উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসের সেরা ক্লাব রিয়ালের সাথে কমবেশি সব ক্লাবের ইতিহাসই আছে। কিন্তু চেলসি-রিয়াল মুখোমুখি হওয়ার ইতিহাস নেই বললেই চলে। গেল আসরের সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় তাঁরা। এর আগে শেষবার দুই দল মুখোমুখি হয়েছিল ১৯৯৮ সালের সুপার কাপে। তবে টুর্নামেন্টে মুখোমুখি না হলেও দুই দলের জার্সিতে খেলেছেন অসাধারণ কিছু খেলোয়াড়।
- ইডেন হ্যাজার্ড: (চেলসি ২০১২-২০১৯, রিয়াল মাদ্রিদ ২০১৯-বর্তমান)
শেষ থেকেই শুরু করা যাক। রিয়াল মাদ্রিদের সর্বশেষ গ্যালাক্টিকো সাইনিং হলেন ইডেন হ্যাজার্ড। ২০১৯ সালে চেলসি থেকে ১০৫ মিলিয়ন ইউরোর বদলে তাকে দলে ভেড়ায় রিয়াল। বলতে গেলে নিজেদের ঘরের ছেলেকে সাজিয়ে গুছিয়েই রিয়ালের কাছে পাঠিয়েছিল চেলসি।
২০১২ সালে প্রথম চেলসির চোখে পরে হ্যাজার্ডকে। হ্যাজার্ড তখন খেলতেন লিঁলের হয়ে। লিঁলের জার্সিতে অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর তাকে দলে নিয়ে আসে চেলসি। শুধু তাকেই নয়, তার ভাই থোরগান হ্যাজার্ডও সঙ্গী হয়েছিলেন লন্ডন যাত্রায়। চেলসিতে আসা বেশিরভাগ খেলোয়াড় যখন তাদের লোন সিস্টেমের যাঁতাকলে পরে নাভিশ্বাস ছাড়ে তখন হ্যাজার্ড ছিলেন স্বমহীমায় উজ্জ্বল। হ্যাজার্ডকে কখনও নিজেকে প্রমাণ করার জন্য লোনেও যেতে হয়নি, চেলসিতে এসেছিলেন নিজের জায়গা পাকা করেই। চেলসি লিজেন্ড হয়ে দুই মৌসুম ধরে রিয়ালের জার্সি রাঙাচ্ছেন তিনি।
- থিবো কর্তোয়া: (চেলসি ২০১১-২০১৮, রিয়াল মাদ্রিদ ২০১৮-)
হ্যাজার্ডের মতন একই পথের পথিক থিবো কর্তোয়াও। ২০১১ সালে বেলজিয়ান ক্লান জেঙ্ক থেকে তাকে কিনে আনে চেলসি। পিওতর চেকের অধীনে নিজেকে শাণিত করার সর্বোচ্চ সুযোগ নিয়েছিলেন কর্তোয়া। আর সে প্রতিদান দিয়েছেন ব্লুজদের। তিন মৌসুম অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে ধারে কাটিয়ে যখন ফিরলেন চেলসিতে, তখন চেলসির দোলবারের জায়গাটা তার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। হতাশ করেননি কর্তোয়া।
৪ মৌসুম যত্নের সাথে চেলসির গোলবার সামলে ২০১৮ সালে অবশেষে রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমান কর্তোয়া। প্রথম মৌসুম স্ট্রাগল করলেও পরের মৌসুম থেকেই স্বমহীমায় ফিরেছেন কর্তোয়া। নিজেদের তৈরি করা তারকাই বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে চেলসির সামনে।
- মাত্তেও কোভাচিচ: (রিয়াল মাদ্রিদ ২০১৫-২০১৮, চেলসি ২০১৮-)
