হৃদয়জয়ী জোকারকথন

অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের শুরুটা মনমতো হয়নি নোভাক জোকোভিচের। চতুর্থ রাউন্ডে এসেই পরেছিলেন চোটের কবলে। তাও যে সে চোট নয়, একেবারতে পেশিতেই চিড় ধরা পড়েছে। প্রথমে মিলোস রাওনিকের বিপক্ষে এমন চোট দেখে জোকোভিচের হ্যাট্রিক শিরোপার স্বপ্নকে বাই-বাই বলে দিয়েছিলেন সকলে। কিন্তু নামটা যে নোভাক জোকোভিচ। সেখান থেকেও উঠে আসার গল্প লিখে জিতে নিয়েছেন ক্যারিয়ারের আঠারোতম গ্র্যান্ডস্ল্যাম।

গ্লোবাল প্যান্ডেমিকের পর জোকোভিচের অবস্থা ছিল শোচনীয়। ইউএস ওপেন ছিল ফাঁকা কোর্ট, শুধু ঠাণ্ডা মাথায় খেললেই চলতো। না ছিল নাদাল, না ছিল ফেদেরার। কিন্তু সেখানে বল দিয়ে লাইনসম্যানকে অনিচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করে হন ডিসকোয়ালিফায়েড। ক্যারিয়ারে এমন লজ্জা এর আগে কোনোদিনও পাননি। এমনকি ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনালে পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন, কিন্তু লাল কোর্টের রাজা রাফায়েল নাদালের মুখোমুখি হয়ে হজম করেছেন বেগেল। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে ফেরার আগে ট্যুর ফাইনালের রেজাল্টও সুখকর নয়। বিদায় নিয়েছেন গ্রুপ পর্ব থেকেই। সিনশেষে ছিল শুধু ইয়ার-অ্যান্ড নম্বর ওয়ান পজিশনটাই।

কিন্তু গ্র্যান্ডস্ল্যামের নাম হলো অস্ট্রেলিয়ান ওপেন। যাকে আদর করে লোকেরা ডাকে ‘দ্য হ্যাপি স্ল্যাম’। সেখানে পুরুষ একক মানেই যেন নোভাক জোকোভিচের হাতে শিরোপা। এবারও তার কোন নড়চড় হয়নি। ফাইনালে রাশিয়ার দানিল মেদভেদেভকে গুঁড়িয়ে দিয়েই নবমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ট্রফি হাতে তুললেন পুরুষ টেনিসের এক নম্বর খেলোয়াড় জোকোভিচ। আর পৌছে গেলেন নাদাল-ফেদেরারের আরেকটু কাছে।

এবারে শুরু থেকেই ফর্মে ছিলেন না জোকোভিচ। প্রথম রাউন্ড বাদে প্রতিটি রাউন্ডেই অন্তত একটি সেটে হারের মুখ দেখেছেন। চতুর্থ রাউন্ডে তো ভাবাই হচ্ছিল মাঠে থেকে বের হয়ে যাবেন জোকোভিচ। চোটের কারণে বেশ অনেকটা সময় মেডিক্যাল টাইম-আটও নিয়েছিলেন সার্বিয়ান তারকা। কিন্তু সেখান থেকেও ফিরে এসেছেন বীরদর্পে। শেষমেশ নিজের ফর্মে ফিরেছেন সেমি ফাইনালে এসে। সরাসরি সেটে রাশিয়ার আসলান কারাতসেভকে উড়িয়ে পৌছান নিজের নবম অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ফাইনালে।

ফাইনালের ফলাফল সকলে আন্দাজই করেছিল। রড লেভার অ্যারেনায় ফাইনাল হারেননা জোকোভিচ। এর আগে আটবার ফাইনাল খেলে আটবারই শিরোপা নিয়ে মাঠে ছেড়েছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে ২০১২ সালে রাফায়েল নাদালের বিপক্ষে ৫ ঘন্টা ৫৩ মিনিটের এক মহাকাব্য। মেলবোর্নের এই নীল কোর্টটাকে খুব ভালোমতো চিনেন জোকোভিচ, তাই ফাইনাল জেতা ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু দানিল মেদভেদেভও কম যান না। গত ইউএস ওপেনের ফাইনাল খেলেছেন, জিতেছেন এটিপি ফাইনালস। তিনিও হেলাফেলা করার মতন কেউ নন। কিন্তু নোভাক কোর্টে যা দেখালেন, তাতে তাকে হেলাফেলার বস্তু ছাড়া অন্যকিছু মনে হয়নি।

