১৯৮৯ সালের অ্যাশেজ। ওল্ড ট্রাফোর্ডে মুখোমুখি ক্রিকেটের দুই কুলীন সদস্য। কিন্তু সেবার অ্যাশেজে ভরাডুবি হয়েছিল ইংল্যান্ডের, হেরেছিল সবগুলো টেস্টেই। আগের ম্যাচেগুলোর চিত্রনাট্য মেনেই যেন এদিনও প্রথম ইনিংসে ১৮৭ রানের বিশাল লিড পায় অজিরা। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ইংলিশদের ব্যাটিং অর্ডার পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে, ৩৮ রানেই খুইয়ে বসে পাঁচ খানা মূল্যবান উইকেট।
ইনিংস ব্যবধানে হার তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমন দুঃসময়ে ব্যাটিংয়ে আসলেন দলে নতুন আসা উইকেটরক্ষক। আসার পর দেখলেন ডেভিড গাওয়ারের চলে যাওয়া। জন এম্বুরের সাথে গড়লেন ১৪২ রানের জুটি, ফলোঅন এড়ায় ইংল্যান্ড। যদিও ম্যাচের ফলাফলে কোনো পরিবর্তন আসেনি তাতে, সবাই জানবে হেসে-খেলেই ম্যাচ জিতেছিল অজিরা।
কিন্তু, সেদিন একাই অজিদের বিপক্ষে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, ছয় ঘন্টা দীর্ঘায়িত করেছিলেন অজিদের জয়যাত্রা। অপরপ্রান্তে সবাই আউট হয়ে গেলেও একপ্রান্ত আগলে রেখে অপরাজিত ছিলেন ১২৮ রানে। কে জানে হয়তো সঙ্গী পেলে সেদিনের ম্যাচটাও বাঁচিয়ে ফেলতেন তরুণ সেই উইকেটরক্ষক, যাকে পরবর্তী প্রজন্ম চিনবে জ্যাক রাসেল নামে।
জ্যাক রাসেলের ক্রিকেট খেলার শুরু বাবার ক্লাব স্ট্রাউট ক্রিকেট ক্লাব দিয়ে। বাবার সাথে একইসাথে খেলতেন তিনি। অধিনায়কত্বের পাশাপাশি ব্যাটিং-বোলিং দুটো বিভাগই সামলানোর দায়িত্ব বর্তেছিল তার কাঁধে। কিন্তু সবকিছু বদলে যায় ১৪তম জন্মদিনের দুদিন আগে। ১৯৭৭ অ্যাশেজের চতুর্থ টেস্ট , হেডিংলিতে মুখোমুখি দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী।
টনি গ্রেগের বলে উইকেটের পেছনে থাকা অ্যালান নটের দারুণ এক ক্যাচ বদলে দিল কিশোর রাসেলের ভাবনার দুয়ার। সাথে সাথে বাবাকে বলে উঠলেন আমিও ওরকম ক্যাচ ধরতে চাই। অ্যালান নটের সেই ক্যাচের প্রতি মুগ্ধতা পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই বয়ে বেড়িয়েছেন রাসেল, ‘একদম নিচু হয়ে গেছিল বলটা, কিন্তু কি দারুণভাবেই না তিনি বলটা এক হাতে লুফে নিলেন। তখন চিন্তাটা আসে আমাকেও এমন ক্যাচ ধরতে হবে। উইকেটরক্ষক হবার সাধনা শুরু সেদিন থেকেই।’
স্ট্রাউ্ট ক্রিকেট ক্লাবে খেলতে খেলতেই এক সময় ডাক পেলেন কাউন্টির দল গ্লস্টারশায়ার থেকে। আরেক কিংবদন্তি বব টেলরের সান্নিধ্য পাবার আশায় সুযোগটা লুফে নিতে দুবার ভাবেননি রাসেল। অবশ্য রাসেলের দুর্দান্ত উইকেটরক্ষক হওয়ার পেছনে টেলরের অবদানও কম নয়। নিজের পুরোটা দিয়ে রাসেলকে সাহায্য করে গেছেন তিনি।
এমনকি শৈশবের আইডল অ্যালান নটের সাথে পরিচিতও হয়ে যান টেলরের সুবাদেই। নট কেন্টের হয়ে কাউন্টি খেললেও রাসেলের জন্য ড্রেসিংরুমের দরজা ছিল সবসময় খোলা। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ম্যাচে ব্যাট হাতে সুযোগ না পেলেও উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে লুফে নিয়েছিলেন সাতটি ক্যাচ। রাসেলের পুরো ক্যারিয়ারের প্রতিচ্ছবি হয়ে রয়েছে সেটাই। কিপার হিসেবে দক্ষতা প্রশ্নাতীত থাকলেও ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিলেন বড্ড নড়বড়ে।
