রাজার মুকুট, রাজার সাজ

রাহুল দ্রাবিড় কি রাজা সেজেছেন কখনও? অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম, তিনি সম্রাট নন, মহারাজাও নন, খুব বেশি হলে তিনি জায়গিরদার।

রাজার মুকুট তাঁকে মানায় না। তিনি পার্শ্বচরিত্র হয়ে থাকতেই বুঝি বেশি পছন্দ করেন। দু’ নম্বর জার্সি সবচেয়ে ভালো বোধহয় তাঁকেই মানায়। দলের ক্যাপ্টেন হলেও তিনি একনম্বর নন।

রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলিদের হেডস্যর রাহুল দ্রাবিড়কে এখন দেখি আর মন কেমন করে ওঠে। তাঁর হাসি একটুও বদলায়নি। খেলোয়াড়জীবনে যেরকম ছিল, এখনও সেরকমই রয়েছে। কিছু মানুষের হাসি দেখলে অন্যরকমের অনুভূতি হয়। ঠিকমতো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। রাহুল দ্রাবিড় সেরকমই।

বিষণ্ণ কোনও বিকেলে মনে হয়, আমি যদি রাহুল দ্রাবিড় হতাম! জীবনযুদ্ধে ধেয়ে আসা বাউন্সারগুলো যদি নামাতে পারতাম তাঁর মতো!

ঘর্মাক্ত দ্রাবিড় মুখ মুছছেন জামার হাতা দিয়ে, তারপরই ব্যাট হাতে স্টান্স নিচ্ছেন উইকেটের সামনে। সূর্য এদিকে এক আকাশ থেকে অন্য আকাশে হাঁটা লাগিয়েছে। রাহুল দ্রাবিড় ব্যাট করেই চলেছেন। তাঁকে আউট করে কার সাধ্যি!

আমার মনে পড়ছে বহু পুরনো সব ঘটনা। সেগুলোর সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে জড়িয়ে রয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়। ডিকেন্সের কথায়, সে বড় সুখের সময় ছিল না।

বাবার এক বন্ধু দীর্ঘদিন বাদে আমাদের বাড়িতে এসেছেন। আমার সঙ্গে দেখা হতেই একগাল হাসি মুখে জড়িয়ে বললেন, ‘তুমি এখন কী কর বাবা?’

সাংবাদিক পরিচয় দিতে তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কোন কাগজে কাজ কর?’ কালান্তরের নাম শুনে খুব খুশি হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাহ, ভালো তো। হাজার দশেক মাইনে পাও তো?’ আমি আর কী বলবো তখন! শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট চেটে বললাম, ‘মানে, অত তো পাই না।’

বাবার সেই বন্ধু নাছোড়বান্দা। আমার বেতন জেনে তবেই তিনি ছাড়বেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘হাজার সাতেক পাও তো, নাকি?’ সেই প্রশ্নেরও নেতিবাচক জবাব পেয়ে যা বোঝার তিনি বুঝে নিলেন। বাবার সঙ্গে কথা বলার আগে আমার উদ্দেশে বললেন, ‘‘যাক মন দিয়ে কাজ করো।’

ইডেন গার্ডেন্সে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ওয়ানডে ম্যাচ তখন এগিয়ে আসছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় জাতীয় দলের কক্ষপথ থেকে ছিটকে গিয়েছেন। গ্রেগ চ্যাপেলকে ভিলেন ঠাউরেছে গোটা দেশ। তাঁর উপরে মারাত্মক ক্ষিপ্ত সাধারণ দর্শককূল। এরকম আবহেই ইডেনে ওয়ানডে খেলতে নামছে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

ভারতের নেতৃত্ব তখন রাহুল দ্রাবিড়ের হাতে। আমি কালান্তর কাগজের সামান্য কর্মী। আমাদের ক্রীড়া সম্পাদক সুভেনদা বললেন, ‘ক্রিকেট ম্যাচ কোনওদিন কভার করোনি তো? ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়ানডে ম্যাচে মাঠে যেও।’

