কাকা আক্ষেপের উপাখ্যান

ফুটবল! আবেগ, ভালোবাসা, জয়-পরাজয়, উত্থান-পতন যার প্রতিটা মিনিটে মিনিটে মিশে আছে। এই ফুটবল, ফুটবলারদেরকে নিয়ে উন্মাদনা বিশ্বের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে। হালের মেসি-রোনালদো ট্রান্সফারই আমাদেরকে আবার মনে করিয়ে দিয়েছে ফুটবল আবেগের, ফুটবল ভালবাসার।

এমনি করেই দর্শকদের আবেগে ভাসিয়ে ২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর ফুটবলের এক দু:খী রাজপুত্র, রিকার্ডো কাকা সুদীর্ঘ ১৬ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টেনে অবসর ঘোষণা করেন। আমেরিকার এমএলএস লিগের অরলান্ডো সিটি এফসির হয়ে শেষ ম্যাচটি খেলেছিলেন ব্রাজিলিয়ান কাকা। ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল বেশ আশা জাগানিয়া এবং সম্ভাবনাময়। তবে শেষটায় ছিলো ভীষণ আক্ষেপ।

কাকা, যার পুরো নাম রিকার্ডো আইজেকসন ডস সান্তোস লেইতে। ১৮ বছরের এক তরুণ ছোকরা ২০০১ সালে স্বদেশী ক্লাব সাও পাওলোর মূল দলের হয়ে মাঠে নামেন তিনি। অবশ্য ট্রফি জেতা ততদিনের শিখে নিয়েছেন। ১৫ বছর বয়সেই সাও পাওলো যুব দলকে নেতৃত্ব দিয়ে জেতান কোপা ডি জুবেনি ট্রফি। মূল দলের অভিষেক বছরেই দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই গোলে প্রথমবারের মতো টর্নেইয়ো রিও-সাও পাওলো এর শিরোপা এনে দেন কাকা।

সে মৌসুমে মোট ২৭ ম্যাচে করেন ১২ গোল। একজন তরুণ এটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে নজর কারার মতোই পারফর্মেন্স। ইউরোপে উড়ে যাবার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রয়ে গেলেন আরো একটি মৌসুম ঘরের ক্লাবেই। সে মৌসুমে ২২ ম্যাচে ১০ গোল করে ইউরোপে তার চাহিদা যেন বাড়িয়ে নিলেন আরো কয়েকগুণ।

তাছাড়া ২০০২ সালে অনভিজ্ঞ একজন খেলোয়াড় হিসেবে রোনালদো, রোনাদিনহো, কাফুদের সতীর্থ হয়ে বিশ্বকাপ জয় যেন স্বপ্নের পাখায় যোগ করে এক নতুন পালক। বিশ্বকাপ শেষে ছোট বেলার ক্লাবের মায়া ছেড়ে, পাড়ি জমান ইউরোপে নতুন চ্যালেঞ্জ, নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নেবার স্বপ্ন নিয়ে।

সে সময়ে ইউরোপীয় ক্লাব পরাশক্তি এসি মিলান ৮.৫ মিলিয়ন ইউরোতে উদীয়মান কাকাকে নিজেদের করে নেন। তার সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল মূল একাদশে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করা। কিন্তু তৎকালীন অন্যতম সেরা এটাকিং মিডফিল্ডার রুই কস্তাকে হটিয়ে নিজের জায়গা বানানোটা বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো৷ তবে কাকা ছিলেন অদম্য, মূল একাদশে জায়গা করে নিতে তেমন কালক্ষেপণ করতে হয়নি তাকে।

সেই মৌসুমে মিলানের হয়ে অনবদ্য পারফরম্যান্স করেন কাকা। ৩০ টি ম্যাচ খেলে গোল করেন ১০, পাশাপাশি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গোলে রয়েছে তার অবদান। স্কুডেট্টো, ইউয়েফা সুপার কাপ – ট্রফিগুলো শোভা বাড়িয়েছে কাকার অর্জনের শেলফে। সেবার ইতালিয়ান সিরি এ’র সেরা খেলোয়াড়ের তকমাটাও জোটে তরুণ এই ফুটবলারের।

২০০৫ সালে কনফেডারেশন কাপ জয় আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছিল ২০০৬ বিশ্বকাপের। তবে সেবার নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল জিনেদিন জিদানের ফান্সের সামনে, বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বিদায় নেয় ব্রাজিল। আরেকটি বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখবার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় কাকার। জিদান নিজের ঘরে তুলতে চেয়েছিলেন ২০০৬ বিশ্বকাপ, তবে সেটা কেড়ে নেয় ইতালি।

পরের মৌসুমে অনবদ্য কাকা চ্যাম্পিয়নস লিগে মিলানকে বানিয়েছেন দুর্নিবার। প্রতিপক্ষের মাঠে স্ট্যান্ডিং ওভেশন পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তবে কাকা ছিলেন দারুণ চোখের শান্তি। চ্যাম্পিয়নস লীগের সেমিফাইনালের প্রথম লেগে অসাধারণ খেলে দুই গোল আদায় করেন তিনি।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং ওল্ড ট্রাফোর্ড সেদিন দেখেছিল কাকার জাদু৷ ম্যাচে বলদি হয়ে মাঠ থেকে বের হয়ে যাবার সময় তিনি পেয়েছিলেন প্রতিপক্ষ সমর্থকদের বন্দনা। দাড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেছিল ম্যান ইউ সমর্থকেরা। ম্যাচটি ৩-২ গোলে হারলেও ঘরের মাঠে অবিশ্বাস্য খেলা খেলে চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনালে চলে যায় মিলান। গ্রীসের এথেন্সে সেবার হয়ত বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে হেলেনা ছিল ট্রফিটা।

