সেলিম মালিকের কথা আজকাল আর কেউ বলে না। সেই বলার মুখটা অবশ্য তিনি নিজেই রাখেননি। তবে একটা কথা ঠিক, যে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের বেশ আগ্রাসী একজন ব্যাটসম্যান। সময়ের থেকে বেশ এগিয়ে থাকা একজন ক্রিকেটার।
আশি নব্বইয়ের দশকে পাকিস্থানের সেরা ব্যাটসম্যান বলা হত সেলিম মালিককে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, লোকজন তাকে একজন প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান নয় বরং তাঁকে একজন ফিক্সার হিসেবে চিহ্নিত করে। পাকিস্তান তাই স্মৃতিচারণার চেয়ে বেশি তাঁর নিন্দা করে।
পাকিস্থানের ইতিহাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ জন ক্রিকেটার গড়তে পেরেছেন শততম টেস্ট খেলার রেকর্ড। আর এই পাঁচ জনের রয়্যাল ক্লাবের সদস্য সেলিম মালিক। পাকিস্থানের অনেক ম্যাচ জয়ে ভূমিকা ছিল সেলিম মালিকের। কিন্তু এর থেকে বড় পরিচয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে তাঁর ফিক্সিং করা এবং ফিক্সিং এর প্রস্তাব দেয়াকে কেন্দ্র করে।
সেলিম মালিক ছিলেন পাকিস্থানের ডানহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। মাঠের চারপাশে দুর্দান্ত শট খেলতে বেশ দক্ষ ছিলেন। এর পাশাপাশি বল হাতে দুর্দান্ত লেগ স্পিন করতেন। সেলিম মালিক মূলত পাকিস্তান দলে এসেছেন কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান জহির আব্বাস এবং জাভেদ মিয়াদাদের অবস্থানে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছেন তাদেরকে।
পাকিস্তানি কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান জহির আব্বাস সোজা বলকে দুর্দান্ত ভাবে স্ট্রোক শট করে কভার পয়েন্টের উপর দিয়ে বল মাঠের বাইরে পাঠাতে পারতেন। মিয়াদাদ মিড উইকেটের উপর দিয়ে বেশ ভালো কিছু শট করতে পারতেন। সেলিম মালিক এগুলো সবই বেশ ভালো করতে পারতেন। এমনকি তিনি পয়েন্টের উপর দিয়ে ছক্কা হাঁকাতে পারতেন। ‘ভি’ স্টাইলে ব্যাট করতেন তিনি। এর ফলে তিনি বিশুদ্ধ ক্রিকেট সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছিলেন।
অভিষেকে সবচেয়ে কম বয়সী পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান হিসেবে শতক হাঁকান সেলিম মালিক। একবার কোর্টনি ওয়ালশের বলে হাতের ইনজুরিতে পড়েছিলেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যাটিং করতে আসেন। শুরুতে বাম হাতে ব্যাটিং শুরু করেছিলেন। কিন্তু একটি শট করার জন্য সুইচ হিট খেলেন সেলিম মালিক। এরপর ওই অবস্থাতেই আবারও ডান হাতে খেলা শুরু করেন তিনি। এরপর দশম উইকেট জুটিতে ওয়াসিম আকরামের সাথে যোগ করেন ৩২ রান। সেলিম মালিকের মধ্যে ছিল টেকনিক, প্রতিভা এবং সামর্থ্য। কিন্তু ফিক্সিং কেলেঙ্কারি তাঁর ক্যারিয়ারের সকল সম্ভাবনা শেষ করে দেয়।
সেলিম মালিক যখন তাঁর ভাইয়ের সাথে লাহোরের ইকবাল পার্কের ভিক্টোরিয়াস ক্লাবে যান তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। আর সেখানে গিয়ে প্রথমে শুরু করেন লেগ স্পিন। এই ক্লাবের কোচ ছিলেন রব নেওয়াজ, তিনি লক্ষ্য করেন সেলিম মালিকের বোলিং এর থেকে ব্যাটিং বেশ ভালো। আর সেখান থেকেই ব্যাটসম্যান হবার গল্প শুরু হয় সেলিম মালিকের। তাঁর এই কোচের কাছ থেকেই তিনি শিখেছিলেন কাট এবং শটের বিপদজনক দিক।