আমি ছাত্রাবস্থায় আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখতে ইডেনে গিয়েছিলাম। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে সেটাই আমার প্রথম ম্যাচ কভারেজ। সুযোগ দেওয়ার জন্য শুভেনদাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম।

খবর এল, ইনকোডা টিভি কিছু লোক নেবে। মেট্রো রেলের প্ল্যাটফর্মে ইনকোডা টিভি আমরা সবাই কম বেশি দেখেছি। যেদিন ওয়ানডে সেদিনই ডাকা হয়েছে ইন্টারভিউ। যাঁরা ইচ্ছুক, তাঁরা যেন জীবনপঞ্জী হাতে নিয়ে চলে আসেন ইনকোডার দপ্তরে।

ইন্টারভিউ দিতে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু সমস্যা বাড়াল ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ। অনেকদিন আগের কথা। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনেক বিষয় স্মৃতি থেকে হারিয়ে গিয়েছে। খুব সম্ভবত গড়িয়াহাটে ছিল ইনকোডা টিভির অফিস।

আমি মনে মনে হিসেব করলাম, ম্যাচ শুরু দুপুরে। ইনকোডার ইন্টারভিউয়ের সময় সকালে। টুক করে ইন্টারভিউ দিয়ে চলে যাব ইডেন। নির্দিষ্ট দিন সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম গড়িয়াহাট। ইন্টারভিউ-এর ঠিকানায় গিয়ে আমি হতবাক। বিশাল লাইন চোখে পড়ল।

একজনকে জিজ্ঞাসা করাতে জানতে পারলাম, এই এঁকেবেঁকে যাওয়া বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন চাকরিপ্রার্থীরা। আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ বাদেই আবিষ্কার করলাম লাইনে রয়েছে ‘কালান্তরে’ আমারই আর এক সহকর্মী। কেউই কাউকে বিন্দুবিসর্গ জানাইনি এব্যাপারে।

আমি আর আমার সহকর্মী লাইনে দাঁড়িয়েই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। রোদের তেজ বাড়ছে। লাইন আর এগোয় না। ম্যাচ শুরুর সময় এগিয়ে আসছে। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর পরে মেইন বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঢুকতে পারলাম। গিয়ে দেখি ঘরটা বেশ বড়।

অনেকগুলো টেবিল রয়েছে। প্রতিটি টেবিলে একজন একজিকিউটিভ বসা। তিনি ইন্টারভিউ নিচ্ছেন চাকরিপ্রার্থীদের। ডাক এল আমাদের দু’জনের। আমরা কালান্তরে কর্মরত শুনে বেশি কিছু আর জিজ্ঞাসা করলেন না সংশ্লিষ্ট একজিকিউটিভ।

তিনি জানালেন, দিনের দ্বিতীয়ার্ধে ভয়েস টেস্ট নেওয়া হবে। আমরা দুজনেই সে সব শুনে চমকে উঠলাম। ভয়েস টেস্টের পরীক্ষায় বসতে গেলে খেলা কভারেজ আর হবে না। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আমি আর আমার সেই সহকর্মী ইনকোডা টিভিতে কাজ করার প্রলোভন ত্যাগ করে ইডেনমুখো হলাম।

ইডেনে ঢুকতেই কানে এল গগনভেদী চিৎকার। সেই ওয়ানডে-তে ইডেন গলা ফাটিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে। ঘরের ছেলে সৌরভকে ইচ্ছাকৃত ভাবে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, ইডেন তা মানবে কেন?