এগামেমনন, প্যারিস, হেক্টর কিংবা অ্যাকিলিসকে ছিলেন তাঁর হিসেবটা টানতে গেলে হয়ত একটু গড়মেল হয়ে যেতে পারে। তবে হেলেনা তথা চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি কিন্তু সেবার মিলানে এসেছিলো, উঠেছিল কাকার হাতে।

সেই মৌসুমের অনবদ্য কাকা যেন ব্যালন ডি’অরের দৌড়েও ছিলেন অনবদ্য। রোনালদো-মেসিকে পেছনে ফেলে নিজের প্রথম এবং একমাত্র ব্যালন ডি’অর জেতেন রিকার্ডো কাকা। অর্জনের ঝুলি আরো একটু হলো ভারি।

এত অল্প সময়েই এতসব অর্জন যেন ফুটবল বিশ্বকে এক সম্ভাবনারই ইঙ্গিতই দিচ্ছিলো। হয়ত কাকাই পরবর্তীতে হতে যাচ্ছেন সেরাদের সেরা। কাকার ক্যারিয়ার যদি একটা নাটক হয় তবে এই স্বর্ণালি দিনগুলো ছিল নাটকের রাইজিং একশন আর ক্লাইম্যাক্স ধরা যেতে পারে রিয়াল মাদ্রিদে যোগদান।

পরবর্তী মৌসুম গুলোতে মিলানের আর্থিক সংকট যেন বারেবারেই প্রশ্ন তুলেছে কাকা তবে চলে যাচ্ছে। হ্যাঁ! সকল প্রশ্নের অবসান ঘটিয়ে ২০০৯/১০ মৌসুমে ইতালি থেকে স্পেনের উড়াল দেন কাকা। ফ্রেটিগস পিরামিড মতে কাকার ক্যারিয়ার নাটকের ফলিং একশন হয়ত স্পেনে পা রাখার পর থেকেই শুরু হয়। কেননা এরপরই কাকাকে দেখতে হয়েছে নিজের ক্রমাগত বিপর্যয়।

নিজের শরীরটা বেইমানি করেছে কিংবা নিয়তি। রিয়ালের আসার পর থেকেই ইঞ্জুরি সমস্যা যেন জেকে বসে কাকার হাটুতে। ইনজুরি সমস্যায় একাদশে নিজের জায়গা হারান মেসুত ওজিলের কাছে। ইঞ্জুরি সমস্যা নিয়েই গিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়, ২০১০ সালের বিশ্বকাপে দেশের হয়ে অংশ নিতে। অনুপ্রেরণা ব্রাজিলের হয়ে ২০০৯ এ কনফেডারেশন কাপ জয়।

তবে ইঞ্জুরি যে তার স্বভাবিক খেলায় বেশ ভোগাচ্ছিলো তা স্পস্টতই বোঝা যাচ্ছিলো পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে। বিশ্বকাপ শেষেই সম্মুখীন হন অস্ত্রোপচারের। আট মাস ছিলেন মাঠের বাইরে। রিয়াল অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল তার এই তারকা ফুটবলারের প্রত্যবর্তনের। ফিরে তবু এসেছিলেন কাকা কিন্তু সময়ের সাথে, ইঞ্জুরির সাথে পাল্লা দিতে দিতে মলিন হয়ে যাচ্ছিলো তাঁর পারফরম্যান্স।

কোচ হোসে মরিনহোর হয়ত তাকে খেলাতে ইতস্তত বোধ করতেন। রিয়াল ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়ই তাই সাইড বেঞ্চে বসে কাটিয়ে দিতে হয়েছে কাকাকে। ৪ বছরের রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে তিনি মোটে ম্যাচ খেলেছেন ১২০ টি, গোল করেছেন ২৯ টি। যা তার পেশাদার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের পারফরম্যান্সের সাথে তুলনায় বড্ড বেমানান।

১৩/১৪ মৌসুমে মিলানে ফিরে যান কাকা। তবে নিয়তির লীলাখেলায় তিনি হারতে বসেছিলেন। থিতু হতে পারেনি কোথাও। ইতালি, ব্রাজিল ঘুরে শেষে আমেরিকায় এসে সমাপ্তি ঘটান তার পেশাদার ক্যারিয়ারের।

তবে হয়ত এমনটা হবার ছিল না। হয়ত রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাব কিংবদন্তি হিসেবেই তার অবসরে যাবার কথা ছিল৷ ব্রাজিলিয়ান এই রাজপুত্রের রুপকথার মতো শুরু হওয়া ক্যারিয়ার যে লোকচক্ষুর আড়ালে হারিয়ে যাবে এটা হয়ত কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি কাকা তথা ব্রাজিল সমর্থকেরা।

ফুটবলীয় এই মহাদ্বৈরথের যুগে যে লোকটার একজন ‘সমালোচক’ পাওয়া দুষ্কর তিনিই রিকার্ডো কাকা। আজ প্রায় ৪ বছর হতে চলেছে তিনি অবসরে, তবু আজও হয়ত এই ব্রাজিল থেকে হাজার মাইল দূরে অবস্থিত আমাদের এই ছোট্ট দেশটার কোন এক ফুটবল পাগল ছেলে ইউটিউবে হাতরে বেড়াচ্ছে কাকার অসাধারণ সব গোলের ভিডিও। মাঝেসাঝেই ফেসবুকের নিউজফিডে কেউ একজন শেয়ার দিয়ে বেড়াচ্ছে দূর্বার গতিতে মধ্যমাঠ চিড়ে গোলবারের উদেশ্যে কাকার ছুটে চলার ভিডিও। রিকার্ডো কাকা চির অমলিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link