এর থেকেই তিনি শুরু করেন স্ট্রেইট শট। এরপর ক্যারিয়ার জুড়ে বেশিরভাগ সময় খেলে গেছেন স্ট্রেইট শট। বছরের পর বছরের ধরে ক্রস ব্যাট স্ট্রোক শটও খেলে গিয়েছিলেন মালিক। এছাড়াও বেশির ভাগ সময় স্ট্রেইট বল শটের দিকে নজর ছিল তাঁর। যদিও সেলিম মালিক খুব কম পরিমান স্ট্রোক শট করতেন তবুও সেগুলো ছিল দৃষ্টি নন্দন এবং প্রতিপক্ষের জন্য ভয়ংকর।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে লাহোরের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে সেলিম মালিকের। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় প্রথম শ্রেনির ম্যাচে করেন ক্যারিয়ারের প্রথম শতক। এছাড়াও প্রায় একই সময়ে অস্ট্রেলিয়া অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের একটি সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়। যা পাকিস্তানের টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়েছিল। এই সিরিজে বেশ ভালো পারফর্ম করেন সেলিম মালিক। এই সিরিজের পরই তাকে ভাবা হয় তিনি পাকিস্তান ক্রিকেটে বেশ বড় একজন তারকা হবেন।
১৯৮১-৮২ সালে পাকিস্তান দলের সাথে অস্ট্রেলিয়া সফরে যান সেলিম মালিক। কিন্তু দলে অনেক বেশি সিনিয়র ক্রিকেটার থাকায় ওই সিরিজে মাত্র তিনটি অনুশীলন ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি। এরপর পাকিস্তান ক্রিকেটে বিদ্রোহের সুর দেখা যায়। দলের বেশ কিছু ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াদাদের অধিনায়কত্বে খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। এর ফলে ১৯৮২ সালে করাচিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে চারজন ক্রিকেটারকে অভিষেক করাতে বাধ্য হয় পাকিস্তান দল ম্যানেজমেন্ট।
এই টেস্টে অভিষেক ঘটে সেলিম মালিকের। প্রথম ইনিংসে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১২ রানে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান তিনি। দ্বিতীয় ইনিংসে চার নম্বর পজিশনে ব্যাটিং এ নামেন তিনি। ব্যাটিং এ নেমে বেশ দ্রুত শতক তুলে নেন তিনি। এই শতক করার সময় সেলিম মালিকের বয়স ছিল ১৮ বছর ৩২৮ দিন। এই শতক করে তিনি পাকিস্তানের ইতিহাসে অভিষেকে সবচেয়ে কম বয়সী সেঞ্চুরিয়ানে পরিণত হন।
দলে সিনিয়র ক্রিকেটাররা ফিরে এলে দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন সেলিম মালিক। ধীরে ধীরে তাঁর উন্নতি হচ্ছিল। যখন সুযোগ পাচ্ছিলেন তখনই সুযোগের ভালোই ব্যবহার করেছেন তিনি। এইভাবেই ভারত, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শতক তুলে নেন তিনি।
১৯৮৬ সালে পাকিস্তান সফরে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। এই সিরিজের প্রথম টেস্টে কোর্টনি ওয়ালশের বলে কব্জিতে আঘাত পান সেলিম মালিক। ২৯৬ রানে ৯ উইকেট হারানোর পর আবারো ব্যাটিং এ আসেন সেলিম মালিক। ২৯৬ রান করার পরও পাকিস্তান ওয়েস্ট ইন্ডিজের থেকে ৮৯ রানে পিছিয়েছিল। বাম হাতের প্লাস্টার নিয়েই মাঠে নেমে ৪১ বল মোকাবেলা করেছিলেন তিনি। আর এই ৪১ বলে ৩ রানে অপরাজিত ছিলেন। দশম উইকেট জুটিতে ওয়াসিম আকরামের সাথে গড়েছিলেন ৩২ রানে জুটি। দ্বিতীয় ইনিংসে ইমরান খান এবং আবদুল কাদিরের বোলিং তোপে মাত্র ৫৩ রানের গুটিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই সিরিজের পর ভারত সফরে যায় পাকিস্তান। আর ভারত সফরের সময় সেলিম মালিক খেয়াল করেননি তাঁর বাম হাতের কব্জি ঠিক হয়নি। এরপরও কলকাতাতে ঝড়ো একটি ইনিংস খেলেন তিনি। এই ম্যাচে করেন ৩৬ বলে ৭২ রান। এছাড়াও একই সিরিজে ৮১ রানের একটি ইনিংস খেলে পাকিস্তানকে নিশ্চিত পরাজয় থেকে বাঁচিয়ে দেন তিনি।
