপ্ন!
ফাইনালে ২৭৫ রানের লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে মাত্র ২৮ রানে দুই ওপেনার শচীন-শেবাগ বিদায় নিলে স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো ওয়াংখেড়ে। কিন্তু গম্ভীরের ঐতিহাসিক ইনিংস আর ধোনির ফিনিশিংয়ে সব বাঁধা টপকে শেষ পর্যন্ত ছয় উইকেটের জয় পায় ভারত। কুমার সাঙ্গাকারা-মাহেলা জয়বর্ধনদের সেদিন স্বপ্ন ভঙ্গ হলেও শচীন-শেবাগরা নিজেদের নামে পাশে বিশ্বকাপ জয়ের ছাপটা এটে দিতে পেরেছিলেন।
এই জয়ের পিছনে যে মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল নিশ্চয়ই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে গম্ভীরের ধৈর্যশীল ইনিংস, ধোনির ম্যাজিক্যাল ফিনিশিং।সেই দিনের কথা মনে করে গম্ভীর পরবর্তীতে বলেছিলেন, ‘২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালে ময়লা জার্সিটা আজো আমি ধুতে দেইনি। আমি ওটা ফ্রেম করব, ক্যাবিনেটে রেখে দিব।’
চাপের মুখে নার্ভ ঠিক রেখে গম্ভীরের সেই ৯৭ রানের ঐতিহাসিক ইনিংস ইতিহাসের পাতায় অবিস্মরণীয় হয়েই থাকবে। মাত্র তিন রানের জন্য সেদিন সেঞ্চুরি না পেলেও বিশ্বকাপ জয়ে সেই আক্ষেপটা সেদিন আর ছিল না গম্ভীরের৷
পুরো টুর্নামেন্টেই মিস্টার কুল খ্যাত ধোনির অধিনায়কত্ব ছিল প্রশংসনীয়। ফাইনালে তার করা ৭৯ বলে ৯১ রানের সেই দুর্দান্ত ম্যাচজয়ী ইনিংস এখনো ভক্ত-সমর্থকদের মনে গেঁথে আছে। ম্যাচ সেরার পুরস্কারটাও জেতেন তিনি! তার সম্পর্কে শচীন টেন্ডুলকার বলেছিলেন, ‘আমার দেখা সেরা অধিনায়ক ধোনি! সে যেভাবে চাপের মুখেও ফাইনালে দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছে সেটা ওকে দিয়েই সম্ভব।’
বিশ্বকাপের পুরো টুর্নামেন্টেই সেবার ধোনি তাঁর বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে মুগ্ধ করেছিলেন ক্রিকেটবিশ্বকে। চাপের মুখেও মাথা ঠান্ডা রেখে ম্যাচ বের করে আনতে সক্ষম ছিলেন তিনি। ১১ বিশ্বকাপ জয়ে ধোনির অবদান অপূরণীয়।
আচ্ছা গম্ভীর-ধোনি ছাড়াও কিন্ত আরেকজন আছে যার অনবদ্য পারফরম্যান্সেই ভারত সেবার ফাইনালে পৌঁছায়! মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও ব্যাট-বল হাতে পুরো টুর্নামেন্টের সেরা পারফর্মকে মনে আছে তো?
হ্যাঁ – যুবরাজ সিং! টুর্নামেন্টে ৯ ম্যাচে ৩৬২ রান আর ১৫ উইকেট নিয়ে আসরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন। যিনি মরণব্যাধি ক্যান্সারে ভুগছিলেন, যে মানুষটা মৃত্যুকে কাঁধে নিয়ে ২২ গজে পুরো টুর্নামেন্টে দাপট দেখিয়েছেন সে মানুষটাই তো সত্যিকারের হিরো! ভারতের দ্বিতীয়বারের মতোন বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদানের কথা যদি বলেন সেটা এক বাক্যে সবাই স্বীকার করতে বাধ্য যে তিনি যুবরাজ সিং।
গম্ভীর, ধোনি কিংবা যুবরাজ সিংরাই নয় বীরেন্দ্র শেবাগ, শচীন টেন্ডুলকার, জহির খানরাও সেবার উজাড় করে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপ ঘরে তুলতে। বিশ্বকাপের আগে থেকে টুর্নামেন্টে শিরোপা জয়ের হট ফেবারিট দল ছিল ভারত। ধোনির অতুলনীয় বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্ব, যুবরাজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স, শেবাগ-শচীনের ওপেনিংয়ে ঝলক আর জহির খানের সেরা বোলিংয়ে ট্রফিটার সেরা দাবীদার ছিল ভারতই। দশ বছর পরেও স্মৃতিগুলো ভক্ত-সমর্থকদের মনে এখনো তাজা! ওয়াংখেড়ের সেই ঐতিহাসিক স্মৃতি ভুলবার নয়।