ভারত সেই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে ১৮৮ রান করেছিল। আর দক্ষিণ আফ্রিকা বিনা উইকেটেই তুলে নেয় ১৮৯ রান। ক্যাপ্টেন রাহুল দ্রাবিড় পরে বলেছিলেন, ‘দেশে নাকি দেশের বাইরে খেলছি, বুঝতেই পারিনি।’

এদিকে রঞ্জি ট্রফিতে বাংলা-মহারাষ্ট্রের ম্যাচ চলছিল সেই সময়ে পুনেতে। ১৮৮ রানে ভারতের ইনিংস শেষ হওয়ার পরে ইডেনের জায়ান্ট স্কোর বোর্ডে দেখানো হল

মহারাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সৌরভের রান। প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের নামের পাশে লেখা ১৫৯। পরের দিন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় হেডলাইন ছিল, ‘টিম ইন্ডিয়া’ ১৮৮, সৌরভ একাই ১৫৯।

রাহুল দ্রাবিড় আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যান পুরনো দিনে। সেই সব লড়াইয়ের দিনে। ভুলতে পারি না আমি রাহুল দ্রাবিড়কে। লড়াইয়ের আরেক নাম রাহুল দ্রাবিড়।

মনে পড়ছে রাজুদের বাড়িতে রাত জেগে খেলা দেখার কথা। ডোনাল্ড স্লোয়ার দিলেন। রাহুল দ্রাবিড় ডোনাল্ডকে গ্যালারিতে পাঠালেন। দক্ষিণ আফ্রিকার ফাস্ট বোলার রেগে অগ্নিশর্মা। তেড়ে গেলেন রাহুল দ্রাবিড়ের দিকে। তিনি তখন শান্ত। কেউ রেগে তেড়ে এলে এত শান্ত থাকেন কীভাবে রাহুল দ্রাবিড়? কোনওদিন জিজ্ঞাসা করা হয়নি আপনাকে?

কাট টু ২০১১ বিশ্বকাপের বেঙ্গালুরু। ‘একদিন’ কাগজের প্রতিনিধি হিসেবে ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ কভার করতে বেঙ্গালুরুতে আমি। এখনকার ‘এই সময়’ কাগজের ক্রীড়া সাংবাদিক রূপক বসুর সঙ্গে আমার দেখা বেঙ্গালুরুতে। রূপক তখন গণশক্তি কাগজের সাংবাদিক। সেবার শ্রীনাথ, কুম্বলে, রাহুল দ্রাবিড়রাই চিন্নাস্বামীর সেই যজ্ঞের আসল পুরোহিত।

রাহুল দ্রাবিড়কে সামনে পেয়ে আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, ‘একটা ইন্টারভিউ দেবেন?’ রাহুল দ্রাবিড় হাসছেন। এখনকার হাসির সঙ্গে অবিকল মিলে যায় সেই হাসি। ‘দ্য ওয়াল’ হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে বলছেন, ‘আমি এনডিটিভিকেও ইন্টারভিউ দিইনি।’

সেই সময়ে জাভাগাল শ্রীনাথ আমাদের ত্রাতা হয়ে অবতীর্ণ হলেন। বন্ধু রূপককে শ্রীনাথ বুঝিয়ে সুজিয়ে ডেকে নিয়ে গেলেন ভিতরে। যাওয়ার সময়ে বারংবার সতর্ক করলেন, দ্রাবিড়ের সামনে যেন একটা কথাও না বলেন রূপক।

তার পরের ঘটনা মজাদার। শ্রীনাথ বিশেষ এক প্রসঙ্গ উত্থাপ্পন করে দ্রাবিড়কে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘রাহুল ২০০৭ সালেই এই ঘটনা হয়েছিল না?’ দ্রাবিড় তো অবাক। পাল্টা জিজ্ঞাসা করছেন, ‘শ্রী হঠাৎ ২০০৭ কেন?’

