তিনি পৃথিবীতেই এসেছিলেন ডান বাহুর একটা সমস্যা নিয়ে। বাহু পুরোপুরি সোজা করতে পারতেন না বলে তাঁর অজান্তেই ছোটবেলা থেকেই তাঁর কাঁধ সেটা ভারসাম্য করে নিত। ফলে একজন সাধারণ মানুষের কাঁধের চেয়ে বেশি কার্যকর হয়ে ওঠে তাঁর কাঁধ। জন্মগত এই ত্রুটি ও কাঁধের এই বাড়তি সুবিধা নিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ক্রিকেট বিশ্বের সর্বকালের সেরা।
তবে তাঁর এই বোলিং অ্যাকশন চার চার বার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তবে তাঁর অ্যাকশন যে বৈধ তা বারবার প্রমাণ করে ফিরে এসেছেন। অবসরে যাওয়ার দশ বছর পরেও তিনি টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক। শ্রীলঙ্কা তো বটেই হয়ে পুরো ক্রিকেটের ইতিহাসে হয়ে উঠেছেন এক বিস্ময়কর নাম, মুত্তিয়া মুরালিধরন।
বিশ্ব ক্রিকেটে বোলিং এর যত রেকর্ড আছে তাঁর প্রায় সবই যেন শ্রীলঙ্কান এই স্পিনারের নামে। টেস্ট ক্রিকেটে একমাত্র বোলার হিসেবে তাঁর ৮০০ উইকেট নেয়ার কীর্তি তো আমরা সবাই জানি। এই তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা গ্রেট লেগ স্পিনারের উইকেট সংখ্যা ৭০৮।
মুরালি ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন এক দশকেরও বেশি। তবে তাঁর এই ফেলে যাওয়া বেঞ্চ মার্কের কাছাকাছিও এখনো কেও যেতে পারেনি। এখনো ক্রিকেট খেলছে তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টেস্ট উইকেটের মালিক জেমস অ্যান্ডারসন। যার ঝুলিতে উইকেট আছে ৬১৪ টি। ফলে নিকট ভবিষ্যতে মুরালিকে ধরতে পারার মতও কেউ নেই। তিনিই একমাত্র বোলার যার প্রতি টেস্টে গড় উইকেট সংখ্যা ৬ এর বেশি।
ওয়ানডে ক্রিকেটেও সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী তিনি। এই ফরম্যাটে তাঁর ঝুলিতে আছে ৫৩৪ উইকেট। ক্যারিয়ারে মাত্র ১২টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেললেও ক্রিকেটের তিন ফরম্যাট মিলিয়ে তিনিই সর্বোচ্চ ১৩৪৭ উইকেটের মালিক।
টেস্ট ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কা দল মুরালির উপর কতটা নির্ভরশীল ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাও একটা পরিসংখ্যান বলি যেটা হয়তো খুব বেশি উচ্চারিত হয় না। টেস্ট ক্রিকেটে যে কোনো বোলারের চেয়ে বেশি বোলিং করেছেন তিনি। ১৩৩ টেস্ট খেলা মুরলি করেছেন মোট ৪৪০৩৯ টি ডেলিভারি। অর্থাৎ প্রতি ম্যাচে গড়ে বল করেছেন ৩৩১ টি। তাঁর পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে এতটা ধকল নিয়ে খেলেছেন এই স্পিনার।
কী পরিমাণ প্রত্যাশার চাপ নিয়ে মাঠে নামতেন এই বোলার তার আরেকটি উদাহরণ দিই। ১৯৯৬ এর ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ী দলটা তখনও উপমহাদেশের বাইরে টেস্টে তেমন কোনো সাফল্য পায়নি। ১৯৯৮ সালে ইংল্যান্ডে একটি টেস্ট খেলার আমন্ত্রণ পায় অর্জুনা রানাতুঙ্গার সেই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দল। ইংল্যান্ডে তখনও কোনো টেস্ট জয় পায়নি শ্রীলঙ্কা।
