অম্লান হাসিতে বিশ্বজয়

১৯২০ সালের ঘটনা।

ভারতের দক্ষিণ অংশ থেকে লোকেরা তখন শ্রীলঙ্কায় গিয়ে বসতি স্থাপন করছে। নানারকম ব্যবসা করে সমৃদ্ধ হচ্ছে। এই ধারায় তামিল নাড়ু থেকে ক্যান্ডিতে পাড়ি জমালেন পেরিয়াস্বামী সিনাস্বামী।

উদ্দেশ্য ছিলো চা পাতার ব্যবসা করা। ব্যবসা একেবারে মন্দ হয়নি। পেরিয়াস্বামী বেশ টাকা পয়সাও করে ফেললেন ক্যান্ডিতে। তার ছেলে অবশ্য চা পাতার ব্যবসায় আগ্রহ পেলো না। সে দিলো এক বিস্কুটের কারখানা। পেরিয়াস্বামী স্বপ্ন দেখতেন, তাদের ব্যবসা একদিন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। তাই হলো। ছেলে সিনাস্বামী মুত্তিয়ার বিস্কুট রপ্তানি হতে শুরু করলো ইউরোপ, লাতিন আমেরিকায়।

এই নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলো পরিবারটি। কিন্তু পেরিয়াস্বামী সন্তুষ্ট হতে পারেন না। তিনি বলেন, আমার বংশের কেউ একদিন বিশ্বজয় করবে। সাধারণ একটা ব্যবসায়ী পরিবার থেকে কী বিশ্ব বিজেতা উঠে আসে?

আসে! আসে বলেই এই পরিবারে জন্ম নেয় এক বিশ্বজয়ী জাদুকর।

এই পরিবার থেকে উঠে এসে ক্রিকেটের ইতিহাস তছনছ করে দেয় এক সৌম্য, শান্ত ছেলে। এই পরিবার থেকেই বেরিয়ে আসে তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা বোলার। এই পরিবারই হয়ে ওঠে বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত সন্তানের জন্মদাতা।

হ্যাঁ, সেই সন্তানটির নাম দেশবন্ধু মুত্তিয়া মুরালিধরন।

আপনি যদি সাদা চোখে ও মনে পরিসংখ্যানে বিশ্বাস করেন, তাহলে অবশ্যই ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা বোলার মানবেন মুরালিধরনকে। এখানে আর কোনো কথা নেই। ১৩৪৭টি আর্ন্তজাতিক উইকেটের মালিক তিনি। এটা জানার পর আসলে আর কোনো কথা চলতে পারে না। কিন্তু সমস্যা হলো মুরালিধরণের কাঁধ। আর এই কাঁধের জন্য এই বিশাল সংখ্যাটার পরও তাকে নিয়ে কথা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে।

বিশ্বের হাজারো মানুষ এখনও মনে করেন, মুরালিধরন বৈধ অ্যাকশনের বোলার ছিলেন না। এই শত শত উইকেট তিনি বৈধভাবে পাননি। বিষান সিং বেদি একবার তাঁকে ‘জ্যাভলিন থ্রোয়ার’ পর্যন্ত বলেছিলেন। আর এই সন্দেহ ও বলাটাই মুরালির জীবনের প্রতীক। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সাফল্য পাওয়ার পরও তাকে ক্যারিয়ারের প্রতিটা মুহুর্তে লড়াই করতে হয়েছে এই সন্দেহের সাথে। এবং আজও ক্যারিয়ার শেষে তাঁকে সেই সন্দেহ নিয়েই জীবন কাটাতে হচ্ছে।

অথচ নিজেকে শুদ্ধ প্রমাণ করার জন্য কী করেননি মুরালিধরন।

বারবার আইসিসির ল্যাবরোটরিতে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন। মেশিনের হাতে নিজেকে সপে দিয়েছেন। পরীক্ষার ফল তার পক্ষে এসেছে। তারপরও আবার সন্দেহ এবং আবার পরীক্ষা।