১৯৯২ সালে রিলায়েন্স বিশ্বকাপে ইমরান খান সেলিম মালিককে তিন নম্বরে ব্যাট করার সুযোগ দেন। এই সুযোগে বেশ দুর্দান্ত পারফর্মেন্স করেন তিনি। শ্রীলংকার বিপক্ষে ৯৫ বলে একটি শতক হাঁকান।
অস্বীকার করার উপায় নেই, ১৯৮৭ সালে ইংল্যান্ড সফরের সময় ক্রিকেট বিশ্বের নজর কাড়েন সেলিম মালিক। স্রোতের বিপরীতে দুর্দান্ত খেলেছিলেন। লিডস টেস্টে ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম এবং মহসিন কামাল দ্রুতই সাজ ঘরে ফিরে যান। পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরা বেশ কষ্ট করছিলেন রান করার জন্য। এমনকি জাভেদ মিয়াদাদ শুন্য রানে সাজ ঘরে ফিরে যান। কিন্তু এক প্রান্ত আগলে রেখে টিকে ছিলেন সেলিম মালিক।
দিনের শেষ হবার আগে করেছিলেন ৯৯ রান। টানা ১৮ টেস্টে কোনো শতক করতে না পারায় বেশ নার্ভাস ছিলেন তিনি। সেলিম মালিক ক্যারিয়ারের প্রথম ২১ টেস্টে করেছিলেন মাত্র ৫টি শতক। যাই হোক, অবশেষে পাকিস্তান এই টেস্টে জিতে যায়। পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে এটাই ছিল একমাত্র ফলাফল হওয়া ম্যাচ। পরের টেস্টে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর ক্যারিয়ারে ৬ষ্ঠ শতকের দেখা পান সেলিম মালিক। ওভালে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে তাঁর ব্যাটে ভর করে পাকিস্তান সংগ্রহ পায় ৭০৮ রানে। ১৯৮৮ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন সেলিম মালিক।
১৯৮৮ সালের পরবর্তীতে বছরগুলোতে বেশ নিয়মিত রান করেছিলেন সেলিম মালিক। ১৯৯২ সালে নিজেকে আবারও দুর্দান্ত প্রমান করেন তিনি। এর আগের মৌসুমে এসেক্সের হয়ে কাউন্টিতে ২০০০ রান করেন তিনি। ১৯৯২ সালে আবারো পাকিস্তান দল ইংল্যান্ড সফরে যায়। এই সফরের শুরুতেই এজবাজটনে জাভেদ মিয়াদাদের সাথে গড়ে তোলেন ৩৩২ রানে জুটি। এই ম্যাচে সেলিম মালিক করেন ১৬৫ রান।
এই দুর্দান্ত ফর্ম টেনে নিয়ে যান ক্রিকেট তীর্থ লর্ডসে। এখানে খেলেন ৬৫ রানের একটি ইনিংস। যার ফলে পাকিস্তান দল সহজেই দুই উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয়। ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে বলার মত কিছু করতে পারেননি তিনি। কিন্তু এই ম্যাচে আকিব জাভেদক বেশ ভালো ভাবেই উৎসাহ দিয়েছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একমাত্র পাকিস্তানি ক্রিকেটার যিনি ম্যাচের যেকোনো পরিস্থিতির সাথে সহজেই মানিয়ে নিতে পারতেন।
সিরিজের চতুর্থ টেস্ট অনুষ্ঠিত হয় হেডিংলিতে। এখানকার পেস বোলিং সহায়ক উইকেটে ম্যাচ হেরে যায় পাকিস্তান। কিন্তু স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন সেলিম মালিক। তিনি দুই ইনিংসে খেলেন অপরাজিত ৮২ এবং ৮৪ রানে দুইটি ইনিংস। সিরিজের শেষ টেস্টে ৪০ রানের একটি কার্যকর ইনিংস খেলে দলকে ম্যাচ জেতানোর পাশাপাশি সিরিজ জয়ও নিশ্চিত করেন।
১৯৯৩-৯৪ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে দলের অধিনায়কত্ব পান সেলিম মালিক। তাঁর অধিনায়কত্বের সময়সীমা ছিল বেশ কম। মাত্র এক বছর পাঁচ দিন। কিন্তু এই সময়ে কম বিতর্কের জন্ম দেননি তিনি। অধিনায়ক হিসেবে বেশ সফলই ছিলেন সেলিম মালিক। পাকিস্তানকে ১২ টেস্টে নেতৃত্ব দেন তিনি। এর মধ্যে ছিল ৭ জয় এবং ৩ পরাজয়।
সেলিম মালিক নিউজিল্যান্ড সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে দলকে জয় এনে দেন। কিন্তু ক্রাইস্টচার্চে অনুষ্ঠিত সিরিজের তৃতীয় টেস্টে হেরে যায় পাকিস্তান এবং একই ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত একটি ম্যাচে হেরে যায় পাকিস্তান। আর এই দুই ম্যাচ নিয়ে ফিক্সিং এর অভিযোগ এসেছে।