চেলসির তৈরি করা খেলোয়াড় যদি তাদের গলার কাঁটা হয়, তবে রিয়ালের গলার কাঁটাও হয়ে উঠবেন রিয়ালের হাতে তৈরি হওয়া তারকা। মাত্তেও কোভাচিচ ২০১৫ সালে ইন্টার মিলান থেকে রিয়ালে এসেছিলেন রিয়ালের ভবিষ্যৎ হওয়ার জন্য। হিসেব ছিল মদ্রিচের পর এই মিডফিল্ডের হাল ধরবেন কোভাচিচ।
কিন্তু প্লেয়িং টাইমের জন্য রিয়ালের সাথে বনিবনা না হওয়ায় রিয়াল থেকে ধারে কোভাচিচ পাড়ি জমান চেলসিতে। আর সেখানেই হয়ে উঠেছেন চেলসি মিডফিল্ডের ভরসা। গত ৩ মৌসুম ধরে চেলসি মিডফিল্ডের ভরসার পাত্র কোভাচিচ।
- মার্কোস আলানসো: (রিয়াল মাদ্রিদ ২০১০, চেলসি ২০১৬-বর্তমান)
মার্কোস রিয়ালের আলানসো ছিলেন রিয়ালের ঘরের ছেলে। রিয়াল একাডেমির একান্ত বাধ্যগত ছাত্র ছিলেন ১২ বছরের জন্য। কিন্তু যখন রিয়ালের জার্সিতে প্রমাণের সময় এলো তখনই যেন তাকে বসিয়ে দেওয়া হলো।
২০১০ সালে প্রথম ও একমাত্রবারের মতন রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি গায়ে চড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছিল মার্কোস আলানসোর। কিন্তু এরপরই ফ্যাবিও কোয়েন্ত্রাওয়ের আগমণের দরুণ দল ছাড়তে হয় তাকে। ইংলুশ লিগে নিজেকে প্রমাণ করে ২০১৬ সালে জায়গা করে নেন চেলসি দলে। সেই থেকে চেলসি দলের বামপাশে দায়িত্ব পুরোটাই তার উপরে।
- আলভেরো মোরাতা: (রিয়াল মাদ্রিদ ২০১০-২০১৪, ২০১৬-১৭, চেলসি ২০১৭-২০২০)
আলভেরো মোরাতাও ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ঘরের ছেলে। একসময় রিয়াল মাদ্রিদের ভবিষ্যৎ স্ট্রাইকারও ভাবা হচ্ছিল তাকে। ২০১২ সালে রিয়াল দলে প্রমোটেড হয়ে নজর কাড়তেও শুরু করেন। কিন্তু নিজের জায়গা নিশ্চিত করতে রিয়াল ছেড়ে জুভেন্টাসে যোগ দেন তিনি। সেখান থেকেও বাই-ব্যাক ক্লজ দিয়ে তাকে দলে নিয়ে আসে রিয়াল। কিন্তু এ দলেও সন্তুষ্ট না হয়ে মুভ করতে চান মোরাতা। শেষপর্যন্ত চেলসিতে তাকে বিক্রি করে দেয় রিয়াল মাদ্রিদ।
- গঞ্জালো হিগুয়েন: (রিয়াল মাদ্রিদ ২০০৭-২০১৩, চেলসি ২০১৯)
গত দশকের সেরা স্ট্রাইকারদের হিসাব করলে হিগুয়েনের নাম উপরের দিকেই আসবে। ইন্টারন্যাশনাল স্টেজে নিজের সেরা খেলা না দেখাতে পারলেও ক্লাব ফুটবলে ভয়ানক স্ট্রাইকার ছিলেন এই আর্জেন্টাইন। আর্জেন্টিন আ থেকে প্রথম রিয়াল মাদ্রিদ স্কাউট করে তাকে নিয়ে এসেছিল মাদ্রিদে। সেখানে নিজের ক্যারিয়ারের সেরা ৬ মৌসুম কাটান। এরপর ২০১৯ সালে এসে ৬ মাসের জন্য ধারে চেলসিতে নাম লিখিয়েছিলেন হিগুয়েন।
- আরিয়েন রোবেন: (চেলসি ২০০৪-২০০৭, রিয়াল মাদ্রিদ ২০০৭-২০০৯)
