মহেন্দ্র সিং ধোনি, আপনি আমার অধিনায়ক। জনগণমনের অধিনায়ক। মহেন্দ্র সিং ধোনি, আপনি এক ছোট শহরের সিংহহৃদয় পুরুষ। আপনি বিশ্ব জিততে চেয়েছিলেন। স্বপ্নপূরণ করে তবেই থেমেছেন।
মাহি আপনাকে দেখলে আমিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। স্বপ্ন দেখা এবং সেই স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করে তা সফল করা আপনাকে দেখেই শিখছি। আপনিই গোটা দেশকে শিখিয়ে গিয়েছিলেন, কম কথা বলে, নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকলে বিশ্ব জিতে নেওয়া যায়।
দিনকাল বদলে গিয়েছে। এখন সোশাল মিডিয়ার যুগ। সবাই নিজের কথা বলতেই ব্যস্ত। আগে আমি, পরে আমরা। নিজের ঢাক ঢোল যত পারো পিটিয়ে নাও।
এমন এক সময়ের প্রতিনিধি হয়েও আপনি ব্যতিক্রমী। আপনি ফোন ব্যবহার করেন না। চাইলেই আপনাকে পাওয়া যায় না। নিজেকে লুকিয়ে রাখেন নিজের মধ্যেই। সোশাল মিডিয়ায় সব বিষয়ে মতামত প্রকাশ করেন না। বিশেষ বিশেষ দিনে টুইট করেন না। স্ট্যাটাস আপডেট করেন না।
বিশ্বকাপ হয়ে গেল। আপনার কাছ থেকে সেরকম কিছুই শুনলাম না। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আসছে, সেই সময়ে আপনি কথার ফুলঝুরি ছোটাবেন এমন দিবাস্বপ্নও দেখি না। আপনি সবার মধ্যে থেকেও সবার থেকে আলাদা।
১৩ বছর আগে দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন। ২ এপ্রিল ছিল সেই বিশ্বজয়ের বর্ষপূর্তি। শচীন টেন্ডুলকর টুইট করলেন। বীরেন্দ্র শেবাগ টুইট করলেন। কিন্তু, আপনি মহেন্দ্র সিং ধোনি না করলেন টুইট, না করলেন স্মৃতিরোমন্থন।
গুগল সার্চ ইঞ্জিন তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না ১৩ বছর আগের বিশ্বজয় নিয়ে আপনার এখনকার কোনও মন্তব্য।
আপনার স্ত্রী সাক্ষী টুইট করেছেন আপনার হয়ে হয়তো। কিন্তু আপনি নিশ্চুপ। এই সোশাল মিডিয়ার বিস্ফোরণের যুগেও কীভাবে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারেন মিস্টার ইন্ডিয়া? নিজের গৌরবজনক অধ্যায়ে আলো ফেলতে আপনার যে ঘোর অনীহা!