তাই টেস্ট ক্রিকেটে অচেনা কন্ডিশনে নিজেদের শক্তি জানান দেয়ার জন্য ওই একটা টেস্টই ছিল বড় সুযোগ। খুব স্বাভাবিক ভাবে পুরো দল তখন তাঁকিয়ে মুরালির উপরই। ম্যাচের আগের অধিনায়ক রানাতুঙ্গা বলে দিয়েছেন মুরলিকে টানা বল করে যেতে হবে এই ম্যাচে। যেভাবেই হোক তিনি জয় নিয়েই ফিরতে চান।
সেই ওভাল টেস্টে মোট ১৬ উইকেট নিয়েছিলেন মুরলি। ওই পাঁচ দিনে ১১৪ ওভার বল করেছিলেন তিনি। মুরলির ওপর এতটাই আস্থা ছিল যে ওভালের ব্যাটিং পিচে টস জিতেও ইংল্যান্ডকে ব্যাট করতে পাঠায় অর্জুনা রানাতুঙ্গা। তিনি চেয়েছিলেন প্রথম দিন থেকেই মুরালির তোপে পড়ুক ইংল্যান্ড। হয়েছেও তাই।
প্রথম ইনিংসে ৫৯.৩ ওভার বল করে ১৫৫ রানে নিয়েছিলেন ৭ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৪ ওভার বল করে ৬৫ রানে নিয়েছিলেন ৯ উইকেট। এই ম্যাচ একটি উদাহরণ মাত্র। এরপর ক্যারিয়ারের এক যুগ ঠিক এতটাই কাজ ও প্রত্যাশার চাপ নিয়ে খেলেছেন তিনি।
তবে তার ব্যতিক্রমী বোলিং অ্যাকশনের জন্য অনেকবারই ধাক্কা খেতে হয়েছে তাঁকে। ২০০৪ সালের মার্চে তাঁর দুসরা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। তবে সে বছরই অক্টোবরে আবার প্রমাণিত হয় তাঁর দুসরা বলের অ্যাকশনে কোনো ত্রুটি নেই। ফরে আবার ফিরে পান স্বাধীনভাবে বোলিং করার অনুমতি।
এছাড়া মোট চারবার বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। ১৯৯৫,১৯৯৯,২০০৪ ও ২০০৬ সালে বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষা দিয়ে নিজেকে বৈধ প্রমাণ করেছেন তিনি।
এমনকি ২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের চ্যানেল ফোরে একটি অনুষ্ঠানে বাহুতে প্রায় এক কেজি ওজনের ব্রেসলেট পড়ে বোলিং করে দেখিয়েছিলেন মুরালিধরণ। প্রথমে তিনি খালি হাতে তিনটি বল করেন যার একটি অফ স্পিন, একটি টপ স্পিন আরেকটি দুসরা ছিল।
পরে তিনি হাতে ৪৬ সে.মি. লম্বা সেই ব্রেসলেট পরে বোলিং করে প্রমাণ করেছিলেন যে তিনি হাত সোজা রেখেই বল করেন। ব্রেসলেট পরেও তিনি হুবুহু তিনটি বল করে দেখান। টিভি প্রেজান্টার মার্ক নিকোলাসও সেই ব্রেসলেট পরে সাক্ষী দিয়েছিলেন যে এটা পরার পর হাত বাঁকানোর কোনো সুযোগই নেই। আসলে তাঁর কাঁধের সেই ক্ষমতা এবং অসাধারণ রিস্ট অ্যাকশনই তাঁর বোলিং অ্যাকশনকে এমন বৈচিত্রময় করে তুলেছিল যা খালি চোখে দেখলে মনে হতো তিনি বোধহয় হাত বাঁকিয়ে বল করছেন।
এইসব কিছু ছাপিয়ে তিনি হয়েছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা একজন। ২০০২ সালে উইজডেন তাঁকে টেস্ট ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা বোলারের উপাধি দেয়। সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ মুরালিকে বলেছিলেন ‘বোলিংয়ের স্যার ডন ব্র্যাডম্যান।’
এছাড়া ২০০০ ও ২০০৬ সালে দুইবার তিনি উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্যা ইয়্যার হন। ক্যারিয়ারের শেষ বলে প্রজ্ঞায়ন ওঝাকে আউট করে প্রথম ও একমাত্র বোলার হিসেবে ৮০০ উইকেট নেয়ার কীর্তি গড়েন। আসলে কিংবদন্তিরা তো এমনই হন। শেষ বেলার দু:খটাকেও যে তাঁরা রাঙিয়ে দিয়ে যান।
তাঁকে নিয়ে আপনি বিতর্ক করতে পারেন। অনেক রকম, অনেক কথাই বলতে পারেন। কিন্তু বিতর্ক শেষে আপনি তাঁকে শ্রেষ্ঠ মানতে বাধ্য।