বিজ্ঞানীরা হরেকরকম পরীক্ষা করে রায় দিয়েছেন, মুরালি বৈধসীমার চেয়ে বেশি হাত বাঁকা করেন না। জন্মগতভাবে তার কাঁধটাই এমন বাঁকা যে, মনে হয় তিনি বল ছুড়ছেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের এসব কথা লোকেরা, আম্পায়াররা কানে তোলেননি। তারা বারবার মুরালিকে তুলেছেন পরীক্ষার চিতায়।

মানুষের সন্দেহ থেকে বাচতে একবার হাতে লোহার ব্রেসলেট পরে ক্যামেরার সামনে বল করেছিলেন। খালি হাতেও যেমন বল করতে পেরেছেন, ঠিক একইসব ডেলিভারি ওই এক কেজি লোহার ব্রেসলেট পরেও করেছেন। তারপরও সন্দেহ।

চার বার আইসিসির ল্যাবে পরীক্ষা দিয়েছেন। তার বোলিং অ্যাকশন ও মানবদেহের বৈশিষ্ট্য নিয়ে অন্তত ১০টি সায়েন্টিফিক পেপার পাবলিশ হয়েছে। সবাই একবাক্যে বলেছেন, মুরালি ঠিক আছেন। মাইকেল হোল্ডিংয়ের মতো ঘোরতর সমালোচক নিজের ভুল স্বীকার করেছেন।

হোল্ডিং একসময় বেদির সাথে সুর মিলিয়ে মুরালিধরনকে বলতেন-শটপুটার। আর শেষ পর্যন্ত সব পরীক্ষার ফল দেখে বলেছেন, ‘মানব দেহ যে কত বিচিত্র, সেটা বুঝেছি আমি।’

সমস্যা এটা না যে, মুরালিধরনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অবমাননাকর এই যে, এতো সফল একটা মানুষকে এমন সব অমানবিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবার। কিন্তু মুরালিধরণ তাতে হাল ছাড়েননি। সেই ছোটবেলায় তাকে গড়ে তোলা কোচ সুনীল ফার্নান্দো বলেছিলেন, তোমার কাজ খেলা, খেলা নিয়েই ভাববে।

কথা রেখেছেন মুরালিধরন। ক্রিকেট ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে আর ভাবেননি। যে যখন যেখানে বলেছেন, সেখানে দাড়িয়ে হাসিমুখে পরীক্ষা দিয়েছেন। শত সন্দেহ আর অবিশ্বাসেও মুখ থেকে শিশুদের ওই সারল্যটা সরে যায়নি।

মুরালির হাসি নিয়ে বলছিলাম। যখন বোলিং করতে আসেন বড় বড় দুটি চোখ আর মুখের অভিব্যক্তি কাঁপন ধরিয়ে দিতো ব্যাটসম্যানদের শরীরে। সেই মানুষটিই সারা জীবন হাসি দিয়ে জয় করে যেতে চাইলেন বিশ্ব।

এই গল্পের শেষটা হতে পারতো রূপকথার মত-অতঃপর সুখশান্তিতে বসবাস।

কিন্তু মুরালির জীবনে শান্তিটা নেই। সবশেষ তাকে নিয়ে একটা জীবনভিত্তিক চলচ্চিত্র বানানো হচ্ছিলো। বিজয় সেতুপতি তার চরিত্রে অভিনয় করবেন বলে সব ঠিক ছিলো। পোস্টারও বেরিয়েছিলো। কিন্তু ভারতের তামিল রাজনীতিবিদরা রাস্তায় নামলেন। তারা বললেন, মুরালিধরণকে নিয়ে সিনেমা হবে না।

মুরালির বিপক্ষে অভিযোগ, তিনি শ্রীলঙ্কায় ঘরোয়াযুদ্ধের সময় তামিলদের পাশে থাকেননি। একজন তামিল হিন্দু হয়েও তিনি সিংহলিজদের সাথে মিশেছেন। শান্তির কথা বলেছেন।

শান্তির কথা বলাটাও আজকাল অন্যায়!

মুরালি কথা বাড়াননি। সেতুপতিকে বলেছেন, ছবি করার দরকার নেই। তিনি যেমন আছেন, তেমনই ভালো আছেন।

মুরালি সবসময়ই ভালো থাকেন। তার মুখের হাসিটা মিলায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link