জেপি ডুমিনি, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রাইসিস ম্যান

জ্যাক ক্যালিসের মতো পরিসংখ্যান তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দেবে না কিংবা এবি ডি ভিলিয়ার্সের মতো ভক্তকূল নেই তাঁর। তবু দেড় যুগের বেশি সময় ধরে জাতীয় দলের বিপদের মূহুর্তে হাল ধরেছেন তিনি। ব্যাটিং কিংবা বোলিং দুই জায়গাতেই চেষ্টা করে গেছেন নিজের সেরাটা দিয়ে। তিনি জেপি ডুমিনি, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রাইসিস ম্যান। 

স্ট্যানফন্টেইনের রাস্তায় বন্ধুদের সাথে খেলতে খেলতে শৈশবেই ক্রিকেটের প্রেমে পড়া। কখনো ডাস্টবিন, কখনো গাছের গুঁড়িকেই উইকেট মেনে নেমে পড়তেন ক্রিকেট মাঠে। বন্ধুর বাসায় রাতে থেকে যেতেন যাতে পরদিন সকালে দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচ দেখতে পারেন। সময় যত গড়িয়েছে ডুমিনির মনে ক্রিকেটের মোহ ততই গাঢ় হয়েছে। 

হার্শেল গিবস এবং জ্যাক ক্যালিসের ভক্ত ডুমিনি প্রতিভার জানান দেন কৈশোর পেরোনোর আগেই। মাত্র সতেরো বছর বয়সেই তাঁর সাথে ঘরোয়া ক্রিকেটের চুক্তি সেরে নেয় ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স। ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ পারফরম্যান্সের সুবাদে জাতীয় দলে ডাক পেতেও সময় লাগেনি। বয়স কুঁড়ি পেরোনোর আগেই জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে এই অলরাউন্ডারের। 

কিন্তু শ্রীলংকার বিপক্ষে অভিষেক সিরিজটা সম্ভবত স্মৃতির পাতা থেকে মুছে ফেলতে চাইবেন এই তারকা। অভিষেক ম্যাচে গোল্ডেন ডাকের পাশাপাশি গোটা সিরিজে তাঁর সংগ্রহ ছিল মোটে ২৯ রান। সিরিজ শেষে দল থেকে ছেঁটে ফেলা হয় তাঁকে। 

তরুণ ডুমিনির জীবনের সবচেয়ে কঠিন ছিল সেই সময়টা। এক পর্যায়ে তো ক্রিকেটই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো পারফর্ম করলেও তারকাঠাসা সেই প্রোটিয়া দলে জায়গা ফিরে পাওয়াটা মোটেই সহজ ছিল না। বছর দেড়েক বাদে স্কোয়াডে ফিরলেও একাদশে সুযোগ মিলছিল না। 

অবশেষে ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পার্থ টেস্টের আগে অ্যাশওয়েল প্রিন্স ইনজুরিতে পড়লে কপাল খুলে ডুমিনির। এবারে তাঁর শুরুর ভুলটা করেননি, দলে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করেন এই তারকা। অভিষেক টেস্টেই ৪১৪ রান তাড়া করতে নেমে অপরাজিত হাফ সেঞ্চুরি করে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন তরুণ ডুমিনি। অজিদের বিশ্বসেরা বোলিং লাইন আপের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করা ডুমিনিকে দেখে বিশ্বাস করা কঠিন যে তিনি নিজের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছেন। 

এরপর আর ফিরে তাকানো নয়, সময় যত গড়িয়েছে ডুমিনি তত আলো ছড়িয়েছেন। মেলবোর্নে পরের টেস্টেই গোটা বিশ্ব দেখেছে তাঁর সামর্থ্য। তিনি যখন ব্যাটিংয়ে নামেন তখন ১৪১ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে দক্ষিণ আফ্রিকা। স্বাগতিকদের চাইতে পিছিয়ে ২৫৩ রানে, চোখ রাঙাচ্ছে ইনিংস পরাজয়।

কিন্তু, ডুমিনি যেন সেদিন চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন, টেল এন্ডারদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়লেন। সাত ঘন্টা ব্যাট করার পর পরদিন বিকেলে ১৬৬ রান করে যখন সাজঘরে ফিরছেন মেলবোর্নের দর্শকদের করতালিতে তখন কান পাতা দায়। 

এরপর তিন ফরম্যাটেই নিয়মিত হয়েছেন জাতীয় দলে। মাঝেমধ্যে দুর্ভাগ্যের শিকারও হতে হয়েছে তাঁকে, ২০১১ বিপক্ষে ফিরেছেন সেঞ্চুরি থেকে মাত্র এক রান দূরে থাকতে। তবে সবচেয়ে আক্ষেপের হয়ে থাকবে বোধহয় ২০১৫ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেয়া। প্রোটিয়া সোনালী প্রজন্মের শেষ বিশ্বকাপটা রাঙিয়ে তুলতে চেষ্টার কমতি ছিল না ডুমিনির। শ্রীলংকার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছেন, ডেভিড মিলারকে নিয়ে গড়েছেন পঞ্চম উইকেটে ২৫৬ রানের জুটি। তবুও শেষরক্ষা হয়নি, গ্র্যান্ট এলিয়টের এক ছক্কায় যেন শেষ হয়ে গেছে ডুমিনির ছোটবেলার স্বপ্ন। 

২০১৯ সালে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেন এই তারকা। জাতীয় দলের হয়ে ৪৬ টেস্টে ছয় সেঞ্চুরি আর আট হাফসেঞ্চুরিতে ৩২.৮৫ গড়ে ডুমিনির সংগ্রহ ২১০৩ রান। লাল বলের চাইতে সাদা বলের ক্রিকেটেই বেশি কার্যকরী ছিলেন এই অলরাউন্ডার।

মিডল অর্ডারে ব্যাট করতে নেমে ১৯৯ ওয়ানডেতে চার সেঞ্চুরি আর ২৭ হাফ সেঞ্চুরিতে ৫১১৭ রান করেন। এছাড়া কার্যকরী অফস্পিনে শিকার করেছেন ৬৯ উইকেট। ক্রিকেটের ক্ষুদ্র সংস্করণে মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে সুনাম ছিল তাঁর। ৮১ ম্যাচে ১২৬ স্ট্রাইকরেটে ১৯৩৪ রান করার পাশাপাশি বল হাতে শিকার করেন ২১ উইকেট। 

মাঠ থেকে অবসর নিলেও ক্রিকেট ছাড়তে পারেননি এই অলরাউন্ডার। ২০১৫ সালেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জেপি২১ ফাউন্ডেশন যার লক্ষ্যই ছিল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে ক্রিকেটে আগ্রহী করে তোলা। দক্ষিণ আফ্রিকার হাজারো সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন দেখছেন তাঁর সুবাদেই। নিজে বিশ্বকাপ জিততে পারেননি, ডুমিনি তাই প্রশান্তি খুঁজে নিয়েছেন ভবিষ্যতের বিশ্বকাপজয়ীদের গড়ার কাজে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link