সেলিম মালিক তাঁর এই সাফল্য টেনে নিয়ে যান পরবর্তী শ্রীলঙ্কা সিরিজে। এই সিরিজে ২ টেস্টে জিতে নেয় পাকিস্তান।
এরপর ঘরের মাটিতে সিরিজে মুখোমুখি হয় পাকিস্তান এবং অস্ট্রেলিয়া। এই সিরিজের করাচি টেস্টে পাকিস্তান অবিশ্বাস্যভাবে ম্যাচ জিতে নেয়। শেণ ওয়ার্নের করা বলে স্ট্যাম্পিনহ মিস করেন অস্ট্রেলিয়ান উইকেট রক্ষক ইয়ান হিলি। শুধু স্ট্যাম্পিং নয়, বল মিস করেন ইয়ান হিলি। এর ফলে চারটি বাই রান পায় পাকিস্তান। আর এই চার রানের সৌজন্যে ম্যাচ জিতে যায় পাকিস্তান। অনেক তদন্তের পর বেরিয়ে আসে এই ম্যাচের শেষ দিনে খারাপ বোলিং করার জন্য শেন ওয়ার্ন, মার্ক ওয়াহ এবং টিম মে কে অর্থ দিতে চান সেলিম মালিক। কিন্তু তাঁরা সেলিম মালিকের এই ফিক্সিং এ রাজি হননি।
অবশেষে এই সিরিজের রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে ক্যারিয়ার সেরা ২৩৭ রানের ইনিংস খেলেন সেলিম মালিক। পাকিস্তান দল ফলো অনে পড়ার পর এই ইনিংস খেলে পাকিস্তানকে তুলে নিয়ে আসেন তিনি। এরপরের লাহোর টেস্টে দুই ইনিংসে ৭৫ এবং ১৪৩ রানের ইনিংস খেলে দলকে ঐতিহাসিক জয় তুলে নেন তিনি।
এতো দুর্দান্ত সব জয়ের পরও টানা দুই টেস্টে হারের মুখ দেখেছিল পাকিস্তান। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে ফ্যানি ডি ভিলিয়ার্সের গতি সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল পাকিস্তানকে। এই টেস্টে পাকিস্তান দলের মধ্যে সেলিম মালিকের ৯৯ রান ব্যতীত বলার মত কোনো রান করতে পারেন নি কেউ।
এরপর হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আবারো হারের মুখ দেখে পাকিস্তান। এই হারটি পাকিস্তানের জন্য ছিল বেশ লজ্জাজনক। যদিও পাকিস্তান দল সিরিজ জিতে এসেছিল কিন্তু সেলিম মালিক বলার মত কিছুই করতে পারেননি। এই সিরিজের পর ফিক্সিং এবং ঘুষের অভিযোগ মাথায় নিয়ে নিষেধাজ্ঞায় যান সেলিম মালিক। এরপর থেকেই পাকিস্তানের অধিনায়কের চেয়ার মিউজিক্যাল চেয়ারের মত চলতে থাকে। নিষেধাজ্ঞার কারণে জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব হারান সেলিম মালিক। এরপর আর কখনোই জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেন নি তিনি।
যদি ১০ টেস্টের পরিসংখ্যান হিসেব করা হয় তাহলে সেলিম মালিকের জয় পরাজয়ের অনুপাত হয় ২.৩৩ শতাংশ। আর এই অনুপাত নিয়েই পাকিস্তানের সেরা অধিনায়ক হিসেবে বিবেচিত হবেন সেলিম মালিক।
ম্যাচ ফিক্সিংয়ের দায়ে নিষিদ্ধ হবার পরও আবার ফিরে এসেছিলেন সেলিম মালিক। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের তদন্ত শেষ না হওয়ায় ১৯৯৫ সালের অক্টোবরে বিচারপতি ফখরুদ্দিন জি ইবব্রাহিম তাঁকে খেলার অনুমতি দেন। এরপর ১৯৯৬ সালে আবারো জাতীয় দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফরে যান। সেখানে যথারীতি নিজের পারফর্মেন্স দেখান তিনি। পাকিস্তানের হয়ে আবারো শতক হাঁকান তিনি।
ওভালে করা তাঁর করা এই অপরাজিত শতকের ভিত্তিতে ম্যাচ জিতে নেয় পাকিস্তান। সাথে ২-০ তে সিরিজও জিতে নেয়। একই বছর ক্যারিয়ারের সর্বশেষ শতক করেন সেলিম মালিক। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোতে প্রায় সাড়ে ছয় ঘন্টা ব্যাটিং করে ম্যাচ বাঁচানো ১৫৫ রান করেন তিনি।
কলম্বোতে এই টেস্ট খেলার পর আরো সাতটি টেস্ট খেলছেন সেলিম মালিক। এই সাত টেস্টে মাত্র একবার পঞ্চাশের বেশি রান করতে পেরেছেন তিনি। তাঁর জন্য এই দিন গুলো বেশ কষ্টকর।