জাতীয় দলের হয়ে আপনার শুরু দেখেছি। টিম ইন্ডিয়ার জার্সিতে আপনার শেষও দেখেছি। এক কিশোরীর আপনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়াও চাক্ষুষ করেছি। আবার লজ্জায় নিজেকে মুড়ে ফেলে হাসতে হাসতে টিম বাসে উঠে যাওয়াও দেখেছি।
মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়েতে ওই আইকনিক ছক্কা দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিলাম। আজও সেই ছক্কার অ্যাকশন রিপ্লে দেখলে চোখে জল আসে। মুম্বইয়ের সেই মায়াবী রাতে আপনাকে কিন্তু কাঁদতে দেখিনি।
মহেন্দ্র সিং ধোনি, আপনাকে দেখলে আমার সত্যিই অবাক লাগে। মাঠে কেমন চুপ করে থাকেন। কাউকে আউট করলেও উচ্ছ্বসিত হন না। ছক্কা মারলেও বরফশীতল থাকেন। ম্যাচ জিতলেও আপনার জীবন নিস্তরঙ্গই। হারলেও অভিব্যক্তিহীন। আজকের দুনিয়ায় এমন ছবি দেখাই যায় না।
পেহলে দর্শনধারী, পিছে গুণবিচারী। এই দর্শনেই চলছে গোটা বিশ্ব। আপনার ব্যাটিং দর্শনীয় নয়। আপনার ব্যাটিং টেকনিকের প্রসঙ্গ উঠলে, নিন্দুকরা মুচকি হাসতেন। আপনিও বলতেন, ‘আমি কোনওদিন শচীন পাঁজির মতো ব্যাট করতে পারব না। আমার ব্যাটিং দেশের বাকি মানুষগুলোর মতোই। আমার সঙ্গে দেশের মানুষ নিজেদের মেলাতে পারেন, তাই আমি এত জনপ্রিয়, এত গ্রহণযোগ্য।’
আপনার কিপিং নিয়েও কত্ত সমালোচনা হয়েছে! অথচ উইকেটের পিছনে আপনি আস্ত একটা কিপিং ম্যানুয়াল। আপনার নো লুক রান আউট কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। সেই আপনি উৎসবে মাতেন না। উদযাপনও করেন না। কেন মাহি? কেন?
আপনার ক্রিকেট আপনার মতোই রহস্যময়। হারতে থাকা ম্যাচ প্রলম্বিত করে টেনে নিয়ে যান শেষ বল পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত জেতার আশা জিইয়ে রাখেন।
প্রয়াত বন্ধু সন্তোষের কাছ থেকে ‘হেলিকপ্টার শট’ শিখে তা ভুবনবিখ্যাত করে দিয়েছেন। হেলিকপ্টার শট মেরেই সন্তোষকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আপনি। আর আপনাকে কুর্নিশ জানায় গোটা দেশ।
মাহি, বেশ মনে আছে দেশকে বিশ্বকাপ জেতানোর মুহূর্তটা। কুলশেখরাকে গ্যালারিতে ফেলার পরে ব্যাটটা কেমন ঘুরিয়ে নিলেন। ওই ব্যাট ঘোরানোর প্রসঙ্গ উঠলে সুনীল গাভাসকরের গলায় এখন জমা হয় আবেগের বাষ্প। ওই ব্যাট ঘোরানো দেখলে আমার মতো ধোনি ভক্তরা বুকে বল পান। হেলিকপ্টার শট মেরে কাঁধের জামাটা গুটিয়ে নেওয়ার মধ্যেও অদ্ভুত এক ঔদ্ধত্য বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।
মিস্টার ধোনি, আপনার ওই ঔদ্ধত্য আমার প্রজন্মের অহংকার। কাউকে কিছু বলা না, তেড়ে যাওয়া না, ওই অহংকার, ওই ব্যক্তিত্ব প্রতিপক্ষকে সবক শিখিয়ে যায় প্রতিমুহূর্তে।
ধোনি, আপনাকে দেখলে আমার বিস্ময় জাগে। গোটা দেশ যখন থরথর করে কাঁপছে উত্তেজনায়, আপনি তখন শান্ত, স্থির। আপনার হৃৎপিণ্ড কাঁপে না?
কেউ বলেন খেলাটার উপর এতটাই দক্ষতা যে টেনশন আপনার ধারেপাশে আসে না। আবার কেউ আপনাকে হিংসে করেন। আপনাকে ভাগ্যের বরপুত্র বলে আপনার সাফল্যগুলোকে খাটো করার চেষ্টা করেন। আপনি এগুলো জানেন না, বিশ্বাসই করি না। আপনার নির্লিপ্তি অনেককিছুর জবাব দিয়ে যায়।
সর্বসমক্ষে ছেলেবেলার কোচদের নিয়ে কোনওদিনও কিছু বলতে শুনিনি আপনাকে। আপনার এক কোচকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, শিষ্য দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন ১৩ বছর হয়ে গেল। এই ১৩ বছরে আপনি কতটা এগোলেন? কতটাই বা পিছোলেন?