ইডেনে ওয়াসিম আক্রম একের পর এক রিভার্স সুইং করাচ্ছেন। রাহুল দ্রাবিড় যেন নেট করছেন। বল ছাড়ছেন। বলের লাইনে পৌঁছে যাচ্ছে তাঁর শরীর। কী সুন্দর ব্যালান্স। আমার মনে পড়ছে শ্রদ্ধেয় মতি নন্দীর সেই বিখ্যাত লাইন, ‘কমল ব্যালান্স হারাবি না।’

রাহুল দ্রাবিড়ও তাই। ভারসাম্য হারাচ্ছেন না। হঠাৎই আক্রমের একটা বল রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাট এড়িয়ে তাঁর অফস্টাম্পে চুমু খেয়ে চলে গেল। দ্রাবিড় স্তম্ভিত। নিজেও বুঝতে পারছেন না, তাঁর জমাটি ডিফেন্স ভেদ করে বল কীভাবে গলে গেল। আউট দ্রাবিড়। পাকিস্তান দল উদযাপন করছে। ইডেনে শ্মশানের স্তব্ধতা। রাহুল দ্রাবিড় আউট হয়েও শ্যাডো করে চলেছেন। যেন আবার নতুন একটা ইনিংস খেলতে নামবেন।

এখন প্রায়ই মনে হয়, আমি যদি রাহুল দ্রাবিড়ের মতো হতে পারতাম!

রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাটিং নিয়ে কবিতা কেউ কখনও লেখেননি। তিনি শচীন তেণ্ডুলকরের গ্রহেরও বাসিন্দা নন। এমনকী সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো দৃষ্টিনন্দন কভার ড্রাইভও তাঁর তূণে নেই। একসময় তাঁকে শুনতে হয়েছিল, রাহুল দ্রাবিড়ের স্কোর দেখে আইএসডি কোডের কথাই মনে হচ্ছে। দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনে বড় খেতাব আর তিনি জিতলেন কবে!

দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে তাঁর নেতৃত্বে এই ক্যারিবিয়ান মুলুক থেকেই ছিটকে যেতে হয়েছিল ভারতকে। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে তাঁর টিম ইন্ডিয়া। পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপেও শেষ মুহূর্তে এসে ধাক্কা খেয়েছে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন।

তবুও হাল ছাড়েননি তিনি। এবার সেই ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মাটিতেই রাজ্যপাট ফিরে পাওয়ার হাতছানি। রাহুল দ্রাবিড় কি এবারও বঞ্চিতই থেকে যাবেন? এবারও কি সাফল্যের পায়েস তাঁর জন্য তোলা থাকবে না? ঈশ্বর কি বারবার তাঁরই পরীক্ষা নেবেন?

রাহুল দ্রাবিড় আমাকে নস্ট্যালজিক করে তোলেন। মনে পড়ে যায় তাঁরই কথা, ‘আশা ছাড়তে নেই। আপনি যে জিনিসে ভাল তাকেই আঁকড়ে ধরতে হয়। অন্যের সাফল্য দেখে চোখ টাটাতে নেই। আপনি যেটা ভাল পারেন সেটা মনপ্রাণ দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে করুন। দেখবেন হয়তো কোথাও একটা ন্যায়বিচার অপেক্ষা করে আছে। আসবেই এমন গ্যারান্টি নেই। কিন্তু আপনাকে পড়ে থাকতে হবে নিজের নিষ্ঠা নিয়ে।’

রাহুল দ্রাবিড় আপনি জিতবেন কি ব্যর্থ হবেন, তার উত্তর সময়ের গর্ভে। আমার প্রজন্ম মনে করে, আপনি জিতেই গিয়েছেন। আপনি নিজের দর্শন দিয়ে আমার প্রজন্মকে জীবনের সহজ পাঠ শিখিয়ে গিয়েছেন। আপনার কথাগুলোই এই রাতে অনুরণিত হচ্ছে, ‘মনপ্রাণ দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করে যেতে হবে। কোথাও হয়তো ন্যায়বিচার অপেক্ষা করে রয়েছে।’

রাহুল দ্রাবিড় আপনাকে সেলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link