বিভিন্ন কালো লেনদেনের অভিযোগে তদন্ত হচ্ছিল সেলিম মালিকের বিপক্ষে। এই সময়ে পাকিস্তানে উইকেট রক্ষক লতিফ রশিদ এক সাক্ষাৎকারে সেলিম মালিক, ওয়াসিম আকরাম সহ অনেক বড় নামের বিপক্ষে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ তোলেন। এই সময়ে সেলিম মালিকের বিপক্ষে অসংখ্য তদন্ত শুরু হয়েছিল। এছাড়াও এইসব সমস্যার পাশাপাশি নিজের বয়সের ছাপও খুঁজে পাচ্ছিলেন নিজের পারফর্মেন্সে।
সেলিম মালিক ছিলেন শেষ পর্যন্ত লড়াই করা একজন ব্যক্তি। তিনি তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলেন চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে কলকাতায়। ম্যাচটি ছিল প্রথম এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। এই ম্যাচে সবুজ উইকেটে জাভাগাল শ্রীনাথ এবং ভেঙ্কটেশ প্রসাদের বলে ধরা পড়েন পাকিস্তানের বাটসম্যানরা। ইডেন গার্ডেনে এই ম্যাচে ২৫ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বসে পাকিস্তান। এরপর মঈন খানের সাথে ৮৫ রানের জুটি গড়ে কিছুটা হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দেয় পাকিস্তান। এই ম্যাচে দুই ইনিংসেই স্লিপে ক্যাচ দিয়ে আউট হন সেলিম মালিক। তিনি কোনো ভাবেই তাঁর নিজের সেই দুর্দান্ত পুরোনো ফর্ম ফিরে পাচ্ছিলেন না।
সেলিম মালিকের পাকিস্তান ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে। এই বিশ্বকাপে মোট চারটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো ম্যাচেই দুই অঙ্কের ঘর ছুঁতে পারেননি তিনি।
এর এক বছর পর বিচারপতি মালিক মোহাম্মদ কাইয়ুমের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয় সেলিম মালিক শেণ ওয়ার্ণ এবং মার্ক ওয়াহকে একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থের বিনিময়ে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর ফলে পাকিস্তান ক্রিকেট থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হন তিনি।
আর এভাবেই অন্ধকারে হারিয়ে যায় এক প্রতিভবান ক্রিকেটার। যাক প্রতিভা দিয়ে মনে রাখতো ক্রিকেট বিশ্ব,তাকে মনে রাখতে হয় বিংশ শতাব্দীতে ফিক্সিংয়ের দায়ে নিষিদ্ধ প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে। এরপরে উচ্চ আদালতে নিষেধাজ্ঞা কমেছে সেলিম মালিকের। কিন্তু ক্রিকেটে আর কোনো ভূমিকাতেই ফিরতে পারেননি।
ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০৩ টেস্ট খেলেছিলেন সেলিম মালিক। এতে ৪৩.৬৯ গড়ে করেছেন ৫৭৬৮ রান। সাথে আছে ১৫ টি শতক।ওয়ানডেতে ২৮৩ ম্যাচে ৫ টি শতক এবং ৪৭ টি অর্ধ-শতকে করেছেন ৭১৭০ রান।
একজন পার্ট টাইম বোলার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে নিয়েছেন ৫ উইকেট। এছাড়াও ওয়ানডেতে মোট ৮৯ টি ডিসমিসাল করেছেন সেলিম মালিক।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে কাভার অঞ্চলে দুর্দান্ত ফিল্ডিং ছিল তাঁর। এছাড়াও আউটফিল্ড থেকে বেশ ভালো থ্রো করতে পারতেন। পরবর্তীতে স্লিপেও বেশ দুর্দান্ত ফিল্ডারে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।
পাকিস্তানের এই ব্যাটসম্যানকে ব্যাটিং করতে দেখা ছিল বেশ সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু তাঁর পারফর্মের প্রতিফলন তাঁর ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যানে প্রকাশ পায় না। এছাড়াও তাঁর ফিক্সিং কাণ্ড তাঁর কারিয়ারের সব অর্জনকে মলিন করে দিয়েছে।