সেই কোচ শুনে টুনে বললেন, ‘আমি এক পাও এগোইনি। এক পাও পিছোইনি। যেমন ছিলাম, তেমনই আছি। আগামিদিনেও একইরকম থাকব।’
তিনি আরও বলছিলেন, ‘আমার পিআর হয়তো খারাপ। তাই আমি পিছিয়ে। কিন্তু এটাও জানি আমি খারাপ আছি শুনলে সবার আগে যে মানুষটা ঝাঁপিয়ে পড়বে, তার নাম মহেন্দ্র সিং ধোনি।’
আরেক শিক্ষকের আবছা আবছা মনে পড়ে, নোংরা জামা পরিহিত এক ছোট্ট ছেলেকে। সেই তিনিই একদিন বলছিলেন, ‘তখন কি আর জানতাম এই ছেলেই একদিন বিশ্বজয়ী হবে।’
ধোনি আপনি নিজেও হয়তো জানেন, ভারতীয় ক্রিকেটের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মতো প্রতিভাবান আপনি নন। কিন্তু আপনার ভিতরে থাকা এক্স ফ্যাক্টর আপনাকে ওঁদের সমান উচ্চতার বেদিতে বসিয়ে দিয়েছে। আপনার স্ত্রী সাক্ষী হয়তো তাই বলেন, ‘নো মাউনটেইন্স হাই এনাফ টু স্টপ ইউ ফ্রম ক্লাইম্বিং।’ সত্যি সত্যি এমন কোনও পাহাড় নেই, যা আপনার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখেছি জামা খুলে লর্ডসে ওড়াতে। হাল আমলের বিরাট কোহলি শূন্যে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছোড়েন। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো গোলের পরে মেতে ওঠেন সিউ সেলিব্রেশনে। সেই জায়গায় ব্যতিক্রম আপনি। আপনার উৎসব উদযাপনে নেই বন্যতা। পরাজিত আপনাকে সর্বসমক্ষে ভেঙে পড়তেও দেখিনি কখনও। বরং নতুন যুদ্ধ জেতার জন্য নিজেকে তৈরি করে গিয়েছেন নিরন্তর। এখনও তাই করেন। ধোনি হওয়ার আগেও তাই করতেন। অধিনায়ক তো এরকমই হন।
গোটা দেশ একসময়ে আপনার অবসর নিয়ে মহা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। যেখানেই আপনি, সেখানেই প্রশ্ন, কবে? কবে? ইডেনে এক সাংবাদিকের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘সময় এলেই হবে।’
সেই আপনি কোভিডকালে কাউকে বিন্দুবিসর্গ না জানিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ফেললেন। অবসরের মধ্যেও চমক। ইনস্টাগ্রামে কেউ কোনওদিন অবসর বার্তা দিয়েছেন? আপনার আগে শুনিনি কখনও।
এখন দুমাস ক্রিকেট খেলেন। তাতেই আপনি শিরোনামে। আপনাকে নিয়ে কালি খরচ হয় সংবাদমাধ্যমে।
আইপিএলের একদিন আগে নেতৃত্বের ব্যাটন তুলে দিলেন তরুণ প্রতিশ্রুতিমান রুতুরাজের হাতে। এখানেও বরাবরের মতোই রহস্যে আবৃত রেখেছেন নিজেকে।
সময়ের নিয়মে এই দুমাসের ক্রিকেট থেকেও সরে যাবেন একদিন। এও জানি, সরে যাওয়ার আগাম ইঙ্গিত দেবেন না কাউকে।
তবুও মন চায় মাহি, শেষের গান আপনি গাইবেন না কখনওই। সবুজ মাঠ থেকে আপনার সরে যাওয়ার অর্থ আমাদের স্বপ্নগুলোও বেরঙিন হয়ে যাওয়া।
আপনি থাকুন, আপনি খেলে যান। গ্যালারিতে ধ্বনি উঠুক, ‘খেলছে ধোনি, মারছে ধোনি, মারছে ধোনি ছয়।’