ডান পাশ দিয়ে টান দিয়ে ডি-বক্সের সামান্য সামনে থেকে কাট ইন করে শট। আরিয়েন রোবেনকে এভাবেই চিনিয়ে দেওয়া সম্ভব। এই একভাবে গোল করে নিজেকে লিজেন্ড হিসেবে তৈরি করেছিলেন রোবেন। রোবেন ছিলেন শুরুতে চেলসি খেলোয়াড়। জোসে মোরিনহো চেলসিতে নাম লেখানোর সাথে সাথে আরিয়ান রোবেনকে নিয়ে এসেছিলেন নেদারল্যান্ড থেকে। সেখানে দুই মৌসুম কাটিয়ে নাম লেখান রিয়াল মাদ্রিদে। দুই দলের দুই মৌসুম করে কাটিয়েছেন রোবেন।
- ক্লদ ম্যাকেলেল: (রিয়াল মাদ্রিদ ২০০০-২০০৩, চেলসি ২০০৩-২০০৮)
রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে একজন খেলোয়াড়ের বিদায় পুরো দলকে আনস্টেবল করে দিইয়েছে, এমন ঘটনা ঘটেছে একবারই। ২০০৩ সালে, আর সেই খেলোয়াড়ের নাম ক্লদ ম্যাকেলেল। ক্লদ ম্যাকেলেলে ছিলেন ফ্রেঞ্চ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। ‘ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার’ ক্টার্ম এখন সকলের খুবই পরিচিত, কিন্তু এই রোলকে ফুটবল জগতে পরিচিত করেছিলেন ‘ম্যাকেলেলে রোল’ হিসেবে। রিয়ালকে জিতিয়েছেন ২ চ্যাম্পিয়নস লিগ। কিন্তু ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ তাকে স্যাক্রিফাইস করেছিলেন ডেভিড বেকহ্যামের জন্য। ফলে ২০০৩ সালে চেলসির কাছে বিক্রি করতে দেয় রিয়াল। চেলসিতে গিয়েই শেষ পর্যন্ত নিজের রোলকে ইমপ্রুভ করেন।
মাইকেল এসিয়েন: (চেলসি ২০০৫-২০১৮, রিয়াল মাদ্রিদ ২০১২-২০১৩)
মাইকেল এসিয়েনকে যতটা না রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড় বলা যায়, তার থেকে বলা যায় মোরিনহোর খেলোয়াড়। ৮ বছর চেলসিতে খেলার পর তাকে রিয়ালে নিয়ে এসেছিলেন মোরিনহো। নিজের শেষ সময়ে রিয়ালে এক মৌসুমের জন্য ধারে এনেছিলেন তিনি।
- রিকার্দো কারভালহো: (চেলসি ২০০৪-২০১০, রিয়াল মাদ্রিদ ২০১০-২০১৩)
রিকার্দো কারভালহো ছিলেন আরেকজন মোরিনহো খেলোয়াড়। চেলসিতে মোরিনহো তার প্রথম সিজনে কিনে এনেছিলেন তাকে। পর্তুগাল থেকে এসে ইংলিশ দলের আশা-ভরসা হয়ে উঠেছিলেন। ২০০৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত চেলসিতে ছিলেন ডিফেন্ডার হিসেবে। চেলসি থেকে বরখাস্ত হয়ে ইন্টার ঘুরে যখন রিয়ালে আসলেন, তখনই রিকার্দোকে টেনে আনেন রিয়ালে। ৩ মৌসুম শেষে মোরিনহো চলে যাওয়ার পর থেকে রিয়ালেও তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়।
নিকলাস আনেলকা: (রিয়াল মাদ্রিদ ১৯৯৯-২০০০, চেলসি ২০০৮-২০১২)
আনেলকা ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের প্রি-গ্যালাক্টিকো গ্যালাক্টিক সাইনিং। ১৯৯৯ সালে রিয়ালের স্ট্রাইক ফোর্স বৃদ্ধি করার জন্য আর্সেনাল থেকে ২৩ মিলিয়ন দিয়ে রিয়ালে আসেন আনেলকা। কিন্তু বাজে একটা মৌসুম শেষে তাকে ছেড়ে দেয় রিয়াল। ২০০৮ সালে এসে চেলসিতে যোগ দেন আনেলকা। ৪ মৌসুম চেলসিতে খেলে ১৮৪ ম্যাচে ৫৯ গোল করেন।