টেস্টের আগেই সুযোগ পেয়েছিলেন একদিনের ক্রিকেটে। ১৯৮৭ সালে পাকিস্থানের বিপক্ষে আটে ব্যাট করতে নেমে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন কেবল দুই বল। দুই রানে অপরাজিত থাকার পাশাপাশি সেদিন ধরেছিলেন দুটো ক্যাচ। কিন্তু সীমিত ওভারের ক্রিকেটে কেবল কিপিং দিয়ে দলে টেকা যায় না, অ্যালেক স্টুয়ার্টের আগমনে তাই দল থেকে বাদ পড়ে যান দ্রুতই।
১১ বছরের ক্যারিয়ারে তাই ওডিয়াই কেবল ৪০টি। টেস্টে অবশ্য রাজসিকভাবেই আবির্ভাব হয়েছিল তার, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে লর্ডসে মাত্র ছয় রানের জন্য সেবার অনার্স বুকে নাম তুলতে পারেননি। যদিও সেই আক্ষেপ ঘুচে যায় দ্রুতই, পরের বছরই ভারতের বিপক্ষে লর্ডসে খেলেন ১২৪ রানের দারুণ এক ইনিংস।
দৃশ্যপটে অ্যালেক স্টুয়ার্টের আগমনের পরই বদলে যায় চিত্রনাট্য। অ্যালেক উইকেটরক্ষক হিসেবে মধ্যম সারির হলেও ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা। অন্যদিকে, ভঙ্গুর টপ অর্ডারের কারণে ইংল্যান্ডের নির্বাচকরা দলে চাইতেন এমন কাউকে যিনি কিনা ব্যাটটাও চালাতে পারেন। এরকারণে সাদা বলের ক্রিকেটে অ্যালেকই হয়ে দাঁড়ান প্রথম পছন্দ। কিন্ত লাল বলে রাসেল ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। এরকারণে বেশিরভাগ ম্যাচেই ইংল্যান্ডকে দুই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান নিয়ে নামতে দেখা যেত।
মুখে গোঁফ, চোখে চশমা আর মাথায় বিখ্যাত ফ্লপি হ্যাট পড়ে কিপিং করতেন রাসেল। বিশেষ করে হ্যাটটার প্রতি আলাদা অনুরাগ ছিল রাসেলের। পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে একটা হ্যাটই পড়ে গেছেন তিনি। হ্যাট নিয়ে একবার ইসিবির সাথে বচসায়ও জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেবার ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) নিয়ম করে দেয় নীল হ্যাট পরে খেলবেন সবাই।
কিন্তু, গোঁ ধরে বসেন রাসেল, সাধের ফ্লপি হ্যাট ছাড়া মাঠে নামতে অস্বাকৃতি জানান তিনি। অবশেষে তার দাবি মেনে নেয় ইসিবি। ১৯৯৮ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ব্যাট হাতে বাজে সময় কাটান তিনি। পাঁচ টেস্টে করেন কেবল ৯০রান। সফরের শেষে অ্যালেক স্টুয়ার্ট নতুন অধিনায়ক ঘোষিত হলে তাই বিদায়ঘন্টা বাজে রাসেলের। প্রায় এক দশকের ক্যারিয়ারে ৫৪ টেস্টে করেছেন ১৬৫ ডিসমিসাল, পাশাপাশি ব্যাট হাতে নিয়েছেন ১,৮৯৭ রান।
তবে জাতীয় দলে পথচলা থেমে গেলেও আরও বছর পাঁচেক চুটিয়ে খেলেছেন কাউন্টি ক্রিকেট। গ্লস্টারশায়ারের ঘরের ছেলে হয়েই ইতি টেনেছেন ক্যারিয়ারের। অধিনায়ক হিসেবে দারুণ সফল ছিলেন রাসেল, দলকে জিতিয়েছেন পাঁচটি ঘরোয়া টুর্নামেন্টের শিরোপা।
২০০৪ সালে পিঠের ইনজুরির কারণে গ্লাভসজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন রাসেল। খেলোয়াড় হিসেবে থাকাকালীন সময়েই একটা আলাদা কিটব্যাগ সাথে রাখতেন রাসেল। ম্যাচের ফাঁকে কিংবা অবসরে বসে পড়তেন রঙ তুলি হাতে। ক্রিকেট থেকে অবসরের পর তাই রাসেল প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছেন ছবি আঁকাতেই।
সাউথ গ্লস্টারশায়ারে গেলে সবাই ঢুঁ মেরে আসেন তার আর্ট গ্যালারিতে। ছোটবেলায় হতে চেয়েছিলেন সৈনিক কিন্তু রাইফেলের বদলে হাতে তুলে নিয়েছিলেন গ্লাভস। সৈনিকের সাহসিকতা, উইকেটরক্ষকের একাগ্রতা সবকিছু পেছনে ফেলে তাই জ্যাক রাসেল জীবনের গল্প শোনান ক্যানভাসে তুলির আঁচড় দিয়ে।