শুরুর সেটে বেশ ভালোই লড়াই করেছিলেন, শেষ মুহূর্তে মোমেন্টাম না হারালে প্রথম সেটটা যেতে পারতো রাশিয়ান তারকার কাছেই। কিন্তু জোকোভিচ তাই স্বভাবসুলভ স্টাইলে প্রথম সেট জিতে নেন ৭-৫ গেমে। এরপর রড লেভার অ্যারেনায় শুরু ‘জোকার’ ঝড়। জোকোভিচের দূর্দান্ত রিটার্নের কাছে হতভম্ব হয়ে ছিলেন মেদভেদেভ। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় স্ল্যাম ফাইনাল খেলতে নামা মেদভেদেভ কোনো কূল কিনারাই পাচ্ছিলেন না।

জোকোভিচের সামনে অসহায় হয়ে শেষ সেটে তো মেজাজও হারালেন মেদভেদেভ। শেষ সেটে কী করেননি ২৫ বছর বয়সী রুশ? র‍্যাকেট ছুড়ে মেরেছেন, ক্যাম্পের নিজের সতীর্থদের উদ্দেশে চিৎকার চেঁচামেচি করেছেন। কিন্তু ক্যারিয়ারে আজীবন মেজাজ হারানো জোকোভিচ শেষটা করলেন একেবারে শান্তভাবে। দানিলের মাথার উপর দিয়ে মারা ব্যাকহ্যান্ড ভলিই ছিল তার আঠারোতম শিরোপার টিকিট। ৭-৫, ৬-২, ৬-২ গেমে জিতে ক্যারিয়ারের ১৮ তম গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিততে সময় নেন মাত্র ১ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট।

রড লেভার অ্যারেনা তাকে দিয়েছে দু’হাত ভরে, তার স্ম্ররতিচারণে স্মৃতি কাতর হওয়াটাই যে স্বাভাবিক। শিরোপা হাতে নিয়ে তাই পয়া কোর্টকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলেননি জোকোভিচ, ‘উত্থান-পতনে ভরপুর একটা সপ্তাহ গেল আমার। রড লেভার অ্যারেনা, প্রতিবছরই তোমার জন্য আমার ভালোবাসা বাড়ছে। ভালো লাগার সম্পর্কটা চলছেই। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’

রানার্স-আপ শিরোপা পেয়ে মেদভেদেভও কম যাননি, রোমান্থন করেছেন নোভাকের সাথে ঘটা মধুর স্মৃতির। যেবার প্রথমবারের মতন দেখা হয়েছিল নোভাক আর দানিলের, ‘যখন আমার সঙ্গে নোভাকের প্রথম দেখা হয় আমার র‍্যাংকিং তখন ৫০০ বা ৬০০ হবে। সে তখন ওয়ার্ল্ড নাম্বার ওয়ান। কিন্তু তখনও তিনি আমার সঙ্গে ঠিক একই ভাবে কথা বলেছিলেন যেমনটা এখন বলেন। বন্ধুর মতো। তিনি বদলাননি। সবসময়ই সেরা একজন খেলোয়াড় ও দারুণ এক বন্ধু।’

অন আর অফ-কোর্টের জোকোভিচ এখন সব ছাড়িয়ে ১৮ গ্র্যান্ডস্ল্যামের মালিক। সর্বোচ্চ অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের শিরোপাও এখন তার হাতে। নাদাল-ফেদেরার রাজত্ব্যে হানা দেওয়ার ইচ্ছে তার অনেকদিন ধরেই। সে লক্ষ্যে গুটি গুটি পায়ে এগুচ্ছেন জোকোভিচ। কে জানে, নতুন দশকে এসে জোকোভিচ না ছাড়িয়ে যান আগের দুই মহারথীকে।

তা পারুন কিংবা না পারুন, সার্বিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত বেলগ্রেদ থেকে উঠে আসা জোকোভিচ ‘জোকার’রূপে জিতে নিয়েছেন সকলের মন, তা একেবারেই নিশ্চিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link